কালরাতে মদন তাঁত
চালিয়েছে ঠিকই, তবে ভুবনের সুতো নিয়ে সে তাঁত বোনেনি। সস্তা দরের
সুতো দেখে তার কান্না পেয়ে গিয়েছিল। বিবেকে বেঁধেছিল। পর পর সাত দিন তাঁত না চালিয়ে খিঁচ ধরা
পায়ের আড়ষ্ঠতা দূর করতেই সে তাঁত চালিয়েছিল। যার শব্দ তাঁতি পাড়ার অধিকাংশ ঘরেই
পৌঁছে গিয়েছিল।
খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেই যখন উদি মদনকে কতোটা তাঁত বোনা হয়েছে জানতে চায়, মদন সোজা তাকে তাঁত ঘরে নিয়ে যায়। শূন্য তাঁত দেখে অবাক হয়ে যায় উদি। দাদনের টাকা দুটো ও সুতোর বান্ডিলটা মদন উদির দিকে বাড়িয়ে দেয়-ভুবনকে দেওয়ার জন্য।
খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেই যখন উদি মদনকে কতোটা তাঁত বোনা হয়েছে জানতে চায়, মদন সোজা তাকে তাঁত ঘরে নিয়ে যায়। শূন্য তাঁত দেখে অবাক হয়ে যায় উদি। দাদনের টাকা দুটো ও সুতোর বান্ডিলটা মদন উদির দিকে বাড়িয়ে দেয়-ভুবনকে দেওয়ার জন্য।
মদনের এই
একগুঁয়েমি উদির পছন্দ হয় না। বউটা ন'মাসের পোয়াতি। মূর্ছা
গেছে কালকেও। একবেলা এক মুঠো ভাত পায় তো তিন বেলা উপোষ! এমন করেই চলছে দু'মাস। গোপনে অনেকবার মদনের বউকে চাল-ডাল দিয়েছে উদি। কিন্তু কতো দিন?
সর্বাঙ্গ জ্বলে
যায় উদির। "বউটা গোঙাচ্ছে ঘরে, তোর মরণ হয় না! "
কিছু বলতে গিয়েও
চুপ করে যায় মদন। কথাটা শুনেই পাশে এসে দাঁড়িয়েছে মাসি। নুলো হাতটা উঁচিয়েই উদিকে
বলে ওঠে, "ও পোড়ামুখী, এই
সাত সকালে ছেলেটারে এই অলুক্ষুণে কথা বললি! ঝামা ঘষে দেবো তোর মুখে।"
উদি আর কথা বাড়ায় না। সুতোর বান্ডিলটা আর টাকা দুটো নিয়ে চলে যায়।
মদনের উপর মাসির বিশ্বাস আছে। এ অবস্থা একদিন কাটবেই কাটবে।
উদি আর কথা বাড়ায় না। সুতোর বান্ডিলটা আর টাকা দুটো নিয়ে চলে যায়।
মদনের উপর মাসির বিশ্বাস আছে। এ অবস্থা একদিন কাটবেই কাটবে।
দাওয়ায় গালে হাত
দিয়ে বসেছিল মদন। "এক পয়সার মুরোদ নেই, গর্ব কতো!" বউয়ের
এই কথাটাই বার বার কানে বাজছিল তার। দু’বছরের একটা ছেলে, আসন্ন
প্রসবা বউ, বৃদ্ধা মা, বিকলাঙ্গ
মাসি ও তার চার বছরের মেয়ে-এই নিয়ে মদনের পরিবার। এই পরিবারের প্রতি তার কি কোনও
কর্তব্য নেই? ভাবতে থাকে মদন। রাজার ছেলে রাজা-ই হবে,
তার কি মানে আছে?
সুর করে রামায়ণ
পড়তে পারে মদন। সেই ছেলেবেলা থেকেই। আলকাপের দলে নাম লেখালে কেমন হয়? বাকিটা শিখে পড়ে নেবে না হয় নৃপেণ সরকারের কাছ থেকে। নৃপেণ পাশের গাঁ
মতিহারির লোক। বেশ সজ্জন। আলকাপের দল আছে তার। মদন জানে, আলকাপ
গান পালাগানেরই একটা শাখা। এতে নাচ, গান, ছড়া, কথা, অভিনয়ের
মিশ্রণ আছে। দশ-বারোজন শিল্পী নিয়ে এর দল গঠিত হয়। দলের প্রধানকে বলা হয় 'সরকার'। কেউ কেউ 'ওস্তাদ'বা 'মাস্টার' বলেও ডাকে। অন্যদের মধ্যে থাকে দু-এক
জন সঙদার, দু-তিন জন ছোকরা, বাদ্যকর
ও বাকিরা দোহার।
সাধারণত, রাত্রিবেলা উন্মুক্ত মঞ্চে বসে আলকাপের আসর। মঞ্চের চারপাশে দর্শকরা
ভিড় করে দাঁড়িয়ে নয়তো বসে গান শোনে। আর দলের সদস্যদের মঞ্চে যাতায়াতের জন্য থাকে
একটা সরু পথ।
ছেলেবেলায় বাবার সাথে কতো বার গেছে আলকাপের আসরে, তা গুণে বলতে পারবে না মদন। বেশ মনে পড়ে, প্রথমে সুরকার এসে বন্দনা গেয়ে ও ছড়া কেটে পালার মূল বিষয়ের সঙ্গে দর্শকদের পরিচয় করিয়ে দেয়। পরে সে ও গায়েন আলকাপ শুরু করে এবং দোহাররা ধুয়া ধরে তাদের সাহায্য করে। অন্তত পক্ষে দোহার হতে তো তার বাধা নেই! আর সে যদি চেষ্টা করে নিশ্চয় পারবে। যে কোনও কাজই মদন বেশ নিষ্ঠা সহকারে করে, তা সবাই-ই জানে। আর সে জানে তার জীবনটাই একটা আস্ত আলকাপ। তাই দোহার হয়ে আলকাপের দলে গলা মেলানো তার সাধ্যের মধ্যেই।
ছেলেবেলায় বাবার সাথে কতো বার গেছে আলকাপের আসরে, তা গুণে বলতে পারবে না মদন। বেশ মনে পড়ে, প্রথমে সুরকার এসে বন্দনা গেয়ে ও ছড়া কেটে পালার মূল বিষয়ের সঙ্গে দর্শকদের পরিচয় করিয়ে দেয়। পরে সে ও গায়েন আলকাপ শুরু করে এবং দোহাররা ধুয়া ধরে তাদের সাহায্য করে। অন্তত পক্ষে দোহার হতে তো তার বাধা নেই! আর সে যদি চেষ্টা করে নিশ্চয় পারবে। যে কোনও কাজই মদন বেশ নিষ্ঠা সহকারে করে, তা সবাই-ই জানে। আর সে জানে তার জীবনটাই একটা আস্ত আলকাপ। তাই দোহার হয়ে আলকাপের দলে গলা মেলানো তার সাধ্যের মধ্যেই।
বেলা পড়তে না পড়তেই
মদন হাজির হল মতিহারিতে। অনেকদিন পর এখানে পা রাখলো সে। অনেক পাল্টে গেছে মতিহারি।
গ্রামের একমাত্র সাঁকো এখন "রাখাল দাস ব্রিজ" নাম নিয়ে নতুন চেহারায়
শোভা পাচ্ছে। রাস্তাঘাটেও ইট পাতা হয়েছে। সরকার থেকে টিউবওয়েল বসেছে চণ্ডীমণ্ডপের
মাঠে। তবে বটগাছটা সেই একই আছে, ঝুরির সংখ্যা বেড়েছে এই যা।
দুর্গাপুজোর সময় এখানে মেলা বসে। মদন ছোটবেলায় মা'র সাথে
এসেছে ঠাকুর দেখতে। কতোবার। মা'র হাতে থাকতো হ্যারিকেন,
নয়তো টর্চ। এখন গ্রামে ইলেকট্রিক এসেছে।
চণ্ডীমণ্ডপে পাড়ার
ছেলেবুড়ো পরিবৃত হয়ে বসেছিল নৃপেণ সরকার। আলাপের সুর ভাজছিল নিচু স্বরে। কেউ কেউ
ধুয়া ধরছিল। মদনকে কাছে আসতে দেখেই উঠে দাঁড়ালো সে। মদন পরিচয় নিজের পরিচয় দিতে
গেলে,
নৃপেণ বলে উঠলো,"আরে, তুমার নাম শুনিছি কতো।
তুমি তো মস্ত বড়ো শিল্পী! তুমার নামে তো প্রবাদও চালু আছে একখান, "মদন যখন গামছা বুনবে", তাই না? তা বলো, কি মনে করে?"
-বলছি সব, যদি একটু ওদিকে চলেন...
মদনের কথায়
নৃপেণ পাশেই গ্রামের পোস্ট অফিসের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। আজ রোববার। পোস্ট অফিস
বন্ধ। একটা বিড়ি বার করে নৃপেনের দিকে বাড়িয়ে দিল মদন। বিড়িতে টান দিয়ে নৃপেন বললো,"তা, শুনি দেখি তুমার কথা..."
-সেই গর্ব আর নেই নৃপেনদা। বড়ো কষ্টে আছি। বউ-ছেলেটাকেও পেটভরে ভাত দিতে পারি না দু'বেলা। তাই তো আপনার কাছে আসা।" কথাটা বলেই নৃপেণের দিকে চেয়ে থাকলো মদন।
নৃপেন সন্দিগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে বললো,"তা, আমি কি করতি পারি, বলো।"
-সেই গর্ব আর নেই নৃপেনদা। বড়ো কষ্টে আছি। বউ-ছেলেটাকেও পেটভরে ভাত দিতে পারি না দু'বেলা। তাই তো আপনার কাছে আসা।" কথাটা বলেই নৃপেণের দিকে চেয়ে থাকলো মদন।
নৃপেন সন্দিগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে বললো,"তা, আমি কি করতি পারি, বলো।"
-আপনার আলকাপের দলে যদি আমাকে ঠাঁই দেন, অন্তত পরিবারটা বেঁচে যায়।
আলকাপের দলে যোগ দেওয়ার ইচ্ছের কথা শুনে নৃপেণ বললো,"ভালো লাগলো তুমার কথা শুনে। তবে কি জানো ভাই, সে দিন আর নেই! রেডিও, টিভি যেভাবে গেরামে গেরামে পৌঁছে গেছে, মানুষ আর ওসব শোনে না। আমরাও তো প্রায় মরার মতো বেঁচে আছি। কোনও সরকারী সাহায্য পাইনি। হয় না, হয় না... এখানেও চ্যানেল লাগে ভাই। ঐ চণ্ডীমণ্ডপে একটু-আধটু গায়। অনেক দিনের অভ্যেস তো শেষ হয়ে গেল সব...।"
চোখের কোণে জল চিক চিক করে ওঠে নৃপেণের। মদনও কিছুটা অবাক হয়ে সমব্যথীর মতো নৃপেণের হাতটা ধরে আলতো চাপ দেয়। চোখ মুছে নৃপেন বলে ওঠে, "একটা সময় ছিল যখন বাবার সাথে আমি নিজে ছোকরা সেজে আলকাপের আসরে সাথ দিইছি। আজ আর কেউ এই পেশায় আসতে চায় না। সবাই সরে পড়ছে একে একে। আমি আর কতো দিন! "একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গামছা দিয়ে বারান্দার মেঝেটা ঝেড়ে মদনকে বসতে বলে নৃপেন। নিজেও মদনের পাশে বসে। জামার বুক পকেট থেকে বিড়ি বার করে নিজে ধরায়। আরেকটা এগিয়ে দেয় মদনের দিকে। বিড়িতে টান দিয়ে মদন বলে ওঠে,"ভগবান বলে আছে কিছু? আমার তো সন্দেহ হয়। থাকবেই যদি এতো অবিচার শুধু আমাদের উপর! সারা জীবন চোখের জল ফেলে যাবো নৃপেনদা?"
জোরে জোরে ক'টা টান দিয়ে বিড়িটা শেষ করে ফেলে মদন।
নৃপেন
আকাশের দিকে মুখ করে ধোঁয়া ছেড়ে বলে ওঠে,"কি বলব ভাই,
ঠাকুর্দা ছিল বেনো কানাই-এর দলের লোক। সেই বেনো কানাই, যার থেকে আলকাপের শুরু।"গর্বে ভুরু কুঁচকে ওঠে নৃপেনের। একটা সময়
মদনও তো কতো গর্ব করতো তাঁত বোনা নিয়ে। সাত পুরুষের পেশা এটা। কোনও দিন সস্তাদরের
সুতো দিয়ে তাঁত বোনেনি বাপ-ঠাকুরদা। গামছা না, বড়ো ঘরের মেয়েদের
জন্য বেনারসির বায়না পেত তারাঁ। আর তাকে কিনা বুনতে হবে গামছা?
নৃপেন বিড়িতে শেষ
টানটা দিয়েই বলে ওঠে,"ভাইরে, ঐ বাবা
এট্টু জমি রেখে গিছিল, ঐ তো ভাগে চাষ করে কোনও রকমে
চালাচ্ছি। নইলে কবেই...। আর বউটারও আহ্লাদের বাড়াবাড়ি নেই। ন্যাতা কাপড়েই কাটায় দেয়
মাসকে মাস। একটাই তো ছেলে ছিল- বরেণ, জেলে পাড়ার সতুর সাথে
মাছ ধরতি গিছিল বিলে সাপের কামড়েই মারা গেল...।"
গলা
বুজে আসে নৃপেনের।
"তবে থামতি শিখিনি আমি। ঘোষালদের গোয়ালের বিছুলি কেটে দি, ধীমানের আড়তের মোট বয়ে দি...ওখান থিকিই উঠে আসে নগদ কিছু।"
নৃপেনের
যে কোনও রকমে চলে যাচ্ছে, বুঝতে পারে মদন। তারও তো চলে যায়, যদি সেও ভুবন ঘোষালের কথা মেনে নেয়! কোনও আশা নেই দেখে উঠে দাঁড়াতে
দাঁড়াতে মদন বলে,"আজ না হয় উঠি...পরে দেখা হবে
নৃপেনদা।"
নৃপেনও
উঠে দাঁড়ায়। মদনের ঘাড়ে হাত রেখে সে বলে,"পেটে টান পড়লি,
গর্ব করতি নেই ভাই। শিল্পী না খেলি শিল্প বাঁচবে কি করি বলো দেখি। কে কি ভাবলো, তাতে তুমার কি?"
মদন
তাঁতি পাড়ায় পা দিতেই সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায় কেউ কেউ। কাল রাতে যে মদন তাঁত
বোনেনি,
এক মাত্র উদি ছাড়া কেউ বিশ্বাসই করতে চায় না। মদন কোনও দিকে না
তাকিয়েই সোজা ঘরে ঢুকে পড়ে। উৎসাহী মুখগুলোও তাকে ঘাটাতে সাহস পায় না, কেননা মদনের যা বুনো রাগ! রাস্তায় উদির সাথে দেখা হয়েছিল মদনের। উদি
মুখ ঘুরিয়ে চলে গেছে।
ঘরে ঢুকেই মদন
দেখলো বউ শুয়ে আছে মাদুর বিছিয়ে। পাশে ছেলেটা বেঘোরে ঘুমচ্ছে। বারান্দায় এসে মা'র কাছ থেকে মদন জানলো, বউ এখন একটু ভালো। তবে প্রসব
বেদনা কখন যে ওঠে বলা যায় না। তাই সে দুগ্গা বুড়িকে খবর দিয়ে এসেছে।
মদন ঘরে ঢুকে ঢক
ঢক করে এক ঘটি জল খেয়ে শুয়ে পড়লো। বউ একটু একটু করে তার কাছে এগিয়ে এল।
হ্যারিকেনের আলোটা অল্প বাড়ালো। পাশের ঘরে ছেলে-মেয়েগুলোকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে
মা-মাসি।
কাত হয়ে শুয়েছিল মদন। গায়ে হাত দিল বউ,"শোনো, এই সময় আমার এট্টু ভালো-মন্দ খাওয়ার দরকার। আর ছেলেটার দিকে তাকায়েছো কেমন রোগা হয়ে যাচ্ছে দিন কে দিন! তাছাড়া মা-মাসির শরীলও ভালো যায় না। ওষুধ খাওয়ারও পয়সা নেই। তুমি কি চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে থাকবা?...ওরা দেখো দিব্যি আছে, তুমি খামখা গোল করো কেন?...ভুবনের কথা শুনলি, লাভ বই ক্ষতি তো নেই।"
কাত হয়ে শুয়েছিল মদন। গায়ে হাত দিল বউ,"শোনো, এই সময় আমার এট্টু ভালো-মন্দ খাওয়ার দরকার। আর ছেলেটার দিকে তাকায়েছো কেমন রোগা হয়ে যাচ্ছে দিন কে দিন! তাছাড়া মা-মাসির শরীলও ভালো যায় না। ওষুধ খাওয়ারও পয়সা নেই। তুমি কি চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে থাকবা?...ওরা দেখো দিব্যি আছে, তুমি খামখা গোল করো কেন?...ভুবনের কথা শুনলি, লাভ বই ক্ষতি তো নেই।"
ঝেজে
উঠলো মদন,"শালী, তোর জ্ঞান তুই রাখ্। খুব ফটর ফটর হয়েছে, না?"
একে তো
প্রসব ব্যথা, তায় আবার মদনের বাক্যবাণ ; সর্বাঙ্গ জ্বলে গেলো চাঁপার। বলেই ফেললো,"একটা বাচ্চার জন্ম দিইছো, খাওয়ানোর ক্ষ্যামতা নেই,
আবার একটা আশা করো কেন?..."আরও
কিছু বলতে যাচ্ছিল সে, পাশের ঘর থেকে গণ্ডগোলের আওয়াজ
শুনে ছুটে এল মদনের মা। ছেলেকে বে-আক্কেলে কথা বলতে দেখে সে বললো,"ও বাপ্, তুই এমন করলি, আমরা বাঁচবো কি করে, বল দেখি...বউটা না খেয়ে
থাকলি, তোর বাচ্চাটাও তো না খেয়ে থাকবে, না? একটা কিছুর ব্যবস্থা কর বাপ্। নইলে এক
সাথে বিষ খাওয়া ছাড়া তো আর কোনও উপায় দেখি না।"
মা'র কথা শুনে কিছুটা ক্ষান্ত হল মদন। চুপ করে আকাশ-পাতাল ভাবতে থাকলো সে। চাঁপাও চুপ। ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল মদনের মা। পাশ ফিরে শুলো মদন। আর খুদকুঁড়োহীন সংসারে নিদ্রাদেবীর আসারও ঠিক ঠিকানা নেই। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে মুশলধারে। তবে গরমের গুমোটভাব এখনও যায়নি।
মা'র কথা শুনে কিছুটা ক্ষান্ত হল মদন। চুপ করে আকাশ-পাতাল ভাবতে থাকলো সে। চাঁপাও চুপ। ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল মদনের মা। পাশ ফিরে শুলো মদন। আর খুদকুঁড়োহীন সংসারে নিদ্রাদেবীর আসারও ঠিক ঠিকানা নেই। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে মুশলধারে। তবে গরমের গুমোটভাব এখনও যায়নি।
মদন তার কথা রাখতে
পারলো না। চরম অর্থনৈতিক অনটনে পড়ে শেষ পর্যন্ত ভুবনেত প্রস্তাবটাই সে মেনে নিল।
সুতো চেয়ে বসলো ভুবন ঘোষালের কাছে। অগ্রিম দু'টাকাও নিল। ন'মাসের পোয়াতি রুগ্ন বউটার জন্য বাজার থেকে কিনে আনলো দু'পোয়া দুধ, আঙুর, একটু
তেঁতুলের আচার বউ ভালোবাসে। অনেক দিন পর ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত দেখে ঠোঁটের কোণে এক
চিলতে হাসি রেখে চাঁপা মদনকে বললো,"তুমি খুব ভালো
গো!"মদন লজ্জায় কুঁকড়ে যায়। আসন্ন সন্তান যে এবার সুস্থ শরীরেই পৃথিবীর আলো
দেখবে, তা চিন্তা করে একগাল হেসে মদনের মা মদনকে পাখার
বাতাস করতে করতে বলে,"বাপ্ আমার, বেঁচে থাক।" হাসি দেখা যায় মাসির মুখেও।
বৃন্দাবন -কেশবের
চেয়ে মদনের বোনা তাঁত কোনও অংশে কম নয়। বরং প্রয়োগ নৈপুণ্যে একটু বেশিই ভালো। হোক
না নিম্নমানের সুতো। শিল্পীর হাতের ছোঁয়াতেই তো তা হয়ে উঠছে অভিনব। মদন বুঝেছে, তাঁতকল তার শিল্প সাধনার জায়গা। তাই এক জন শিল্পী হয়ে তার সঠিক
ব্যবহারের দায়ও বর্তায় তার উপর। একে সচল রাখতেই হবে। তাঁত বন্ধ হয়ে যাওয়া মানেই তো
তারও মৃত্যু!
"না, মরার আগেই ভূত হয়ে যাবো কেন?"-এই ভাবনাই
তাকে ভাবাতে লাগলো রাত দিন।
পুকুরপাড় দিয়ে
একমনে হেঁটে আসছিল মদন। তাকে দেখতে পেয়েছে উদি। গায়ে পড়েই আলাপ করতে এল সে। একগাল
হেসে সে বললো," শুনলাম সব। তুমি যদি এরম তাঁত চালাও রোজ,
তবে কি আর অশান্তি হয় ঘরে? কোনটা ঠিক,
কোনটা বেঠিক বুঝবা না? নিজের ভালো
পাগলেও বোঝে, তা তো জানো? তাছাড়া
তোমার কি দায় নেই কোনও?" মদন কিছু বলতে গিয়েও থেমে
যায়। ইদানীং সে আগের মতো হুটহাট করে রেগে যায় না। সব কথা ঠাণ্ডা মাথায় শোনে। তারপর
তার উত্তর দেয়। গামছা দিয়ে কপালের ঘাম মুছে মদন তাকালো উদির দিকে। মনে হল উদি তার
প্রশ্নের জবাব চাইছে। মাথা নিচু করলো মদন। বললো,"দায়
আছে জানি। কিন্তু.....আমি যে হেরে গেলাম। ভুবন ঘোষালের সুতোই শেষে আমাকে নিতে হল!
এতো আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। আমাকে মাথা নোয়াতে হল ভুবনের কাছে? "
-"তাতে কি হয়েছে,
তুমি বাঁচলে, তোমার পরিবার বাঁচলো।
মানিয়ে চলাও তো জীবনের একটা শিক্ষা। মানিয়ে চলো, দেখবে
ঠিক টিকে যাবে। এটাই জীবন, এটাই জগৎ।" উদি যে ঠিকই বলেছে, ঘাড় নেড়ে সায় দিল মদন।
ইদানীং ভুবনের
যাতায়াতও বেড়েছে মদনের বাড়িতে। ভুবন আসলে মদন নিজে থেকেই পিঁড়ি পেতে দেয় দাওয়ায়।
এক গ্লাস জল বাড়িয়ে হাত পাখাটা ধরিয়ে দেয় ভুবনকে। ভুবনও ভালোমন্দের খোঁজ নেয়
মদনের। তাঁতবোনা কতোটা হল স্বচোখে দেখে নেয় ভুবন। সুতো শেষের খবর শুনে পরেরদিনই
লোক মারফৎ মদনের কাছে সুতো পাঠিয়ে দেয় সে। এই ভুবনের জন্যই ইদানীং করে-কম্মে
খাচ্ছে মদন। ঘরে একটু শান্তিতে থাকতে পারছে সবাই। অন্তত দু'বেলা দু'মুঠো খাওয়ার তো অভাব নেই। ভুবনকে তাই
মদনের স্বয়ং 'দেবদূত' মনে হয়।
ভুবন না থাকলে মদনের দুর্দশা বাড়তো বই, কমতো না।
এই তো সেদিন
ভুবনের বাড়িতে সত্য নারায়ণের পুজো ছিল। প্রসাদ খাওয়ার নেমন্তন্ন করে গিয়েছিল ভুবন।
মদন গিয়েছিল মা আর ছেলেকে নিয়ে। ফিরে আসার সময় ভুবনের বউ প্রসাদ পাঠিয়ে দিয়েছিল
চাঁপার জন্য। গ্রামের কতো লোক এসেছিল! সবাইকেই চেনে মদন। আর আসবেই বা না কেন, ভুবন যে গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তি। ওখানেই দেখা হয়ে গিয়েছিল বৃন্দাবন
-কেশবের সঙ্গে। প্রথম মদন কথা বলতে চায়নি। যেচে এসে বৃন্দাবনই আলাপ সারলো,"কি মদনদা, শেষটায় আবার তাঁত বুনছো তাহলে! তুমি
নাকি ভুবন ঘোষালের দেওয়া সুতোতে তাঁত বুনবে না, কই
পণ-প্রতিজ্ঞা সব ধুয়ে মুছে গেল?"
লজ্জায় মদন কোনও
কথা বলতে পারলো না। বৃন্দাবন-কেশবের কথা যদি আগে শুনতো, তাহলে তো আজ আর এই কথা শুনতে হতো না। মদন চুপ করে আছে দেখে কেশবই বললো,"ছাড়ো মদনদা
বৃন্দাবনের কথা। ও একটু ওরকম বলে।নাও বিড়ি খাও।"
বিড়িতে
জোরে জোরে কয়েকটা টান দিয়ে ফেলে দিল মদন। হাত উঁচিয়ে বিদায় জানানোর ভঙ্গিতে সে
বললো,"না ভাই, আমি তা'লে
আসছি। কাজ পড়ে আছে অনেক। কাল সকালেই অর্ডারের মালগুলো দিয়ে দিতে হবে ঘোষালকে।
সেরকমই কথা আছে।পরে কথা হবে।"-"ঠিক আছে মদনদা,
তুমি যাও, আমরা
পরে আসছি।" কেশবও বিদায় জানায় মদনকে। বৃন্দাবন তখন প্রসাদের লাইনে দাঁড়িয়ে।
বাড়ি
এসে হাত মুখ ধুয়েই তাঁত ঘরে ঢুকে গেল মদন। ক'দিন তাঁত না বুনে বুনে
হাত-পায়ে যে খিঁচ ধরে গিয়েছিল তার, এখন তা আর নেই।
একেবারেই উধাও। শরীর বেশ চনমনে এখন। মনেও বেশ উৎফুল্লভাব। যেন
একটা খাদের কিনারা থেকে ফিরে এসেছে মদন তাঁতি। তবে এই কয় দিনে জীবনকে খুব কাছ থেকে
দেখেছে মদন। টাকায় সব হয় না, কিন্তু এটাও ঠিক অনেক কিছুই আবার
টাকা না থাকলে হয় না।
মদন আজ
গামছা বুনছে-ভুবনের সস্তাদরের সুতো দিয়েই। কিন্তু এখনও সে স্বপ্ন দেখে, বাপ্-ঠাকুরদার মতো একদিন সেও বেনারসির অর্ডার পাবে।
সারারাত বৃষ্টি
হয়েছে। জল জমে গিয়েছে উঠোনে। ব্যাঙ ডাকছে বিশ্বাসদের পুকুরপাড়ে। মনে হয় আবারো হবে।
এদিকে সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে খিদের চোটে কান্না জুড়ে দিয়েছে মদনের ছেলেটা। চাঁপা
চ্যাঁচাচ্ছে সমানতালে,"ছেলেটা কাঁদছে খিদেয়, আর উনি ঘুমোচ্ছেন পড়ে পড়ে! এ জ্বালা আর জুড়োবে কবে, কে জানে!"
মদনের মা ডাক দিল মদনকে,"ও বাপ্, ওঠ, আর ঘুমোসনে। ছেলেটা যে কাঁদে।" চোখ খুলে একটু ধাতস্ত হতে সময় নিল মদন। কালরাতের স্বপ্নটাকেই আজ সত্যি করে তুলতে হবে তাকে। যেমন করেই হোক। করতেই হবে।
মদনের মা ডাক দিল মদনকে,"ও বাপ্, ওঠ, আর ঘুমোসনে। ছেলেটা যে কাঁদে।" চোখ খুলে একটু ধাতস্ত হতে সময় নিল মদন। কালরাতের স্বপ্নটাকেই আজ সত্যি করে তুলতে হবে তাকে। যেমন করেই হোক। করতেই হবে।
____________________________________________________
(বহমান জীবন। থেমে
থাকে না। বয়ে চলে নদীর মতোই। "শিল্পী" গল্পের পরের গল্পটি হয়তো এটাই
হয়েছিল।
সুধী পাঠক, রচনায় লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের "শৈলী" খুঁজতে যাবেন না, তাহলেই ব্যর্থ।)
সুধী পাঠক, রচনায় লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের "শৈলী" খুঁজতে যাবেন না, তাহলেই ব্যর্থ।)
No comments:
Post a Comment