যেদিন শহরে মহিষ
নামলো—আমিও ছিলাম রাস্তার মোড়ে। হাতে বাজারের ব্যাগ আর একটা বই। বইয়ের নাম মনে
নাই। মহিষ আমাদের শাহরিক ত্বকে কাদা মাখিয়ে দিয়ে কোথাও হারিয়ে গেলো। বাজারের পরের
গলিতে ঢুকেই উধাও। কিন্তু ঢাকা ট্রিবিউনে খবর এলো, এলিফ্যান্ট রোডে মহিষ নেমে
জুতার দোকানে হারিয়ে গেলো টাইপের নিউজ। নিউজ এডিটর একদা আমার বন্ধু—জাহাজের হলুদ
চিমনির পাশে বসে একটা সিগারেট ধরায়। তার স্কার্টের পাড়ে পার্শিয়ান নকশায় লেগে আছে
পৃথিবীর সকল মায়া ও মরীচিকা।
শ্রীমতি, আমি তোমাকে
হয়তো এই মহিষটির কথাই বলেছিলাম। বলেছিলাম একদিন একটা ধূসররং মহিষের প্রেমে
পড়েছিলাম। মহিষটা একা একা কাদাজলে স্নান করছিলো ভরদুপুরে। আমাদের গ্রামের পরে
আরেকটা গ্রাম আছে। সেই গ্রামে পাহাড়ের পায়ের কাছে গিয়ে থেমেছে ধানক্ষেত। তার পাশে
একটা জলার মধ্যে একা একা মহিষটা গা ডুবিয়ে বসে ছিলো। জলার ধারে একটা ডুমুরগাছ
নাফোটা ফুলের চোখে তাকিয়ে ছিলো তার দিকে।
আমি জীবনের কাছে কিছুই
চাই না। আমার জীবনে জানো, বিশেষ কোনো লক্ষ্যই ছিলো না। ছেটোবেলায় ইংরিজি
দ্বিতীয়পত্রে লেখা রচনা অ্যাইম ইন লাইফ, বোট উইদআউট রাডার। তাই প্রতিদিন এক একটা
কিছু হতে চাইতাম। একদিন হতে চাইলাম পোস্ট-মাস্টার। কোনোদিন হতে চাইতাম ডাকঘর।
ইদানীং ডাকঘর মুছে যাচ্ছে দেখে আবারও হতে ইচ্ছে করছে একটা লালরং ডাকঘর। যদি ডাকঘর
হতে পারি, রাস্তার ধারে তুমুলবৃষ্টিতে ভিজে যাবো পেটের ভিতর চিঠিসমগ্র নিয়ে।
রাত্রিও সমুদ্রের রূপ
পরিগ্রহ করে কখনো। আর তোমার মুখ মনে পড়লেই আমার মনে হয়, আমি একটা বিলম্বিত-লয়
গানের ভিতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। আর পথ দীর্ঘ হচ্ছে ক্রমে। আমার এমন মনে হয়। সেদিন
ভোরবেলা স্বপ্নে দেখলাম তোমাকে বলেছি, আমাদের সেই হারানো পাতাবনে আমি নিজের সঙ্গে
হেঁটে বেড়াচ্ছি। আর সব কেমন পাল্টে গেছে। কেউ আমাকে চিনছে না। পেছন থেকে নাম ধরে
ডাকছে না। এমন কান্না পাচ্ছিলো, জানো! এখনও কেমন কষ্ট হচ্ছে। আমাদের অফিসেও পাতাবন
আছে। অনেক পাতাগাছ আছে। একদিন এসো কোনোদিন বৃষ্টি নামলে। আকাশ বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়বে
সবুজ ঘ্রাণের দেশে। সেই ঘ্রাণ ভেঙে খেতে দেবো।
আমার প্রায়ই মনে হয়
কোনো পরিণতি নেই এই জীবনে। চলছে তো চলছেই। আর রোগ শোক, যাতনা বাড়ছে। খুবই বিবমিষা
লাগে। এমন বিতৃষ্ণার ভার বইবার ক্ষমতা কারো নেই। এমন অনেক জীবন আছে আর শেষ হয় না।
নিজামভাই বলে, তোর লেখায় এতো রিপিটেশন কেনো? আমি বলি, আমি পাতার শিরায় লিখে রেখেছি
যা আছে পরম্পরা।
একদিন তুমি আমাকে ডেকে
বললে, এবার যদি আমি ফিরে আসি তবে ডুমুরের ফুল হয়ে আসবো। আমি বললাম, তুমি এসো না
আর। সেই কথা মনে হয়, তুমি প্রতিদিন চলে যাওয়ার পর। তুমি চলে গেলে। আজও বলি, তুমি
এসো না আর। আমিই আগুন হয়ে আসবো কোনোদিন তোমার জতুগৃহে।
আমি তো কিছু নই। তবু
সঘন স্পর্শের সাক্ষি হয়ে ঝরে পড়বে না জেনে একটি অজানিত পালক ঝড়ের টানে উড়ে যাবে।
অদূরে চা-পাতার বনে মাতাল ময়ূর। শব্দচূর্ণ দিন বসে গুনে সমুখের নতজানু খোঁপা।
খোঁপায় দুইলক্ষ চুল আর দুইটি টগর অবরোহী পথেই হবে চতুর ফেরারী। সৈকত দে বলল, দাদা
আপনি পাহাড়ে বা বনে গেলে সেদিকেই যেতে থাকেন, সমুদ্রে গেলে সমুদ্রেই কেবল। এই বলে
সে একটা ম্যাগনোলিয়ার ঝাড়ের সঙ্গে নাচলো ঝড়ের ভিতর। আর শ্রীমতি তুমি তোমার ঘরের
ছয়দিগন্তে চোখ রেখে প্রজাপতি মন্ত্র হয়ে গেলে।
শ্রীমতি আসো, রং খাও।
শেষ করো সমস্ত টিউব। রং শেষ হলে রক্ত আছে। আসো, রক্ত খাও। রক্তশেষে উড়াল আছে। আসো,
এসে উড়ে চলে যাও। আসো, রঙের বাড়ি। আসো, কানফুল ভুল। আসো, নাকছাবি, হলুদ বনে বনে।
আসো, সবুজ উত্তরীয়। আসো শাদাকাগজ। আসো, কালি ও কলঙ্ক। এইখানে কালিকাপুরাণ হলুদ হয়ে
আছে যেমন কোনোদিন দোলপূর্ণিমায় চুরি করে দেখে ফেলা তোমার মুখ আমি একদিনও ভুলতে
পারি না।
একদিন রাজীব দত্ত এঁকে
ফেলে মহিষের মুখ। কোনোদিন আমি লিখে ফেলি মহিষের হাসি। তারপর শহরে মহিষ নামে,
মহিষের গায়ে জড়ানো শ্রাবণের ধূসর আকাশ। আকাশের কাদারাঙা হাত শ্রীমতি তোমার পায়ে
পরিয়ে দেয় অলক্তরাগ আর কপালে বাদামি তিলক। এই তিলক তোমার সিঁথিকে ছুঁয়ে দিলে তুমি
পুনর্বার ফিরে যাবে, মনে মনে নিয়ত যেখানে ফেরো।
No comments:
Post a Comment