08 May 2016

মাসুম বিল্লাহ


দুপুরের গল্প
চৈত্রের আগুনজ্বলা দুপুরে বাসায় এল আতাহার। ঠিক কতদিন পর দুপুরেবেলায় বাসায় এল মনে করতে পারে না। প্রতিদিন সকালে বাজারে তার নিজের দোকান খুলে বসে, আবার মাঝ রাতে দোকান বন্ধ করে বাসায় ফেরে। দুপুরের খাবার বাসা থেকে পাশের বাসার মন্টুর বাপ সোলেমান বকশির কাছে দিয়ে দেয় আতাহারের স্ত্রী রেশমা। অনেকবারই সে আতাহারকে বলেছে, আপনে দোকান বন্ধ কইরা দুপুরের ভাত ঘরে আইসা খাইলেতো পারেন।
আতাহার তখন সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলেছে, তুমি যদি ব্যবসার কিছু বুঝতা তাহলে আর এই কথা কইতে পারতা না বউ।

রেশমাও রাগ-অভিমান মেশানো গলায় বলেছিল, ব্যবসা আমার বোঝনের কাম নাই, আমি কী আমার জন্য কই, আমি তো কই আপনের ভালোর জন্য।
তখন আতাহারের সুর নরম হয়ে আসে, বলে, তা কও দেহি কী ভালো হইবো আমার?
রেশমা কণ্ঠ খাদে নামিয়ে মিহি স্বরে বলে, আপনে গা-গোসল দিয়া শান্তিমতন ভাত খাইতে পারতেন, তারপর ধরেন, ভাত খাওনের পর বিছানার উপরে গড়াগড়ি দিয়া আস্তেধীরে দোকানে গেলেন
আতাহার তখন রেশমাকে কাছে টেনে নিয়ে বলে, ওরে বউ তাইলে আর দোকানে যাওন লাগবো না, ব্যবসা লাটে উঠবো।

অবাক হয়ে রেশমা বলে, ক্যান দোকানে যাইবেন না, ক্যান ব্যবসা লাটে উঠবো?
রহস্যঘেরা কণ্ঠে আতাহার বলে, সেদিন কী আর তোমারে ফালাইয়া দোকানে যাওন যাইবো? আমার ইচ্ছা করবো না তোমারে জড়াইয়া ধইরা দিন-রাইত পইড়া থাকি?
লজ্জা পেয়ে রেশমা বলে, কী শরমের কথা যে আপনে কইতে পারেন! যান আপনেরে আর দুপুরে ভাত খাইতে আইতে কমু না। আজ অনেক দিন পর দুপুরে আতাহারকে চোখের সামনে দেখে ঠিক বিশ্বাস করতে পারে না রেশমা। চমকে ওঠে সে। চোখ মুখে খুশির ঢেউ খেলতে দেখা যায় তার।
গামছা আর সাবানের কেস স্বামীর হাতে দিয়ে বলল, যান গা-গোসল দিয়া আসেন, এর মধ্যে আপনের ভাত গোছাইয়া দিতাছি।
আগে ভাত দ্যাও, গোসল একবারে করমুনে বউয়ের থুতনি নেড়ে বলে আতাহার।
দেরি করলে আপনের ব্যবসা লাটে উটবো না?
রেশমার খোঁচা টের পায় সে।
উঠোনের কোনো চাঞ্জ নাই বউ, ঠাডা পরা রৌদের মধ্যে মানুষ দূরের কথা একটা কাক-পক্ষীও নাই বাজারে। এক সেকেন্ডের জন্য রেশমাকে ঠোট উল্টাতে দেখল আতাহার। সে কিছু বলার আগে রেশমা রান্নাঘর থেকে মাদুর এনে বিছিয়ে দিল।
ভাত খাওয়ার মাঝপথে আতাহারের মোবাইলের রিংটোন বেজে ওঠল
ভাত মুখে নিয়ে বিড়বিড় করে সেহালা কামাইল্লার বাচ্চা...
তারপর বাম হাতে মোবাইল কানের কাছে নিয়ে চেঁচিয়ে বলে, তোরে না কত্তদিন কইছি লাঞ্চ টাইমে মাল নিতে আইবি না, আজ দোকান বন, বউ লইয়া শ্বশুর বাড়ি আইছি
কথা শেষ করে মোবাইল মাদুরের ওপর ছুঁড়ে মারল সে। মোবাইলের পাওয়ার অফটোন বেজে উঠতে শোনা গেল। রেশমাকে উদ্দেশ্য করে আতাহার বলে, বুঝলা বউ, এই হালা কামাইল্লা একটা ভ্যাজাইল্লা কাস্টমার!
রেশমা স্বামীর প্লেটে আরেকটা টেংরামাছ তুলে দিয়ে বলল, কাস্টমারের লগে মেজাজ দেখাইলে আপনের ব্যবসা লাটে উঠবো না?
এ্যাঁ আইছে আমার দরদী, যার লাইগ্যা করি চুরি, হ্যায় কয় চোর, ঠিক আছে অখুনি তাইলে দোকানে যাই...
থাউক হইছে, আর বেশি প্যাচালে কাম নাই, ধীরেসুস্থে খান...
তুমি খাইবা না?
আপনে জানেন না, ভাত খাইলে আমার শরীর ছাইড়্যা দেয়?
আতাহার আর কথা আগায় না, দ্রুত ভাত খেয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়। তারপর রেশমাকে কাছে ডেকে বলে, আসো,
এ সময় পাশের বাসার মন্টুর বাপ সোলেমান বকশি এসে ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে চি
কার করে ওঠে, "ওরে আতাহারইয়্যা মোবাইল বন্ধ কইরা রাখছো ক্যা, তোর দোকান তো পুইড়া শ্যাষ!"




দুপুরের গল্পের পর...
আগুনে পুড়ে যাওয়া আতাহারের দোকান ঘরটা কঙ্কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল কিছুদিন। বাজার কমিটি তাকে ক্ষতিপূরণ বাবদ কিছু নগদ অর্থ দিতে চেয়েছিল কিন্তু সে সবিনয়ে তা ফিরিয়ে দেয়। নিয়তির ওপর কারো হাত নেই, তাছাড়া অন্যের সাহায্য নিতে চায় না সে। সবাই তখন অবাক হয়ে বলেছিল, কী কও মিয়া, ট্যাকা লইবা না ক্যান?
আতাহার স্বহাস্যে বলেছিল, নতুন কইরা দোকান করার ইচ্ছা নাই।
আবারও সবাই দ্বিগুন অবাক হয়ে জানতে চায়, তাইলে করবা কী? ব্যবসাপাতি না করলে চলবা ক্যামনে?
আতাহার রহস্যঘেরা কণ্ঠে বলে, কিছু না কইরা তো আর থাকোন যাইবো না, তয় অখনও কিছু ঠিক করি নাই, ভাবতাছি কয়দিন ঘরে মইদ্যে শুইয়া-বইস্যা পার করমু।
আতাহারের এ কথায় সবাই মুখে কিছু না বললেও মনে মনে তারা নিশ্চিত হয়, দোকানের শোকে মাথামোথা আউলা হইয়া গ্যাছে।
আর্থিক সাহায্য ছাড়াই আতাহার ঘুরে দাঁড়াতে চায়, অতীতেও সে নিজের চেষ্টায় সে এই দোকানটি দাঁড় করেছিল। আবারও সে কিছু একটা করবে, সে জানে সে পারবে। পুড়ে যাওয়া দোকানটির শোক তাকে গত সতেরো দিন ঘরের ভেতর বন্দি করে রাখল। প্রতিদিন চোখের সামনে তার ব্যস্ত দোকানটি ভেসে উঠত, একটার পর একটা কাস্টমার সামলাতে ব্যস্ত সে। ঘোর কাটতেই বুকের ভেতর থেকে নীরবে দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসতে লাগল।
স্ত্রী রেশমাও ঘুরেফিরে নিজেকে দোষ দিতে লাগল, দুপুরে না আইলে এই বিপদ হইতো না।
আতাহার জোরে হাসি দিয়ে বলে, তোমার যত বেহুদা কতা, দোকানে থাকলেই কী আগুন আমারে দেইখ্যা নিবভা যাইতো? একটু থেমে নিজেই বলে, যাইতো না বউ, তুমি এইসব কতা আর কইবা না কইলাম।
-এখন কী করবেন, ঠিক করছেন কিছু?
-হ ঠিক কইরা ফালাইছি, ঘরেই বইসা থাকবো আর তোমার লগে গপসপ করবো।
হো হো করে বেদম হাসিতে ফেটে পড়ে আতাহার।
কিন্তু রেশমা সে হাসিতে যোগ না দিয়ে বলে, বইসা খাইলে রাজার গোলাও শ্যাষ হইয়া যায়, কামকাইজ কিছু একটা করেন।
-ঠিক করছি বিদ্যাশ যামু, ট্যাকা কামামু তারপর দ্যাশে ফিইরা পায়ের ওপর পা তুইল্লা খামু।
-বিদ্যাশ যাইবেন, তা ট্যাকা পাইবেন কই?
-আরে বউ ক্যাশপাতি কিছু তো আছে, তোমার স্বামীরে এত ফকির ভাবলা কেমনে?
-হাছাই বিদ্যাশ যাইবেন আপনে?
-তোমার লগে মিছা কতায় কাম কী বউ?
-কবে যাইবেন, কবে আইবেন, ব্যাবাক ঠিক কইরা ফালাইছেন নাকি?
-আগামী মাসেই যামু, পাঁচ বছর ছাড়া আর দ্যাশে আইতে পারুম না।
-ও।
রেশমা আর কিছু বলে না। সে এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না, আতাহার যা বলল তা কতটুকু সত্য, তবে স্বামীকে সে পুরোপুরি অবিশ্বাসও করেনি কখনো।

আতাহার একটুও মিথ্যে বলেনি, ভেতরে ভেতরে সব ঠিক করে ফেলেছে, সে বিদেশই যাবে, একবারে বেশ কিছু টাকা কামিয়ে তারপর দেশে ফিরে আসবে।
মাঝের এই কয়েকটা দিন তার বেশ দৌড়ের ওপরই গেল। দেখতে দেখতে তার যাওয়ার দিন সামনে চলে এল।
এবার যেন রেশমার মন খারাপ হওয়া শুরু হলো কিন্তু স্বামীকে তা টের পেতে দিল না, কারণ পুরুষ মানুষ তো বাইরেই থাকবে, টাকা-পয়সা রোজগার করবে, তা না হলে যে সংসার চলবে না। সবই বোঝে রেশমা।


রাত ভোর হলে আতাহার ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবে। রাতটা রেশমার সঙ্গে গল্পে-অালাপে কেটে গেল।
দুপুরের আগেই সে ঢাকায় পৌছে যায়। রাতে তার ফ্লাইট। হোটেলের রুমে ঘন্টা খানেক বিশ্রাম নিয়ে বিমানবন্দর পৌঁছে গেল সন্ধ্যার পরই।
রাত দশটার ফ্লাইট আতাহারকে ছাড়াই উড়াল দিল। আতাহার বিমানে উঠেনি, সে উঠেছে তার বাড়ির ঠিকানায় যাওয়ার বাসে। ভোরের আগেই সে বাড়ির উঠোনে পা রাখল। চি
কার করে ডাকল, ও রেশমা ও রেশমা দরজা খোল...
রেশমা স্বামীর কণ্ঠ চিনতে দেরি করেনি, তবে বুকের ধুকধুক বেড়ে গেল, দরজা খুলে আতাহারকে দেখে বলল, আপনে বিদ্যাশ যান নাই?
-আমারে কি পাগলে কামড়াইছে যে বিদ্যাশ যামু?
-ট্যাকা-পয়সা খরচ কইরা কীসব কইতাছেন আপনে?
-ট্যাকা-পয়সার কোনো ব্যাপার না রেশু, বউরে দ্যাশে ফালাইয়া বিদ্যাশ যামু, তোমার আতাহার এতো বলদ না।

No comments:

Post a Comment