07 May 2016

উদয় শংকর দুর্জয়


লিখে রাখি বিশুদ্ধ আত্মার রাত্রিদিন
আমি লিখে রাখি সেই সব রাত্রিদিন, যেখানে প্রকাশ্যে খুন দিয়ে পবিত্রতা সুরাক্ষা করে কিছু কিছু বিপথগামী ভ্রূণ। শার্লি হেব্দোর কাগজে টেবিলে জ্বল জ্বল করে ওঠে রক্তিম মানচিত্র। প্যারিসের পথে বিদ্রোহী স্রোতে ভেসে যাওয়া ৩.৭ মিলিয়ন আহত আত্মার শ্লোগান।
আমি লিখে রাখি ঢাকার বিশুদ্ধ আক্সিজেনে এখন পেট্রল পোড়া বারুদ। ঝলসে যাওয়া জীবন ছবির স্পষ্ট অবয়ব। হাসপাতালের বারান্দায় শুয়ে থাকা চেতনার কঙ্কাল তবু ওরা বালির ট্রাক আর বুলেটের রাজনীতি তরান্বিত করে অহোরাত্র। লুট হয়ে যায় প্রকাশ্যে স্ব-ধীনতা। দগ্ধ তখন লালসার বার্ন ইউনিট, দগ্ধ তখন ঘরে ফেরা যৌবন, দগ্ধ তখন ভোরের পাখি বৈকাল্যের দুরন্ত ছেলেবেলা, দগ্ধ তখন আমার মায়ের অপেক্ষার সোনা মুখি বদন।     


যে রাষ্ট্র দায় স্বীকার করে না
রাষ্ট্রের জন্য মায়া জাগে। ক্রোধ ছাড়িয়ে যায় সীমানা।
একটি যথোচিত ভোরের জন্য প্রার্থনায় লীন হয় রাতপ্রহর।
আর ক্রন্দিত সমাচার পড়তে পড়তে আকাশ লুকিয়ে রাখে মুখ।
আশঙ্কা নিয়েই দাঁড়াই মুখোমুখি। কোন হিসেবের খাতায়
ভুলের ঘ্রাণ মাখা ফুল। কোন রমণী আজ আবার ঠায় দাঁড়াবে
অঙ্গনে আনত মস্তকে। যে শিশু সম্ভ্রমের সংজ্ঞা বুঝে উঠবার
বহু আগেই রক্তাক্ত মেঘ মেখে নেয় শরীরে। আর যে রাষ্ট্র দায় স্বীকার করে না
ফেনীর সাড়ে তিন বছরের শিশু আর কুমিল্লার সোহাগীর জন্য
কার কাছে চাইব এক খণ্ড সুবিচার। এ লজ্জার নিবারনের জন্য
আকাশ ভেঙে পড়ুক। এক প্রলয়ঙ্কর দানবীয় ঝড়ে সব পরাভব
নিঃশেষিত হোক। অতঃপর একটি নতুন মানব সভ্যতা জাগুক



ম্লান অরুণালোয় নক্ষত্রের স্বরলিপি
রুপশালি ধানের ঘ্রাণ শুকে কোন ধনেশ পাখি
গড়েছিল আবাস - তার জন্য লিখেছিলে
নক্ষত্রের স্বরলিপি ম্লান অরুণালোয়। আরও
একশ বছর তুমি লিখে যাচ্ছ হেমন্তালয়ে
ঝরা পাতার নিরুপমা চিঠি। লাবণ্যময়ী সন্ধ্যা
দাঁড়ালে উঠনে, মুছে ফেলে রোদ্দুরের লয়
ভেজা মেঘ খুঁজে ন্যায় ধানসিঁড়ির শ্যাওলা শরীর।

ধূসর গোধূলি থেমে গেল। পারাবাত মেঘালয়
ছড়িয়ে দিয়ে গেল স্নাত জ্যোস্নার ফুল।
শ্রাবস্তীর মায়া জড়িয়ে নিতেই
অবারিত ঝাউয়ের উদ্যান গাইল
সবুজ বেহালায় গৃহত্যাগীর গান। অদ্ভুত আঁধারে
জমিয়ে অভিমান। নিঃশ্বাসের তরঙ্গে ফেলে গেলে
দিক ভুলো ট্রামের ক্ষুধার্ত কুয়াশা সমাচার।



ব্যর্থতার দলিল মোড়া সময়
আরেকটু পর হাফিজের জানাজা। ক্ষুধার্ত নিউমোনিয়ার হিংস্র দাঁত
যেন বিক্ষত করল শুধু এম এস হলের হাফিজকে নয়
রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতাকে দলিল লিখে শিকার হয়ে গেল অবলীলায়।
বাবুল মাতুব্বর! চা বিক্রেতার পোড়া হৃপিণ্ড যেন কাঁপিয়ে দিয়ে গেল
পুরো আকাশ। মাত্র ৫০০ টাকা চাঁদা দেয়ার ব্যর্থতায়
দেশলাই জ্বলে উঠলো একদল রাষ্ট্রীয় পোশাকিদের
ঘৃণ্য কপাট খুলে। সব লেনদেন মুঠো বন্দী করে
বার্ন ইউনিটে খুঁজে নিল অন্তিম আশ্রয়।
বিবৃতি আর সংলাপে ফুলে ফেঁপে উঠবে টক শো
আর ওয়েব শো। পরিযায়ী ফিরে যাবে ঘরে।
হাফিজ ও বাবুলের দাফনের সিক্ত হাওয়া মেখে
একদল স্বজন ঘরে ফিরবে কঠিন পাথর - হৃতভূমে চাপা রেখে।
চাপা রেখে সব ব্যথার কলহ, নিরন্তর আহত মেঘ
বুকের বন্দরে জমা রেখে হাফিজের বাবা শুকিয়ে নেবে অশ্রু
অটোরিকশার তৃষ্ণার্ত বিবাগী হাওয়াতে। বাবুলের সহধর্মিণী
হিসেবের খাতা লিখতে লিখতে চা - পাতার গোপন সৌরভে
বুকের মধ্যে লালন করে চলবে প্রাণেশ্বরকে।
এর পরও আমরা কিনছি ১ মিলিয়ন ডলারে সামরিক অস্ত্র
২২০ মিলিয়ন ডলারে যুদ্ধ জাহাজ, আর পরিচর্যায় ৫৫৯ মিলিয়ন ডলার।
তবু, আমরা গড়ছিনা পর্যাপ্ত আবাসিক হল, ভাবছিনা হাফিজের
কনকনে রাত্রির শীতকনা ঘায়েলের অস্ত্র নিয়ে। দেখছি না
পানিবন্দী পাঠশালা শূন্য পড়ে থাকা অসহায় সময়গুলো।
মুখ লুকিয়ে নিচ্ছি শাসক আর শোষকের ভুলে ভরা
পাণ্ডুলিপি দেখেও। আমরা একটিবারও ভাবছি না
একটি বটবৃক্ষের কথা, একটি নিশ্চিত ভবিষ্যতের সোনালি পথ। 




নীলাদ্রির হিম সরোবর
সুবিদ বাজার শাহবাগের ক্ষত না শুকোতেই ওরা চাপ চাপ আদ্রতায় ভিজিয়ে দিল নীলাদ্রির ঘরের মেঝে। এখন খিলগাঁওর ওভার ব্রিজের নীচে নিঃসঙ্গ বাতাস খেলা করে। ভীষণ একাকী আত্মা গুলো খুনিদের উল্লাস দেখে মুখ চেপে ধরে।
প্রতিটি চাপাতির হুঙ্কারে কেঁপে ওঠে পরিবেশি বাতাস। শত্রুর জন্য বদলে যায় ওদের আকার, এক একটি হায়েনা বিক্ষত করে নীলাদ্রির তাজা ফুস ফুস। এ লেখা লিখতে লিখতে বাম হাত অজান্তেই গ্রীবা ছুঁতেই বুকের মধ্যে কম্পন ধেয়ে যায় তড়ি। প্লাবিত হতে যাওয়া ম্যাকবুক অক্সিজেন খোঁজে ধমনীতে।
নীলাদ্রিরা বারবার জন্মে না। জন্মে না আজাদ রয় অনন্ত বিজয়, ওরা যে বাতাসে ফেলেছিল শ্বাস সে বাতাস আরও বিভীষিকাময় আতঙ্কের জানপদ। চাপাতির নিষ্ঠুর বর্বরতায় আশান্ত হয়ে ওঠে যখন জুম্মার আওয়াজ তখন একটি শহুরে কাকও ডুকরে কেঁদে ওঠেনি। যখন ফিনকি দিয়ে রক্ত ওড়ে তখন কোন কবুতর ডানায় জড়িয়ে নিলো না বেহাগের সকরুণ চিহ্ন। একটিবারের জন্য ছেঁড়া ধমনীতে কোন মানবাধিকারের স্পর্শ পেল না।

নীলাদ্রি এখন হীম সরোবরে শুধুই নাম লেখা চিঠির খাম। চিঠি খুললেই যেমন বেরিয়ে পড়ে উপাত্য ঠিক নীলের গ্রীবায় মাথায় হিংস্র ছোবলের নিশানা গুলো আদৃত চোখ যেন প্রতিবাদের হিমালয় পেরিয়ে বড্ড শ্রান্ত।  

No comments:

Post a Comment