25 January 2017

মনোজিৎকুমার দাস




সলিল চৌধুরী: সাংগীতিক ধারার গণসঙ্গীতের পথিকৃৎ
সলিল চৌধুরীর জন্ম: ১৯ নভেম্বর ১৯২৩   মৃত্যু: ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৫

গত শতকের চল্লিশ দশকে স্বদেশিকতা আন্তর্জাতিক আবহে সৃজনশীল বাংলা গণসঙ্গীতের জন্ম। প্রখ্যাত গণসঙ্গীতকার হেমাঙ্গ বিশাসের ভাষায়, স্বদেশিকতা ধারা যেখানে সর্বহারার আন্তর্জাতিকতার মহাসাগরে গিয়ে মিলেছে সেই মোহনায় গণসঙ্গীতের জন্ম।    
স্বদেশীগানের  উত্তরসূরী হিসাবে চল্লিশ দশকের পরাধীন ভারতবর্ষে একদল গণসঙ্গীতকার ও গায়ক ঐকান্তিক সাধনার ফসল চল্লিশের বাংলা গণ সঙ্গীত স্বদেশী গানের  উত্তরসূরী হিসাবে অনেক চড়াই - উৎরাই পেরিয়ে এক সময় নতুন অনুষঙ্গের সাঙ্গীতিক ধারার বাংলা গণগঙ্গীতের উদ্ভব ঘটে। চল্লিশ দশকের প্রারম্ভিককালের সৃজনশীল ধারার গণসঙ্গীত এক পর্যায়ে উপমহাদেশের বাংলা গানের প্রখ্যাত গীতিকার ও সুরকার সলিল চৌধুরীর (১৯২৩-১৯৯৫) হাতে পড়ে নতুন রূপ নেয়। তিনি নতুন ধারার গণসঙ্গীত রচনা করেই বসে থাকেননি, তাঁর রচিত গণসঙ্গীতে আসর বসিয়ে একের পর এক অনুষ্ঠান করে স্বকন্ঠে গান গেয়ে সাংগীতিক ধারার গণসঙ্গীতকে জনপ্রিয় করে তোলেন।  সাংগীতিক ধারার গণসঙ্গীতের পথিকৃত হিসাবে সলিল চৌধুরীর অবদানকে এ নিবন্ধে উপস্থাপন করার আগে চল্লিশ দশকের বাংলা  গণসঙ্গীতকের জন্মলগ্নের ইতিহাস অবশ্যই তুলে ধরা প্রয়োজন। কোন অনুষঙ্গে , কাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় স্বদেশী গানের হাত ধরে বাংলা গণসঙ্গীতের উদ্ভব ঘটে অবশ্যই জানা দরকার। 
চল্লিশ দশকের সূচনাকালের গণসঙ্গীতকে রচয়িতা ও গায়ক রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলাম, অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত , দ্বিজেন্দ্রলাল রায় দেশাত্ববোধক গানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে পরিচিত ছিলেন । বরিশালের চারণ কবি মুকুন্দ দাসের স্বদেশী গান চল্লিশের দশকের প্রথম দিকে সঙ্গীতরচয়িতাদের গণসঙ্গীত রচনায় অনুপ্রাণিত করে ।  রবীন্দ্রনাথের ‘একবার তোরা মা বলিয়া ’, নজরুলের ‘ বল ভাই , মাকে’, অতুলপ্রসাদের ‘ বল বল বল সবে ,’ রজনীকান্তের ‘ মায়ের দেয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই’ এবং মুকুন্দ দাসের ‘ মরা গাঙে বান ডেকেছে বাইতে হবে নাও, তোমরা এখনো ঘুমাও’ প্রভৃতি উদ্দীপনাময গানে পরাধীন ভারতবর্ষে ইংরেজদের শাসন -শোষণের গ্লানি ও অত্যাচার থেকে মুক্তির আকাঙ্খা ব্যক্ত হয়েছে। গানগুলোর কথা ও সুরে গণমানুষের হৃদয়ে ছোঁয়া অভিব্যক্তি প্রকাশ পাওয়ার ফলে তা গণমুখীনতা লাভ করতে সক্ষম হয়। গানের হৃদয়স্পর্শী কথা ও সুরের কারণে গণমানুষের কন্ঠে কন্ঠে গান কীভাবে সদা গীত হতে পারে, তার উজ্জ্বল এক দৃষ্টান্ত এখানে তুলে ধরা যেতে পারে। জনপ্রিয়  গণসঙ্গীতের প্রাসঙ্গিকতা বোঝানোর জন্যে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম শহীদ ক্ষুদিরাম ।১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট স্বাধীনতা মন্ত্রে দীক্ষিত ক্ষুদিরামের ফাঁসির পর সদ্য কিশোররোত্তীর্ণ তরুণের আত্মত্যাগের আদর্শ ও বেদনাকে গণ মানুষের মনে ভাস্বর করে রাখার জন্যে  লোক-গীতিকার পিতাম্বর দাস  ‘ একবার  বিদায়  দে মা ঘুরে আসি’ গানটি রচনা করে তাতে সরল লৌকিক ‘ ঝুমুর’ বাউল জাতীয় সুরারোপ করেন। অত্যন্ত  সরল সুর ও মর্মস্পশী কাহিনি গানের কথায় ব্যক্ত  হওয়ায় ওই গানটি সবৃজনের কন্ঠে গীত হতে থাকে। গানটির সর্বজন গ্রহ্যতা থাকায় নাগরিক জীবন থেকে গ্রামীণ জীবন পর্যন্ত ব্যাপকভাবে তা প্রচারিত হয় এবং সর্বকালীন জনপ্রিয়তা লাভ করতে সক্ষম হয় । 

এ গানটি আজও সমানভাবে গণমানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে আছে। এ কারণে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম বলি শহীদ ক্ষুদিরামের আত্মত্যাগের স্মরণে রচিত জনপ্রিয় গানটি অবশ্যই গণসঙ্গীতের প্রথম পর্যায়ের গণমুখী গান হিসাবে বিবেচিত হবার দাবি রাখে।
বাংলা গণসঙ্গীতের প্রতিষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৪৩ সালে কলকাতায় ভারতীয় গননাট্য সংঘের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। চল্লিশ দশকের বাংলায় গণসঙ্গীত আন্দোলনের সূত্রপাতটি একটা বৃহত্তর সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অঙ্গ। প্রখ্যাত লেখক অনুরাধা রায়ের ভাষায়, শুধু গানে নয়, শিল্প সাহিত্যের নানা ক্ষেত্রেই চল্লিশ দশকে বেশ একটু লক্ষণীয় বিকাশ ঘটেছিল, যাকে সাধারণত বলা হয় মার্কসীয় সাংস্কৃতিক আন্দোলন। সে যুগের অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টিই এই আন্দোলনের সাংগঠনিক ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিল।’ ১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়  সর্বভারতীয় প্রগতি লেখক সংঘ , ১৯৪২ সালে ফ্যাসিবাদ বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ এবং ১৯৪৩ সালে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ। প্রত্যেকটি সংঘই অল্প – বিস্তার সাংস্কৃতিক চর্চার উদ্যোগী হয়। শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার মার্কসবাদী প্রত্যয় নিয়ে একদল লেখক ও গায়কের রচিত ও গীত নতুন ধারার দেশাত্মাবোধক গান গণসঙ্গীত হিসাবে পরিচিতি পায়। ১৯৪৩ সালে লেখক ও শিল্পী সংঘ প্রকাশ করে ‘ জনযুদ্ধের গান ’ নামে একটি বই। প্রথম সারির গণসঙ্গীতকার হিসাবে যারা আত্মপ্রকাশ করেন তাদের মধ্যে ছিলেন বিনয় রায়, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, হেমাঙ্গ বিশ্বাস প্রমুখ। অন্যদিকে, প্রথমেই গণসঙ্গীতের সুগায়ক হিসাবে যার নাম করতে হয় তিনি হলেন গণনাট্য সংঘের গায়িকা প্রীতি বন্দ্যোপাধ্যায়।
বাংলায় গণসঙ্গীতের সৃষ্টি ও প্রসারের উন্মেষলগ্নের কথা বলতে গিয়ে অবশ্য এখানে গণনাট্য আন্দোলনের কয়েকজন পুরোধার স্মৃতিকথা থেকে উদ্ধৃতি দিলে বাংলার গণসঙ্গীত আন্দোলন সম্পর্কে একটা ধারণা জন্মাবে। প্রথম গণনাট্য সংঘের অন্যতম পুরোধা জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র আত্মস্মৃতি কথা থেকে: ‘  এমন সময় পাশের বাড়িতে অত্যন্ত উন্নত বলিষ্ঠ কন্ঠে কে গেয়ে উঠল -- ঐ আইসে বুঝি হামারা টারীতে evi¨vZ  গাওয়ের গেরিল্লা জুয়ান, ওটা শুনে আমাদের তকর্ববিতর্ক বন্ধ হয়ে গেল। উৎকর্ণ হয়ে গান শনছিলাম। তারপর  সেই আশ্চর্য কন্ঠে ধরল আরো একটা গান-- তোমার কাস্তেটারে জোরে দিও শান কৃষাণ ভাইরে। আমাদের গান কোন রাস্তা ধরে কীভাবে যেতে পারে তার ইঙ্গিত পেলাম।’ অনুরাধা রায়ের চল্লিশ দশকের বাংলা গণসঙ্গীত আন্দোলন বই থেকে জানা যায় পাশের বাড়ির গায়কটি হলেন বিনয় রায়। প্রথম গানটি তাঁর নিজের রচনা, দ্বীয় গানটির রচয়িতা হেমাঙ্গ বিশ্বাস।
বাংলা গণসঙ্গীত আন্দোলনের অন্যতম তিন পুরোধা কুষ্টিয়ার জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, রংপুরের বিনয় রায়, সিলেটের হেমাঙ্গ বিশ্বাস গণসঙ্গীত আন্দোলনের টানে কলকাতার এক জায়গায় মিলিত হন। বাংলা গণসঙ্গীতের প্রসারে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়।  প্রবাদ প্রতিম  গণসঙ্গীতকার হেমাঙ্গ বিশ্বাস সিলেট জেলার এক জমিদারের ছেলে । তাঁর জািবনের প্রথমটা সিলেটেই কাটে। সিলেটে থাকাকালে তিনি সুর ও কথায় স্পষ্ট নজরুলি ছাপ নিযে লিখেছিলেন,‘ আগে চল আগে চল মজুর – কিষাণ সমর শিবিরে শোন হাকিছে বিষাণ।’ এখন আমাদের এ নিবন্ধের মূলপ্রতিপাদ্য বিষয়ে প্রতি আলোকপাত করা যেতে পারে। সলিল চৌধুরী সঙ্গীতজগতের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র- একাধারে বিপ্লবী কবি, লেখক, গায়ক, বাদক, সুরকার তথা সাঙ্গীতিক ধারার গণসঙ্গীতের চারণগীতিকার ও গায়ক।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর চল্লিশের দশকের সঙ্গীত জগতের  উজ্জ্বলতম নক্ষত্রটি পুর্বোক্ত গণসঙ্গীতকার ও গায়কদের উত্তরসূরী হিসাবে নিজেকে চল্লিশ দশকের গণসঙ্গীত আওেন্দালনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেন। খ্যাতিমান কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও এ সময়ে গণসঙ্গীতের আদলে তাঁর কবিতা লিখতে শুরু করেন এবং গণসঙ্গীত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন।
আরেকজন ভারতীয় সঙ্গীত জগতের প্রখ্যাত ব্যক্তি নৌশাদ তাঁর স্মৃতিচারণায় সলিল চৌধুরী সম্বন্ধে বলেন- ‘ তাঁর সঙ্গীতের মাধ্যমেই তাকে আমি চিনতাম, আর ওই সঙ্গীতের ভেতর দিয়েই তাঁকে আমি হৃদয়ঙ্গম করতে পারতুম। সলিলবাবু ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য এবং প্রবল ভাবে সামবাদী আদর্শে বিশ্বাসী । তিনি বাংলা লোকশিল্পের প্রচার ও প্রসারে ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ।নৌশাদের কথার অনুরণন আমরা লক্ষ করি তাঁর সাম্যবাদী আদর্শে লেখা গানগুলো থেকে। মূলত ব্রিটিশ শাসন- শোষণের বিরুদ্ধে সাম্যবাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত অভিযাত্রীরা গানের মাধ্যমে জাগরণ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসেন। চল্লিশের দশকের অভিযাত্রীরা সর্বপ্রথম রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলাম, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, দ্বিজেন্দ্রলাল প্রমুখ কবিদের দেশাত্মবোধক গান কন্ঠে ধারণ করে চারণের বেশে এক শহর থেকে অন্য শহরে বিচরণ করে জনতার উদ্দেশ্যে গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন। প্রসঙ্গক্রমে দু’একটি দৃষ্টান্ত এখানে তুলে ধরবো এ কথার যথার্থতা প্রমাণের জন্য। 
গণনাট্য সংঘের সুগায়িকা প্রীতি বন্দোপাধ্যায় বলেন যে তিনি যখন রাজশাহী স্কুলের ছাত্রী তখন প্রভাত ফেরিতে যোগ দিয়ে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ ধনধান্য পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’ গানটি গাইতেন। একদিন হাতে পেলেন বিনয় রায়ের লেখা গণসঙ্গীত ‘ জাগো ভারত বাসী আর কত ঘুমাবে?’ গণসঙ্গীত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত গণনাট্য সংঘের সদস্যদের মধ্যে প্রথমদিকে যারা ছিলেন, বলতে গেলে তাদের কেউই লেখক, কবি,গীতিকার কিংবা সুরকার ছিলেন না।

 তবে জ্যেতিন্দ্রনাথ মৈত্র, বিনয় রায, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কথা আলাদা। তাঁরা ছিলেন অবশ্যই অনন্য প্রতিভায় দেদীপ্যামান। গবেষকদের মতে তারা গণসঙ্গীত আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত না তেকে যদি শুধুমাত্র গানের জগতে আসতেন তবুও নি:সন্দেহে স্বক্ষেত্রে তাঁরা প্রতিবার স্বাক্ষর রাখতে পারতেন। গণসঙ্গীতে সাঙ্গীতিক ধারার অনুষঙ্গ বোঝানোর জন্য বলতে হয় ভারতীয গণ নাট্য সংঘের  সদ¯্র ও সদস্যদের মধ্যে যে সব সঙ্গীতকার গণসঙ্গীত আন্দোলনকে গণমানুষের দরবারে পৌঁছে দেবার জন্য সঙ্গীত রচনা করেন, তার মধ্যে সাংবাদের চেতনসা জাগরণের কথা কিংবা শোষকের উৎপীড়ন, শোষিতের আহাজারি অবশ্যই ছিল, তবুঙ্গীত বোদ্ধাদের মতে ওই সব গণসঙ্গীতকার রচনায় ও সুরে ছিল কিছু একটার অভাব ছিল। সেই অভাব হচ্ছে সাঙ্গীতিক ধারার । সঙ্গীতজগতে প্রবাদপ্রতীম গীতিকার ,সুরকার তথা গায়ক সলিল চৌধুরী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে সাম্যবাদী আদর্শের সঙ্গে সংযুক্তির পর গণসঙ্গীত রচনা , সুরারোপ এবং গায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে  বাংলা গণসঙ্গীতের সাঙ্গীতিক ধারা সূচনা করেন। সলিল চৌধুরীর প্রধান গুণাবলীর মধ্যে ছিল প্রধান তিনটি বৈশিষ্ট্য। তিনি নিজেই গীতিকার ও সঙ্গীত রচয়িতা সুরকার ও গায়ক । সঙ্গীত জগতের সমস্ত অনুষঙ্গের সবাবেশ একটা মানুষের মধ্যে থাকায তিনি রচনা করতে পেরেছিলেন , ‘ও আলোর পথযাত্রী ’ ‘ বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারাআজ জেগেছে এই জনতা’,‘নওজোয়ান ,নওজোয়ান’, এর মতো গণসঙ্গীত । সলিল চৌধুরী গণসঙ্গীতে নতুনধারার অনুষঙ্গ বিশেষ ভাবে বর্তমান রেখে তার সঙ্গীতকে নতুন মাত্রা দান করেন। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করার আগে কাজী নজরুল ইসলামের দেশাত্মবোধক গান , যা প্রথম পর্যায়ে ও গণসঙ্গীতের মাত্রা দান করেন।এ প্রসঙ্গে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করার আগে কাজী নজরুল ইসলামকে বলা যেতে পারে  গণসঙ্গীত আন্দোলনের প্রথম গীতিকার ।‘কৃষকের গান ’‘শ্রমিকের গান’বলশোভিক বিপ্লবের প্রতি কাজী নজরুল ইসলামের অভিনন্দন ‘ঐ নতুনের কেতন ওড়ে কালবৈশাখীর ঝড় তোরা সব জয়ধ্বনি কর।’ অনবদ্য নজরুলের অনেকগুলো গানকে গণসঙ্গীতের পর্যায় ভূক্ত করা যায়।  কলকাতার অমর মুখোপাধ্যায় ও যশোরের রবি মজুমদারের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নজরুল ইসলামের বাছ্ই করা কিছু দেশাত্মবোধক গান কলকাতা ও যশোরের কৃষক শ্রমিক সভায় গীত হলে ওই গানগুলো ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠে ।নজরুলের ওই গানগুলো মধ্যে ‘ওঠ রে চাষি জগৎবাসী ধর কষে লাঙ্গল’গানটি ছিল অন্যতম ।কাজি নজরুল ইসলাম একাধারেকবি সুরকার গায়ক হওয়ায় এবং তাঁর লেখা গানে স্বদেশপ্রম   বর্তমান থাকায় গানগুলো বিশেষভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করে ।এক্ষেত্রে সাঙ্গীতিক ধারার  দেশত্মবোধক গানের পূর্বসূরী হিসাবে চিহ্নিত করা যায় ।নজরুল ইসলামের দেশাত্মবোধক গানগুলো গণসঙ্গীত আন্দোলনের যাত্রার পূর্বে রচিত হলেও ওই অনুষঙ্গে রচিত গানগুলো দেশাত্মবোধক গানের পর্যায়ভুক্ত করতে হয়। সলিল চৌধুরী প্রথমে গণসঙ্গীতের মাধ্যমে , পরে উল্লেখযোগ্য সংখক আধুনিক গান ও বাংলা ছায়াছবির সঙ্গীতের সঙ্গীতকার এবং সুরকার হিসাবে সঙ্গীত জগতে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। হিন্দি ছাযাছবির প্রখ্রাত গীতিকারদের অত্যন্ত জনপ্রিয় হিন্দি গানের সুরও দেন তিনি। গিিতকার হিসাবে সলিল চৌধুরী  যেমন মৌলিকতার ছাপ রাখেন, ঠিক তেমনই সুর সৃষ্টিতে তা বহাল রাখতে সক্ষম হন। তাঁর নিজের সৃষ্ট  গানে যে সুরের ধারা লক্ষ করা যায় তার মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী উপাদান ছিল পাশ্চাত্য সঙ্গীত।


সলিল চৌধরিীর জন্ম সাঙ্গীতিক পরিমন্ডলে। তিনি তাঁর পিতার লোকসঙ্গীতের রেকডগুলো শুনেতে শুনতে বড় হয়েছিলেন। পশ্চিমী লোকসঙ্গীতের রেকর্ডের মধ্যে ছিল মিসকার অর্কেস্ট্রা ও নিগ্রো স্পিরিচুয়ালের মতো গান বাজনা। ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সঙ্গে সম্পৃপ্ত হওয়ায় ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের লোকগীতির সঙ্গেও তাঁর পরিচয় ঘটে। তিনি তালিম নেন ভারতীয়ঢ ক্লাসিক্যাল গানে। তিনি নিজের লেখা গণসঙ্গীতে নতুন দারার সাঙ্গীতিক অনুসঙ্গের অবতারণা করেন। ‘ আলোর পথযাত্রী’( ১৯৪৯), ‘ হাতে মোদের কে দেবে’(১৯৪৯), জন্মভুমি” (১৯৫১), ‘শান্তির গান’( ১৯৫১), ‘ ঢেউ উঠছে কারা টুটেছে’, হেই সামলো’ প্রভৃতি গণসঙ্গীত সলিল চৌধুরীর কথা ও সুরে ভারতীয় গলনাট্য সংঘের শিল্পীদের কোরাস কন্ঠে গীত হয সর্বপ্রথম। সলিল চৌধুরীর লেখা ও সুর দেওয়া ‘ টেউ উটেছে , কারা টুটেছে’ গানটিতে যে সুরের তাল লয়ের সম্মিলন তিনি ঘটান তাতে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের প্রভাব বিশেষ ভাবে ফুটে ওঠে।
সঙ্গীত গবেষকদের মতে,কোরাস বা সমবেত সঙ্গীত আগে গাওয়া হত বা একতানে, সলিল চৌধুরীই প্রথম সমবেত সঙ্গীতে অর্কেস্ট্রার ব্যবহার করে অপূর্ব ছন্দ লয়ের সমন্বয় ঘটিয়ে অনন্য ধারার সাঙ্গীতিক আবহ সৃষ্টি করেন। ভারতীয় গণনাট্য সংঘের অন্যতম কন্ঠশিল্পী হিসাবে সলিল চৌধুরী নিজে অন্যান্য  শিল্পীর সঙ্গে  সম্মিলিত ভাবে ঢেউ উঠছে , কারা টুটছে’ গানটি  সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে গেয়ে  আসর মাত করে দেন। গণসংগীতের গতানুতিক ধারা থেকে বেরিয়ে এসে তিনি এই গানটি এমনভাবে পরিবেশন করেন যা থেকে হাজার জনতার কুজকাওয়াজ যেন আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হয় । সলিল চৌধুরী  ১৯৪৬ থেকে ১৯৫০সাল পর্যন্ত নিজের লেখা নিজের সুরে ভারতের শহর , বন্দর ও গ্রামগঞ্জে গণসঙ্গীত গেয়ে বেড়িয়েছেন।
সলিল চৌধুরী যে গণসঙ্গীতের  অন্যতম পথিকৃত একথার প্রমাণ রাখতে হলে তাঁর রচিত ,সুরারোপিত ও স্বকন্ঠে গাওয়া অতি জনপ্রিয় ‘ ও আলোর পথযাত্রী’, ‘ বিচারপতি , তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে এই জনতা’ ও ‘ নওজোয়ান, নওজোয়ান’ যে কয়েকটি গণসঙ্গীতের কথা আগে বলা হয়েছে , সেগুলোর কথা আবারও বলতে হয়।তাঁর গণসঙ্গীতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়। বাংলাদেশের অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলোসহ মুক্তিযুদ্ধে এই গানটি বাংলাদেশের সর্বত্র বিশেষভাবে সমাদৃত হয়।ওই দিন গুলোতে হাজার হাজার জনমানুষের সামনে ওই গানটি যখন সমবেত কন্ঠে  গাওয়া হত তখন মুক্তিকামী হাজারো মানুষের মনে উদ্দীপনার সৃষ্টি করত  গণসঙ্গীত  আন্দোলনের প্রথম যুগের কমউনিস্ট ভাবাদর্শে চালিত গণসঙ্গীতকার দের রচিত গণসঙ্গীতের কথা ও সুরে ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে  শানিত অনুষঙ্গের প্রাধান্য ছিল লক্ষণীয়ভাবে উপস্থিত। সলিল চৌধুরীই  তাঁর রচিত সুরারোপিত গণসঙ্গীতের কথাও সুরে শানিত অনুষঙ্গের সঙ্গে  রোমান্টিকতাকে যুক্ত করেন অপূর্ব মাত্রায়।দ্বিতীয় মহাযুদ্ধত্তর দুর্ভিক্ষ ভারতের বিশেষ করে  বাংলার গণমানুষের জীবনে চরম ভোগান্তির সৃষ্টি করে। অভাব অনটনের কারণে মানবীর শাশ্বত  প্রেম ভালোবাসা শূণ্যে মিলিয়ে যায়।এই প্রেক্ষিত মাথায় রেখে প্রবাদপ্রতিম সঙ্গীতকার সুর¯্রষ্টা ও গায়ক সলিল চৌধুরী যে সাঙ্গীতিক ধারার গণসঙ্গীত  রচনা করেন তার কয়েকটি পঙ্ক্তির উদ্ধৃতি এখানে না দিলেই নয়;‘আজ যতদূর যাই আছে শুধু ক্ষুদিত জনতা। প্রেম নেই প্রিয়া নেই। আপনার ঘরে আছি মোরা পরবাসী,উপবাসী প্রিয়া ফোটে না হাসি।সুপ্রিয় পাঠক,এ থেকে অনুধাবন করবেন, নতুন ধারার সাঙ্গীতিক অনুষঙ্গের পথিকৃত কি না।চল্লিশের দশকের গণসঙ্গীতের অন্যতম পুরোধা হেমাঙ্গ বিশ্বাস এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেন, ‘সলিল চৌধুরী তার সৃষ্ট গণসঙ্গীতে সাঙ্গীতিক দিকে খুবই নজর দিয়েছিলেন।’১৯৪৭ সালের আগস্টে বহু আকাক্সিক্ষত স্বাধীনতা এল ভারতবর্ষ ভাগের মাধ্যমে।ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা বললেন ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’। কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হল।স্বাধীনতার ভোগান্তি হিসাবে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে হাজার হাজার মানুষ রাতারাতি ছিন্নমূল হয়ে গেল । চল্লিশের দশকের গণসঙ্গীত আন্দোলনের পুরোধারা তাদের কলম ও কন্ঠে দেশভাগের অশুভ কলঙ্কের অনুরণন প্রকাশ করলেন জ্বালা বেদনা ও ব্যাঙ্গাত্মক গানের মাধ্যমে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ও স্বাধীনতাপরবর্তী কালে এক সময় গণসংগ্রামের তীব্রতা স্তিমিত হয়ে গেল। ফলে গণসঙ্গীতের উগ্রতাও কমেযেতে শুরু করল। গণসঙ্গীতের  কথা সুর ও গায়কী ভঙ্গিমায় যে জঙ্গী আবহ বর্তমান ছিল তার মাত্র নিন্মগ্রামে নেমে  এল ।পঞ্চাশের দশকের প্রথম থেকে বিশ্বজুড়ে  শুরু হল  শান্তির বাতাবরণ রচনা প্রত্যয়। শান্তির বাতাবরণ রচনা অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে এল কমিউনিস্ট ও সাম্যবাদী ভাবাদর্শের একদল মানুষ।শান্তি আন্দোলনের পক্ষে বিশিষ্ট এই গীতিকার রচনা করলেন একের পর এক মনোমুগ্ধকর গান।  উপমহাদেশের সুকন্ঠী গায়িকা সন্ধ্যা মুখার্জী মধুঝরা ললিত কন্ঠে গীত হল,‘ উজ্জ্বল এক ঝাক পায়রা সূর্যের চঞ্চল পাখনায় উড়ছে নীল নীল ঘন নীল অম্বর।’ এ গান  অন্যমাত্রায় গণসঙ্গীত কিনা বিবেচ্য। সলিল চৌধুরী কিন্তু থেমে থাকেননি। তিনি শান্তির অনুষঙ্গের রচনা করেন তাতে শান্তির অন্বেষণ থাকলেও তার গানের জঙ্গী সুরের অনুরণন ছিল বিশেষভাবে প্রকট । এ পর্যায়ে অনন্যসাধারণ একটি গানের কয়েক পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করলে বোঝা যাবে সলিল চৌধুরির গানের গীতিময় :‘যখন প্রশ্ন ওঠে ধ্বংস কি সৃষ্টি আমাদের চোখের জলে আহতদের দৃষ্টি। আমরা জবাব দিই সৃষ্টি সৃষ্টি সৃষ্টি ’।সলিল চৌধুরির নতুন ধারার আঙ্গিক বৈশিষ্ট্যের গণসঙ্গীত সম্পর্কে সমালোচনার ঝড় উঠলেও তা ধোপে টেকেনি ।গণসঙ্গীতের অন্যতম স্রষ্টা হেমাঙ্গ বিশ্বাসও প্রথম দিকে সলিল চৌধুরির সমালোচনা করতে দ্বিধা করেননি ।কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি নিজেই স্বীকার করেন যে,‘লোকগীতির বাইরে নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষাও কিন্তু সার্থক গণসঙ্গীতের জন্ম দিতে পারে ।সলিল চৌধুরীর কোন কোন গান তার দৃষ্টান্ত’। এ থেকে প্রমাণিত হয় সলিল চৌধুরী গণসঙ্গীতের নতুন ধারার অমর স্রষ্টা ।আধুনিক আঙ্গিকের গানে তিনি অর্কেস্ট্রিয়ান হারমোনাইজেশন ঘটিয়ে পাশ্চাত্য ও বাংলার লৌকিক আঙ্গিকের মেলবন্ধন ঘটিয়ে সাধারণ জনমানবের দরবারে উপস্থাপন করে তাঁর নিজস্ব ঘরানার দৃষ্টান্ত রাখতে সক্ষম হয়েছেন ।পরে আরো উদাহরণ তুলে ধরার চেষ্টা করব ।সলিল চৌধুরীর নিজের লেখা গান ছাড়াও কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘অবাক পৃথিবী ’,‘রানার’ প্রভৃতি কবিতায়   সুরারোপ করে বিভিন্ন জনসভায় স্বকন্ঠে গেয়ে ওই গানগুলোকে গণসঙ্গীতের পর্যায়ে উন্নীত করতে সক্ষম হন । এখানে প্রসঙ্গক্রমে একটা ঘটনার কথা তুলে ধরা যেতে পারে । সলিল চৌধুরী  ১৯৪৬ সালে ডাক ও  তার বিভাগের  ধর্মঘটের পরিপ্রেক্ষিতে লেখা সুকান্তের ‘রানার’ কবিতায় সুরারোপ উপমহাদেশের প্রবাদপ্রতিম স্বর্ণকন্ঠের অধিকারি গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যয়ে কন্ঠে গণসঙ্গীতের আদালতে গাইয়ে জনপ্রিয় করে তোলেন । আধুনিক আঙ্গিকের গানও যে গণমানুষের প্রানের সঙ্গীত হতে পারে তার নজির সৃষ্টি করেন সলিল চোধুরী। এ প্রসঙ্গে তাঁর নিজের লেখা ‘গাঁয়ের বধূ’র আশা স্বপনের সমাধির কাহিনী নতুন ধারা বলতে গেলে গণসঙ্গীতের  রুপ লাভ করে পাশ্চত্য প্রভাবিত সুরও ভারতীয় ভৈরবী রাগিনীর মেলবন্ধনে আর হেমন্তের মধুঝরা কন্ঠের মধুময়তা । যে গান মানুষের মানসপটে সদাভাস্বর তা অবশ্যই গণসঙ্গীতের পর্যায়ভুক্ত একথা স্মরণে রেখেই সলিল চৌধুরী ছান্দসিক কবি সত্যেক দত্তের পালকি গানে সুরারোপ কর এক অপূর্ব লৌকিক সুরে হেমন্তের সুলরিত কন্ঠে  রেকর্ড করেন যা আজও শ্রোতাদেরকে সমানভাবে মন্ত্রমুগ্ধ করে সঙ্গীত গবেষকদের মতে,পঞ্চাশের মন্বন্তরের অভিজ্ঞতা থেকে সরির চৌধুরীর উল্লিখিত গায়ের বধূর আশা স্বপনের সমাধির গান , পালকির গান ,রানার , অবাক পৃথিবী গানগুলো চল্লিশের দশকের শেষ বা পঞ্চাশের গোড়ায় সৃষ্ট চল্লিশের গণসঙ্গীত আন্দোলনের সুপরিণত ফসল ।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সলিল চৌধুরী নতুন ধারার গণসঙ্গীত সম্পর্কে নিজে কি বলেছেন তা এখানে পাঠকের উদ্দেশ্যে উদ্ধৃত করা যেতে পারে ।সলিল চৌধুরী বলেন যে আঙ্গিকের তাগিদে এই ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়নি , নতুন দিনের নতুন বক্তব্য প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন তিনি নতুনধারার স্মরণীয় সুরসৃষ্টির মাধ্যমে।নতুনধারার গীতিময়তা সৃষ্টির  উদ্দেশ্যে তার বিখ্যাত ‘হেই সামালো ধান হো’ গণসঙ্গীতে লৌকিক সুরের অনুষঙ্গের অবতারণা করেছেন নিজস্ব সৃষ্টিশীলতার দ্বারা । ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ লেগেছে এই জনতা ’এই গণসঙ্গীতটিতে যে সাঙ্গীতিক ধারা ব্যবহার করেছন তাতে কীর্তনের সুর ভেঙ্গে তার গীতিধর্মিতাকে একেবারে বরবাদ করে সম্পূর্ণ স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে গানটি  উপস্থাপন  করেছেন ।কথা আর সুরের মর্মস্পর্শী বাধঁনে এ গানটি সত্যি  সত্যি গণসঙ্গীতের মযার্দালাভ সক্ষম হয়েছে ,তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ভারতীয় গণনাট্য সংঘের গণসঙ্গীত আন্দোলনের চল্লিশ দশকের শেষ পূর্বে অর্থাৎ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পূর্বে সলিল চৌধুরীর আবির্ভাব গণসঙ্গীতের জগতে । ১৯৪৭ সালের পূর্বে পরাধীন ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে রচিত সলিল চৌধুরীর রচিত সুরারোপিত ও গীত‘সুর উঠছে কারা টুটছে আলো ফুটছে প্রাণ জাগছে ’কিংবা ১৯৪৬ সালে সুন্দরবন অঞ্চলে ও উত্তরবঙ্গের তেভাগা আন্দোলনের   মেজাজে তার রচিত সুরারোপিত ‘হেই সামালো হেই সামালো !’ গনসঙ্গীতের মাধ্যমেও তিনি নতুন আঙ্গিক  বৈশিষ্ট্যের সঙ্গীত ধারার সৃজনপ্রয়াসী হন ।ভরতভাগের পরও শোষন শাসন আর উৎপীড়ন থেমে থাকেনি ।ফলে তিনি গণসঙ্গীতের জগত থেকে দূরে সরে যেতে পারেননি তঁর চরিত্রের সাম্যবাদী ভাবাদর্শের কারণে। পরবর্তীকালে তিনি বাংলা ও হিন্দি ভাষার আধুনিক ও ছায়াছবি গানের বৃহত্তর পরিমন্ডলের সঙ্গে নিজেকে বিশেষভাবে সম্পৃক্ত করেন স্বকীয় ও পারিবারিক সাঙ্গীতিক পরিমন্ডলের কারনে কিন্তু তাই বলে তিনি কখনই গনসঙ্গীতের পরিমন্ডল থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেননি । তার সহধর্মিণী সুগায়িকা সবিতা চৌধুরী ও আতœজা  অন্তরা চৌধুরীও সঙ্গীতবলয়ের মধ্যে থেকে তাঁরই কথাও সুরে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গণসঙ্গীতধর্মী গান কন্ঠে ধারণ করে জনপ্রিয় হয়েছেন । শিশু শিল্পী হিসাবে তার কন্যা  অন্তরা চৌধুরীর গানের জগতে প্রবেশ । অন্তরা চৌধুরী প্রথমে  শিশু শিল্পী হিসাবে ছড়ার গানের মাধ্যমে সঙ্গীত জগতে আতœপ্রকাশ করলেও সেই  ছড়াগানের মধ্যে গণমানুষের প্রাণের কথার অনুরণন লক্ষ্য করার মত। অন্তরা চৌধুরীর কন্ঠেই  প্রথম গীত হয়েছিল সদ্য প্রয়াত সুসাহিত্যিক  ওছড়াকার অন্নদাশংকর রায়ের বিখ্যাত সেই ছড়াটি-‘তেলের শিশির ভাঙ্গলো বলে শিশুর উপর রাগ করো  তোমরাা সবাই বুড়ো খোকা ভারত ভেঙ্গে ভাগ করো।’
একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে । অন্তরা চৌধুরী তাঁর পিতার সুযোগ্য উত্তরসুরী। দেশকালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেসারা বিশ্বে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু গণসঙ্গীতের গ্রহণযোগ্যতা আজও হারিয়ে যায়নি। শোষন বঞ্চনার চেহারা  পরিবর্তনের সঙ্গে গণসঙ্গীতের আঙ্গিকে পরিবর্তন আসবে ্এটাই স্বাভাবিক। নতুন যুগের নতুন প্রেক্ষপটে নতুন সাঙ্গীতিক বৈশিষ্ট্য সমুজ্জ্বল বেশ কয়েকজন গণসঙ্গীতকার সুরস্রষ্টা এবং গায়কের আর্বিভাব ঘটেছে। এদের মধ্যে বিশ্বপরিমন্ডলের  বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর হৃদয় জয় করা এ যুগের গণসঙ্গীত শিল্পী হিসাবে আমরা একবাক্য যার নাম করতে পারি নাতিনি হচ্ছেন ভ’পেন হাজারিকা । তাঁর মাতৃভাষা অসমীয়া হলেও বাংলায় নতুন ধারার   গণসঙ্গীত পরিবেশন করে সমাদিত হয়েছেন এবং হচ্ছেন এ কথা নিদ্ধির্ধায় স্বীকার করতেই হবে। ভূ’পেন হাজারিকার গানের যুগের  পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সুর ও যন্ত্রের ব্যবহারের নতুন অনুষঙ্গ বর্তমান থাকলেও তাকে আমরা সলিল চৌধুরীর উত্তরসুরী হিসাবে চিহ্নিত করতে পারি । আজ সলিল চৌধুরীর নেই, কিন্তু তাঁর অমর সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে তিনি যুগ যুগ ধরে অগণিত সঙ্গীতরসিকের চিত্তে চিরভাস্কর হয়ে থকবেন একথা বলতে বাধা নেই।  

No comments:

Post a Comment