25 January 2017

মোঃ জাহিদ হোসেন ফাহিম






.১.
লোকে আমাকে ঠান্ডা মেজাজের মানুষ হিসেবে জানে। তবে সকালে অফিসে যাওয়ার সময় বাসে উঠতে না পেরে, ভিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে, জ্যামে কাবু হয়ে আমার স্ক্রু-গুলো যখন খুলতে শুরু করে, তখন আমি মনেমনে বকা দেই। জ্যাম কে বকা দেই, ঢাকায় এত লোক কেন- সে জন্য বকা দেই (বকাটা যে ঠিক কাকে দেই সেটা অবশ্য জানি না), জ্যামে বসে তা’দেয়ার সময় নিজের কপালকেও বকা দেই। সব বকাই অবশ্য মনে মনে দেই। এই পোড়া শহরে একটা বাস পাওয়া-না পাওয়ার উপরে যখন চাকরির থাকা- না থাকা নির্ভর করে, তখন একটা প্রাইভেট কম্পানির এক্সিকিউটিভের মনেমনে বকা দেয়া- মনে হয় খুব একটা দোষের কিছু না! 

আজও আমি বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছি। বাসের তো আর অভাব নেই। কিন্তু বাসের চাকার উপরেও দাঁড়ানোর জায়গা নেই; ভেতরের কথা তো বাদই দিলাম। বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে কঠিন একটা বকা দিব কিনা ভাবছিলাম... আর ঠিক তখনই একটা বাস দেখতে পেলাম; ঠিক মতো ‘ফাইট’ দিতে পারলে ওটার দরজায় ঝোলার একটা চান্স হয়ত পেয়ে যাব। বাসটা কাছাকাছি আসতেই বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়ানো মানুষগুলোর মধ্যে হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে গেল। লাথি মেরে, কণি মেরে, গুতো মেরে যে যেভাবে পারছে, সেভাবে সবাইকে টপকে বাসে ওঠার চেষ্টা করছে। মনে হচ্ছে যেন, এটা কোন বাস না, স্বর্গে যাওয়ার প্লেন। এই প্লেনে যেই উঠবে, সেই বিনা হিসেবে স্বর্গে চলে যাবে! যা হোক, অন্য সবার মতো আমিও জান প্রাণ দিয়ে বাসে ওঠার চেষ্টা করছিলাম; অফিসে তো যেতে হবে! আমি অনেক চেষ্টা করে কোনমতে আমার ডান পায়ের আঙ্গুলের দিকের একটু অংশ বাসের দরজার পাদানিতে রেখেছি, কিন্তু মানুষের চাপ এবং ক্রমবর্ধমান বাসের গতির জন্য আমি বাসের দরজার হ্যান্ডেলটা ধরতে পারলাম না। আরেকটা পা মাটিতে ঘষা খাচ্ছে... আমি তারপরেও হ্যান্ডেল টা ধরার চেষ্টা করলাম; কিন্তু ব্যার্থ হলাম। এর ফল হলো খুব মারাত্মক! আমি চলন্ত বাস থেকে রাস্তায় পড়ে গেলাম, তবে বাসের গতি কম থাকায় আমি আমার ব্যালেন্স ধরে রাখলাম। তাই মাটিতে গড়াগড়ি না খেয়ে মোটামুটি দৌড়ের মতো করে আমি সামনে এগিয়ে গেলাম। কয়েক ফুট সামনে যেয়ে আমি একজন মেয়ের সাথে ধাক্কা খেলাম এবং মেয়েটিকে নিয়ে মাটিতে পড়ে গেলাম, মেয়েটি আমার নিচে চাপা পরে রইল... ঘটনাটা ঘটল ঠিক বাংলা সিনেমার মতো। তবে এটা বাংলা সিনেমা হলে এতক্ষণে আমাদের প্রেম হয়ে যেত, শুধু তাই না! বৃষ্টিতে নাচা নাচি করে  হয়ত এতক্ষণে আমরা---- থাক আর না বলি!


বাস্তব ঘটনা হল, আমি মেয়েটির উপর পড়ে গেছি। মেয়েটির চোখে এখন ভয়, বিষ্ময়, রাগ, নাকি ঘৃণা- ঠিক বুঝতে পারছিনা, কারণ তার চোখে সান গ্লাস। শুধু একবার কাঁপা গলায় ডাক দিল, “কা-কালাম চাচা!”
আমি সাথে সাথে সরে গেলাম। প্রচুর ব্যাথা পেয়েছি জায়গায় জায়গায়। আমি মেয়েটাকে বললাম, “দেখুন আমি খুবই দুঃখিত, আমি আসলে----”
মেয়েটা হঠাৎ আমাকে থামিয়ে দিয়ে, ভয় পাওয়া গলায় বলে উঠল, “আপনি কে?কী করছেন এসব?”
আমি তার কথায় খুবই বিব্রত হয়ে গেলাম। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে কোন রকমে বললাম “না, মানে, আমি আসলে...”
মেয়েটা কিছুটা ক্ষিপ্ত হয়ে বলল, “আপনি আমাকে ধাক্কা দিয়েছেন? কেন! খবরদার! আমাকে ধরবেন না!”
আমি মেয়েটাকে বোঝানোর চেষ্টা করে বললাম, “দেখুন আমি আসলে আপনাকে ইচ্ছে করে ধাক্কা দেইনি...”
মেয়েটির সানগ্লাসের ফাঁক দিয়ে এবার আমি অশ্রু দেখতে পেলাম। মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতেই আবার ডাক দিল, “কালাম চাচা!কালাম চাচা, কোথায় আপনি?”
কয়েকজন মানুষ জড় হয়ে গেছে আমাদের ঘিরে। তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে। আমার ভীষণ রাগ হলো হঠাৎ। আমি বললাম, “ঠিক আছে, আমি না হয় খারাপ- আমি আপনাকে ধাক্কা দিয়েছি। কিন্তু আমি যখন আপনার দিকে ছুটে আসছিলাম, আপনি তখন কেন সরলেন না?”
মেয়েটি কান্না বন্ধ করে বলল, “আমি আপনাকে দেখতে পাইনি”।
“দেখতে পাবেন না কেন! আপনি তো আমার দিকেই ঘুরে ছিলেন। দেখুন, আমি সত্যি বলছি এটা একটা অ্যাকসিডেন্ট... আমি সবার সামনে ক্ষমা চাইছি।”
“এত জোরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে বলছেন অ্যাকসিডেন্ট!”
“কী আশ্চর্য! আমি তো চলন্ত বাস থেকে পড়ে গিয়েছিলাম! এরপর গতি সামলাতে না পেরে আপনার উপর এসে পড়েছি। এতে আমার কোন হাত ছিল না। আপনি কী এসব কিছুই দেখেননি!”
“না দেখিনি।”
“আজব! দেখেননি মানে! আপনি কি অন্ধ নাকি?”
মেয়েটা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “হ্যা, আমি অন্ধ...”

এরপর মেয়েটি তার ব্যাগ খুলে ছোট একটা সাদা রঙের লাঠির মতো জিনিস বের করল। কোথায় একটা কিছু করতেই ভাঁজ করা লাঠিটা লম্বা হয়ে গেল! আমি অবাক হয়ে গেলাম! এটা সত্যিই একটা ‘হোয়াইট কেইন’- অন্ধ মানুষেরা চলাচলের জন্য সাদা রঙের যেই লাঠি ব্যবহার করে, এটাই সেটা! মেয়েটা সেই লাঠিটা নিয়ে একটু দূরে চলে গেল। আর আমি প্রচন্ড এক অপরাধবোধ নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইলাম...  কেন যেন মনে হচ্ছিল- খুব বড় একটা অপরাধ করে ফেলেছি আমি। এই অপরাধের কোন ক্ষমা নেই।


.২.

প্রবল একটা অপরাধবোধ বুকে নিয়ে আমি সারা রাত ঘুমাতে পারলাম না। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে নির্ধারিত সময়ের একটু আগেই বের হয়ে গেলাম- মেয়েটার সাথে যদি আবার দেখা হয়ে যায়, সেই প্রত্যাশায়। কারণ আমি ঠিক করেছি, আমি আজও মেয়েটার কাছে ক্ষমা চাইব।

প্রায় ১০ মিনিট হয়ে গেল আমি দাঁড়িয়ে আছি। মেয়েটা কাল যেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল আমি ঠিক সেখানটায় আছি। এটা আসলে সিএনজি স্ট্যান্ড। আশা করছি মেয়েটা আজও সিএনজির খোঁজে এখানে আসবে। হঠাৎ আমি তাকে দেখতে পেলাম। হোয়াইট কেইন টা নিয়ে সে আসছে। সাথে একজন বৃদ্ধ লোক; ইনিই বোধ হয় কালাম চাচা- যাকে মেয়েটি কাল বার বার ডাকছিল। সিএনজি স্ট্যান্ডে এসে মেয়েটি দাঁড়াল, কালাম চাচা একটু সামনে এগিয়ে গেল। বোধ হয় সিএনজি খুঁজতে গেল। কারণ সিএনজি স্ট্যান্ডে কোন সিএনজি নেই; এই সময় থাকেও না। কালাম চাচা একটু সামনে মানুষের ভিড়ে মিশে গেল, আর আমি সেই সুযোগটিই কাজে লাগালাম।

আমি মেয়েটির কাছে গিয়ে কী বলব ঠিক বুঝতে পারলাম না। একটু কাশি দিলাম, কিন্তু মেয়েটার কোন ভাবান্তর হলো বলে মনে হলো না। তখন আরেকটু কাছে গিয়ে বললাম, “কেমন আছেন?”
মেয়েটি সাথে সাথে চমকে উঠল! মনে হলো ভয় পেল। আমাকে অবাক করে দিয়ে সে বলল, “আপনি!আজও এসেছেন?কী চান আমার কাছে?”
আমি বিস্ময় গোপন না করেই বললাম, “আপনি কীভাবে বুঝলেন যে আমিই সেই লোক, যে গতকাল স্টুপিডের মতো আপনাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলাম!”
মেয়েটা একটু কঠিন গলায় বলল, “আমি চোখে দেখতে পাইনা এ কথা সত্যি, কিন্তু আমি আমার অন্য ইন্দ্রিয়গুলো দিয়ে সব বুঝতে পারি।”
আমি সব বুঝে ফেলেছি এমন একটা ভাব করে বললাম, “ও আচ্ছা...”
আমি কয়েক সেকেন্ড থেমে বললাম, “আসলে আজ আমি আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম... আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি।”
মেয়েটি খানিকটা অবাক হয়ে বলল, “ক্ষমা?আচ্ছা আপনি কী চান বলুন তো?কেন আমার পিছু নিয়েছেন?”
আমি আরো কিছু বলতাম, কিন্তু তার আগেই দেখি আমাদের সামনে একটা সিএনজি থামল। ভেতর থেকে কালাম চাচা বের হয়ে বললেন, “নিশা, উঠে এসো মা!”
এই সুযোগে আমি মেয়েটার নাম জেনে নিলাম। মেয়েটা কোন কথা না বলে তার হাতের হোয়াইট কেইন ভাঁজ করে সিএনজিতে উঠে গেল। আর আমি আরো যন্ত্রণার মধ্যে ডুবে গেলাম... কারণ আমি বুঝে গেছি- নিশা নামের মেয়েটি আমার প্রতি একটা খারাপ ধারণা লালন করে যাচ্ছে। একটা ব্যাপার ভেবে খুব অবাক হলাম- আমি কেন নিশার কাছে নিজেকে ভালো প্রমাণ করার জন্য এমন উঠে-পরে লেগেছি! কেন???


.৩.

কয়েকটা মাস কেটে গেল। আমি আর নিশার সাথে দেখা করিনি। কী যেন এক অভিমান কাজ করল বুকের ভেতর। ও যদি আমাকে খারাপ ভেবে ভাল থাকে তো থাকুক। আমি আর নিজেকে ভাল প্রমাণ করব না- এই অভিমান নিয়ে আমি আর নিশার সামনে যাইনি। তবে কোন অধিকারে অভিমান করব- সেটার অবশ্য কোন উত্তর পাইনি। নিশার জন্য মনের ভেতরে এখন একটা অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে। আমি অবশ্য নিজেকে বোঝাই- ‘ও কিছু না! এমনেতেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’

আমাদের অফিসের এইচ.আর. অ্যাডমিন তুলি আপু আমাকে খুব স্নেহ করেন। তিনি বলেন এই অফিসে যারা কাজ করে সবাই তার কলিগ, শুধুমাত্র আমিই নাকি তার ভাই। তো সেই সুবাদে তার ছেলে সাহিল এর জন্মদিনে আমি দাওয়াত পেলাম। সাহিলের জন্ম ১৬ই ডিসেম্বরে, তাই অফিস ছুটি। আমাকে তুলি আপু, বার বার করে বলে দিয়েছেন, আমি যেন আগে ভাগেই চলে আসি; চুটিয়ে আড্ডা হবে।  দেরী হলে নাকী কান টেনে ছিঁড়ে না ফেললেও ২ ইঞ্চি লম্বা করে দিবেন! আমার চেহারা ছুরত আবার বেশী ভাল না; তাই আমি কান লম্বা হয়ে যাওয়ার রিস্ক নিলাম না। দুপুর ১২ টার পর পরেই ঠিকানা মতো তুলি আপুর বাসায় হাজির হলাম। বাসাটা মিরপুরে।

তুলি আপুর বাসায় ঢুকতে যাব, তখন হঠাৎ করে আমি আবার নিশাকে দেখে ফেললাম। লাল-সবুজ শাড়ি পরে সিএনজি থেকে নামছে। ভেতরটায় কোথায় যেন একটা নাড়া দিয়ে গেল! দেখলাম সে হেঁটে একটা অন্ধদের স্কুলে ঢুকে গেল... হাতে হোয়াইট কেইন। স্কুলটা ঠিক তুলি আপুর বাসার উল্টো পাশেই।

আমি কেন জানি নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না; চিৎকার করে ডাক দিলাম, “নিশা!”
নিশা থমকে দাঁড়াল। আমি দ্রুত স্কুলের গেইটের ভেতর ঢুকে গেলাম। এরপর নিশার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কেমন আছেন, নিশা?”
নিশা যেন একমূহুর্ত কী ভাবল। তারপর বলল, “আপনি!!!আপনি এখানেও এসেছেন!!”
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললাম, “আসলে আমি এখানেই ছিলাম, হঠাত আপনাকে দেখলাম; তাই আর কী...”
নিশা একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “তাই?তাই- কী?”
আমি আমতা আমতা করে বললাম, “আসলে আপনার সাথে একটু কথা ছিল... প্লিজ আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি কোন খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে আপনার কাছে আসিনি। আমি খুব বেশী খারাপ মানুষ না। আমি আসলে----”
নিশা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “দেখুন আমার ক্লাসে যেতে হবে। বাচ্চারা সবাই অপেক্ষা করছে। আজ আমাদের বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান হবে। আমাকে যেতে হবে।”
আমি একটু আহত স্বরে বললাম, “ঠিক আছে নিশা, আপনি যান। আমি গেটের পাশে অপেক্ষা করব। আপনি অনুষ্ঠান শেষে আমাকে ৫ টা মিনিট সময় দিবেন, প্লিজ!”
নিশা একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “কিন্তু অনুষ্ঠান শেষ হবে সেই বিকেলে।”
আমি শান্ত কণ্ঠে বললাম, “সমস্যা নেই; আমি অপেক্ষা করব।“
নিশা কিছু না বলে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। এর পরে তার হোয়াইট কেইনটা সাথে নিয়ে সে স্কুলের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল।


.৪.
নিশার স্কুলের সামনে প্রায় ২ ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছি। স্কুলের দাঁড়োয়ান হঠাৎ এগিয়ে এসে বললেন, “বাজান  অনেকক্ষণ ধইরা দাঁড়ায়া আছেন! কী চান আফনে?”
আমি একটু মৃদু হেসে বললাম, “কিছু না। একজনের জন্য অপেক্ষা করছি।”
বৃদ্ধ দারোয়ানটা আমাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “বাজান!একটা কথা কই?”
“জ্বী বলেন?”
“আফনে কি নিশা ম্যাডামের কাছে আসছেন?”
“জ্বী।”
“নিশা আফনের কী হয়?”
আমি একটু কঠিন কন্ঠে বললাম, “সেটা জানা কি আপনার খুব জরুরী?”
দারোয়ান আরো নরম সুরে বললেন, “বাজান গো! ভুল বুইঝেন না। আফনেরা একডু আগে যেই কথাগুলা বলতেছিলেন, আমি সেগুলা শুনছি। এই জন্যই আফনের সাথে দুইডা কথা বলতে আসছি।”
“ঠিক আছে চাচা, কী বলবেন বলেন?”
“নিশা মাইয়্যাডা অনেক ভালা। সে যে কত্ত ভালা মানুষ সেইটা তার সাথে না মিশলে আফনে বুঝতে পারবেন না। আমারে তার বাপের মতো দেখে। ওষুধ কিন্না খাওয়ায়। ঠিক মতো ওষুধ না খাইলে রাগ করে। স্কুলের পুলাপাইনগুলারে যে কত্ত আদর করে! অথচ এত সুন্দর, ভাল মাইয়্যডার দিকে কেউ ফিরা চায় না। কারণ সে অন্ধ... বাজান গো! চাইর বছর আগেও সে অন্ধ ছিল না। সে অন্ধ হইছে আমার দোষে।”
আমি অবাক হয়ে বললাম “কী বলেন আপনি!”
দারোয়ান চাচা একটা দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “হুম। নিশা তহন কলেজে পড়ত। প্রতিবন্ধী দিবসের কী একটা অনুষ্ঠানে সে এইখানে তার কলেজের লোকজনসহ গান গাইতে আসছিল। কী সুন্দর গলা! আহারে! অনুষ্ঠান শ্যাষে যখন সে তার কলেজের মাইক্রোবাসের সামনে দাঁড়ায়ছিল, আমার ৪ বছরের নাতিটা তখন রাস্তায় খেলতেছিল। ব্যস্ত রাস্তা... আমি অবুঝের মতো নাতিডারে ছাইড়া রাখছিলাম। হঠাৎ একটা পেরাইভেট কার খুব জোরে একদিকে আসতেছিল। আমার নাতিডা তহনো রাস্তায় খেলতেছিল। বড়লোকের বাচ্চা গাড়িডারে নাতিডার উপর প্রায় উঠায়াই দিছিল। কিন্তু হঠাৎ নিশা চিলের মতো চিক্কুর দিয়া, রাস্তায় ঝাপায়া পইড়া, বাচ্চাডারে দূরে ঠেইলা দিলো। আর গাড়িডা হার্ড বেরেক কইরা নিশার মাথার লগে লাইগা গেল... রক্তে ভাইসা গেল এলাকাডা। কী যে কষ্ট পাইলাম... কী যে কষ্ট! দুই দিন পর শুনি মাইয়্যাডা নাকি আর চোখে দেখতে পারব না। মাথায় বাড়ি লাইগা চোখের কী জানি একটা নষ্ট হইয়া গেছে... সেই থেকে এখনো নিজেরে ক্ষমা করতে পারি নাই। অথচ মাইয়্যাডার মনে কোন দোষ রাখে নাই; আমারে কত্ত মায়া করে! রাস্তার গরীব পুলাপান গুলিরে মাঝে মাঝেই খাওয়ায়, কাপড়-জামা দেয়, ওগো গল্প শোনায়। কারো রক্ত লাগলে কাম কাজ ফালায়া ছুইটা যাইয়া রক্ত দেয়। মাইয়াডার মনে অনেক মায়া, অনেক ভাল মাইয়া সে। বাবাগো, আফনে যেই হন, মাইয়্যাডারে কখনো কষ্ট দিয়েন না। আফনের আল্লাহর দোহাই লাগে। মাইয়্যাডার মনে এমনেই ম্যালা কষ্ট...”

দারোয়ান চাচার কথা শুনে কখন আমার চোখে পানি চলে এসেছিল বুঝতে পারিনি। হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে বললাম, “চাচা, নিশা অন্ধ তো কী হয়েছে! ওর মতো ভাল মানুষ জীবনসঙ্গী  হিসেবে পাওয়া তো আমার স্বপ্ন! আমি কখনো নিশাকে কষ্ট দিবনা চাচা। আমি ওর জীবনের হারানো আলো ফিরিয়ে দেবো।”
বৃদ্ধ দারোয়ান মুখে হাসি নিয়ে তার চোখ মুছেই যাচ্ছে... চোখে কান্না, মুখে হাসি- এ শুধু মানুষের পক্ষেই সম্ভব।



.৫.

তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আমি নিশার স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। তুলি আপুর ছেলের জন্মদিনে যাইনি। ফোন করে পুরো ব্যপারটা একবার খুলে বলার চেষ্টা করেছিলাম; কতটুকু বোঝাতে পেরেছি জানি না। এসব নিয়ে এখন ভাবতেও পারছি না। এখন আমার চিন্তা জুড়ে শুধুই নিশা। একটা মেয়ের জন্য এরকম পাগল হয়ে যাব কখনো ভেবেছিলাম! কখনো কী ভেবেছিলাম সেই মেয়েটা হবে সম্পূর্ণ অন্ধ! ভাবছি, কেমন হবে নিশার ফ্যামিলি? নিশাকে স্বীকৃতি দিতে না জানি কত যুদ্ধ করতে হবে আমার পরিবারের সাথে! তারা মানবে তো! নিশ্চয়ই মানবে- তারা তো সব সময় বলে আমার পছন্দের উপর তাদের আস্থা আছে।
এসব যখন ভাবছিলাম তখন হঠাৎ পেছন থেকে নিঃশব্দে নিশা হাজির হলো। জানিনা কীভাবে বুঝল যে আমিই দাঁড়িয়ে আছি। নিশার কন্ঠে বিস্ময়- “আপনি এখনো আছেন!”
“ওহ! আপনি এসেছেন! হুম, আমি তো বলেছিলাম আমি থাকব।”
“আচ্ছা, এখন বলুন তো, আমার মতো মানুষ আপনার কী কাজে লাগতে পারে?”
“প্রতিটি মানুষই ইম্পর্টেন্ট। আচ্ছা শুনুন, আগামী শুক্রবার, আপনার এই স্কুল মাঠে আমি গরীব, ছিন্নমূল শিশুদের একবেলা ভাল কিছু খাওয়াব। ওদের জন্য শিক্ষামূলক একটা ক্লাস নিব। ওদেরকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাব, দেশের গান শোনাব। রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত ও শোনাব- যেন ওরা আমাদের সংস্কৃতির শেকড়টা চিনতে পারে। খাবারের মেন্যু কী হবে, ওদের ক্লাসে কী পড়াব- এসব আপনি ঠিক করে দিবেন এবং ওদের কে গান শোনানোর দায়িত্বটাও আপনার।“
নিশা খানিকটা প্রতিবাদ করে উঠল, “আমি!আমি কেন?”
“কারণ আমার চেনা জানা মানুষদের মধ্যে আপনি ছাড়া এই কাজগুলো আর কেউ ভালমতো করতে পারবে না। এই কাজের জন্য আপনিই বেস্ট। মানুষের জন্য আপনার যেমন অনেক মায়া, আমারও খানিকটা আছে... আমি সব জানি আপনার সম্পর্কে!”
নিশা একটু সন্দেহ মেশানো কন্ঠে বলল, “কিভাবে জানলেন?”
আমি একটু রহস্য করে বললাম, “এখন বলব না! শুক্রবারে আমাদের প্রোগ্রামটা হয়ে যাক, তারপর বলব! সেই প্রোগ্রামে আপনার স্কুলের দারোয়ান চাচা থাকবে, আপনি চাইলে আপনার কালাম চাচাও থাকবে, কিংবা আপনার পরিচিত যে কেউ থাকতে পারে। আমাকে একটু বিশ্বাস করে দেখুন- আমি খুব বেশী একটা খারাপ মানুষ না। আমি আমার মোবাইল নাম্বার আপনার স্কুলের দারোয়ান চাচার কাছে দিয়ে যাচ্ছি। আপনি দুই দিন ভাবুন, তারপর দারোয়ান চাচার কাছ থেকে আমার নাম্বার নিয়ে আমাকে ফোন করে জানান। যদি ২ দিন পরেও আপনার ফোন না পাই, তবে ভেবে নিব আপনি রাজি না।”

নিশা একটু হাল ছেড়ে দেয়া কন্ঠে বলল, “দেখুন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনি কেন আমাকে এত গুরুত্ব দিচ্ছেন?কে আপনি?আমার কাছে সব কিছুই কেমন রহস্যময় লাগছে!”
“আমার নিজের কাছেও সব কিছু রহস্যময় লাগছে নিশা। তবে এই রহস্যের জট খুব জলদি খুলবে যদি আমি আপনার সাহায্য পাই।”
নিশা চুপ করে রইলো। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “নিশা যাই আজকে। আপনার অনেক সময় নষ্ট করলাম। হয়ত আপনি আগের মতোই আমাকে বাজে লোক ভাববেন- যেই লোক কিনা রাস্তাঘাটে মেয়েদের ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়... যা হোক, আমি তবুও আপনার ফোনের অপেক্ষায় থাকব।”

এরপর আমি ওখান থেকে চলে আসি। গরীব শিশুদের জন্য আমি কিছু করার কথা আগের থেকেই ভাবছিলাম- এখন এক ঢিলে দুই পাখি মারার একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম! গরীবদের জন্য কিছু করাও হলো, আবার নিশার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার একটা ব্যাবস্থাও হয়ত করা হল!

দুই দিন কেটে গেল নিশা আমাকে কোন ফোন দেয় নি। কিন্তু তৃতীয় দিনই সে আমাকে ফোন দিয়ে জানালো যে, সে আমার সাথে আছে।
এই একটা ফোন কল আমার জীবনের সবকিছু বদলে দিলো।



.৬.
সেদিনের সেই প্রোগ্রামটা ভালভাবেই শেষ করলাম। নিশার কাজ কর্ম দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছি। মেয়েটা অনেক গোছালো আর সত্যিই তার মনটায় অনেক মায়া! গরীব বাচ্চাগুলোকে কত যত্ন করল, কত সুন্দর করে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাল, রবীন্দ্রসংগীত শোনাল! আমি সত্যিই মুগ্ধ! সেদিনের পর থেকে নিশার সাথে আমার খুব ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গেল। একসময় আমি নিশাকে অনেক ভালবেসে ফেলি; কিন্তু মুখে সেটা প্রকাশ করি না। আমি আমার সব কথা নিশার সাথে শেয়ার করি। নিজেকে ওর কাছে প্রকাশ করি। সব সময় নিশার খোঁজ খবর নেই। নিশার কী পছন্দ- অপছন্দ জেনে নেই। আমারটাও প্রকাশ করি। সব সময়ই নিশার পাশে থাকার চেষ্টা করি। একটা সময় আবিষ্কার করি আমার প্রতি নিশার অদ্ভূত একটা টান আছে! আমি সেই টান স্পষ্ট অনুভব করতে পারি... ভালবাসা বুঝি এমনই হয়। যখন আকাশে মেঘ করে, আমরা দু’জন ঘুরতে বের হই। আমি আকাশের রূপ বর্ননা করি, নিশা মুগ্ধ হয়ে শোনে! কল্পনায় সেই মেঘ নিশা দেখতে পায়। আমি আমার চোখ দিয়ে নিশাকে দেখতে শেখাই। যখন ঝুম বৃষ্টি নামে তখন আমরা একসাথে বৃষ্টির শব্দ শুনি। যখন উথাল-পাথাল জোছনা নামে- আমরা একসাথে চন্দ্র স্নানে যাই। আমি ওকে ফোন দিয়ে বলি ওদের বারান্দায় আসার জন্য, আমিও আমার বারান্দায় আসি। দুই বারান্দায় তখন জোছনার রাজত্ব! আমি ওকে দেখতে পাইনা। কিন্তু চোখ বন্ধ করে ওকে বলে দিতে থাকি- চাঁদের আলোয় ওকে কতটা সুন্দর লাগছে! আমি টের পাই, আমার কথা শুনে নিশা গোপনে চোখের পানি মোছে। ও যে তখন কতটা খুশি হয়, সেটা আমি ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবে না। একটা সময় বুঝতে পারলাম আমরা দু’জন, দু’জনের উপর অনেক নির্ভরশীল হয়ে পরেছি। অনেক......

এভাবে প্রায় ৮ মাসের মতো কেটে গেল। এক সময় আমার মনে হল, আর কোন গোপনীয়তা নয়। এবার নিশাকে আমার ভালবাসার কথা বলে দিতেই হবে। অনেক তো হলো, এবার আমার রাজকন্যা আমি নিজের করে বুঝে নিতে চাই।

সেদিন নিশার সাথে রমনায় দেখা করলাম। শেষ বিকেলের দিকে আকাশে মেঘ করছিল, সাথে অনেক বাতাস বইছিল সেদিন! আমি খুব সাবধানে নিশাকে বললাম, “নিশা, তোমার সাথে আমার খুব জরুরী একটা কথা আছে।”
নিশা মিষ্টি করে হেসে বলল, “কী কথা!বলো?”
আমি খানিকক্ষণ চুপ করে রইলাম... কারণ কিভাবে বলব বুঝতে পারছিলাম না!
নিশা একটু অধৈর্য হয়ে বলল, “কী হলো!বলছ না কেন- কী বলবে?”
আমি কাঁপা গলায় বললাম “নিশা, আ-আমি তোমাকে----”
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই নিশা আমার মুখ চেপে ধরল। হাহাকার করে বলল, “না, ফাহিম না! আমি জানি তুমি কী বলবে। প্লীজ ওটা বলনা; আমি সহ্য করতে পারব না।”
আমি প্রতিবাদ করে বললাম “কেন! নিশা কেন!! তুমি তো জান আমাকে, বোঝ সব কিছু... তাহলে সমস্যা কোথায়?”
নিশা এবার আঝোরে কেঁদে দিলো। বলল “ফাহিম, তুমি কত ভাল মেয়ে পাবে। আমার মতো অন্ধ একটা মেয়ের জন্য কেন তুমি তোমার লাইফ নষ্ট করবে?”
আমি ডানে-বায়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, “নিশা, কে বলেছে তুমি অন্ধ!চোখে দেখতে না পেলেই কী মানুষ অন্ধ হয়?ভাল-ভাল চোখ নিয়ে কত অন্ধ মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে তুমি জানো?তুমি জানো কত ভালমানুষ তুমি?তুমি জানো, তোমাকে না পেলে আমার জীবনটা অন্ধকার হয়ে যাবে?”
নিশা কান্না আটকে রাখতে রাখতে বলল, “প্লিজ ফাহিম থাম, আমাকে আর কষ্ট দিও না। এটা হয়না ফাহিম। তোমার ফ্যামিলি মানবে না। লোকে দশটা কথা বলবে তোমাকে- এটা আমি কিভাবে সহ্য করব?”
আমি ক্ষোভ মেশানো কন্ঠে বললাম “আমি নিকুচি করি ওই সব বাইরের লোকের কথার। আর আমার ফ্যামিলি সব মেনে নিবে। নিশা তোমার ফ্যামিলি তো অনেক ভাল, আমার ফ্যামিলির সাথে একেবারে মিলে যায়। আর বাকিটুকু আমি ম্যানেজ করে নিব। আমার ফ্যামিলি আমার পছন্দকে অসম্মান করবে না কখনোই। সবচেয়ে বড় কথা, তুমি অনেক অনেক ভাল মেয়ে নিশা। আমি তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভাবতে পারব না।”
নিশা হাহাকার করে বলল, “কিন্তু আমি চোখে দেখিনা...”
আমি নিশার হাত ধরে বললাম, “কে বলেছে তুমি চোখে দেখনা! আমার চোখ আছে না! তোমাকে আমি শিখিয়েছি না- কিভাবে আমার চোখ দিয়ে পৃথিবী দেখতে হয়। আমিই তোমার আলো হব নিশা; তোমার কোন অপূর্ণতা থাকবে না! আমি তোমার দেহের একটা অংশ হয়ে যাব, আমি তোমার পুরো অস্তিত্ব হয়ে যাব, সবটুকু উজার করে তোমাকে ভালবাসব। কিসের ভয় তোমার?তোমার কিসের অপূর্ণতা? কেঁদো না নিশা! দেখ, আমি আছি না... এই তো আমি! আমি তোমাকে সত্যিই অনেক ভালবাসি নিশা। অনেক ভালবাসি...”
নিশা এরপর আমার হাত ধরে অনেক কাঁদল। ও সময় কোন কথা বলতে পারল না সে। একটা সময় চোখ মুছে উঠে দাঁড়াল। মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে সে বলল, “আমি জানি তুমি আমাকে অনেক ভালবাস। আমার মতো মেয়ের জন্য এটাই অনেক বড় পাওয়া। এখন যদি আমি মরেও যাই, আমার কোন আফসোস থাকবে না ফাহিম। কিন্তু আসল কথা হল, আমার পক্ষে সম্ভব না। তুমি আমাকে মাফ করে দিও; আমি চলে যাচ্ছি। আর কোন দিন হয়ত তোমার সাথে দেখা হবে না। আমি তোমার জীবন থেকে পালিয়ে যেতে চাই। আমি জানি তোমার জন্য অনেক ভাল কিছু অপেক্ষা করছে। আমাকে প্লিজ মাফ করে দিও...”

নিশা উঠে চলে যাচ্ছিল, আমি পথ আগলে দিয়ে বললাম, “থামো!শুধু একটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাও। নিশা, সত্যি করে বলতো- তুমি কি আমাকে একটুও ভালবাসনি?”

নিশা এই প্রশ্নের কোন উত্তর দিল না। শুধু দেখলাম তার চোখ দিয়ে অনবরত অশ্রু ঝরছে... এরপর কিছু না বলেই নিশা তার হোয়াইট কেইন টা মেলে দিয়ে সামনে এগিয়ে চলে গেল। আমি ওর চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম। বেশীক্ষণ ওকে দেখতে পেলাম না। চোখের অশ্রুতে সব ঝাপসা হয়ে গেল। মনে হলো যেন, আমার জীবনের সমস্ত আলো কেড়ে নিয়ে নিশা নামের এই মেয়েটি অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে... আমি বাচ্চা শিশুর মতো হুহু করে কাঁদতে লাগলাম।


*** আট বছর পর***

নিশা পারেনি আমাকে ছেড়ে থাকতে। আজ থেকে ঠিক সাত বছর আগে নিশা আর আমার বিয়ে হয়। আজ আমাদের সপ্তম বিবাহ বার্ষিকী। বিছানায় বসে বসে আমি আমাদের বিয়ের ছবিগুলো দেখছিলাম। আমার পাঁচ বছরের মেয়ে অরিনি হঠাৎ রুমে এসে জিজ্ঞেস করল, “বাবা! কী কর?”

“এই তো মা, ছবি দেখছি”
“মা এর ছবি দেখছ বাবা?”
“হ্যাঁ মা।”
“এই ছবি দেখলে তুমি সব সময় কান্না কর কেন?”
“কই মা!কাঁদছি না তো!”
“কাঁদছ তো!এই যে, তোমার চোখে পানি!”
“ও কিছু না মা... অরিনি সোনা! বাবার কোলে আস মা”

আমি আমার মেয়ে অরিনিকে বুকে চেপে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলাম। অরিনি ভয় পাওয়া গলায় বলল, “কী হয়েছে বাবা!তুমি কাঁদছ কেন?”
আমি নিজেকে শান্ত করতে করতে বললাম “কিছু না মামনি। তোমার মা এর কথা মনে পরল তো- তাই খুব কষ্ট লাগছে।”
অরিনি দুঃখি দুঃখি কন্ঠে বলল, “মা এর জন্য আমারও কষ্ট লাগে বাবা। মা আমাদের ফেলে আল্লাহর কাছে চলে গেল কেন বাবা?মা কেন আর আসে না?আমাকে আদর করে না, ঘুম আসলে গান শোনায় না?আমার খুব কষ্ট লাগে বাবা... মা এত পঁচা কেন?”
আমি অরিনি কে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, “মন খারাপ করে না মা। তোমার মা’র তো অনেক অসুখ হয়েছিল, তাই আল্লাহ মা’কে তাঁর নিয়ে গেছে। আল্লাহর কাছে কেউ গেলে আর ফিরে আসে না মা। মন খারাপ করেনা লক্ষ্মী সোনা! এই যে বাবা আছি না! আমিই তোমার মা, আমিই তোমার বাবা। বাবা তোমাকে কত্ত আদর করি! তোমাকে ঘুমের সময় গান শুনাই, বেড়াতে নিয়ে যাই। প্রতিদিন তোমার জন্য চকলেট নিয়ে আসি... তুমি তো বাবার কলিজার টুকরা!”

অরিনি কিছুক্ষন আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “I Love you  বাবা”
আমি অরিনির কপালে একটা চুমু দিয়ে বললাম, “I Love you too মা”- কথাটা বলতে যেয়ে আমার চোখ দিয়ে অশ্রু বের হয়ে এল। এতটুকু মেয়ে কিভাবে এত ভালবাসতে পারে!

অরিনি ঘুমিয়ে পরেছে। আমি ঘুমন্ত মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি... মেয়েটা অবিকল তার মা’র মতো হয়েছে। টানা টানা চোখ, গভীর কালো, বড় বড় চোখের মণি। সব তার মায়ের মতো... এমন কী কন্ঠটাও! আমি ওকে আরেকটা নিশা বানাব। যে গান গাইতে পারে, গরীব দুঃখিদের ভালবাসতে পারে, কারও বিপদে সাহায্য করার জন্য সব কিছু ভুলে ঝাপ দিতে পারে, স্বামী-সন্তান-সংসার কে বুকের মধ্যে আগলে রাখতে পারে- এমন একটি মেয়ে হয়েই আমার অরিনি বড় হবে। আমার নিশা বেঁচে থাকবে আমার অস্তিত্ব জুড়ে, বেঁচে থাকবে আমাদের মেয়ে অরিনির মাঝে... ব্লাড ক্যান্সার হয়ত নিশার দেহটিকে নিয়ে গেছে, নিশার অস্তিত্ব কখনো ধ্বংস হবে না। নিশা বেঁচে থাকবে আমাদের মাঝে। আর আমি বেঁচে থাকব নিশার স্মৃতি নিয়ে, নিশা আর আমার অস্তিত্ব- আমাদের সন্তান অরিনিকে নিয়ে আর আমাদের সাথে থাকবে নিশার অনেক বছরের সঙ্গী একটা হোয়াইট কেইন।
এইতো আমি... এভাবেই বেঁচে আছি। সাথে আছে শুধু নিশার স্মৃতি, নিশা আর আমার সন্তান আর একটা হোয়াইট কেইন।
________________________

No comments:

Post a Comment