বাস্তুসাপ অথবা জীবনানন্দের পেঁচা বিষয়ক কবিতাসমগ্র
পুরোনো বাড়ির যে অংশটাতে আমি থাকি সেটা
মোটামুটি বেশ আরামদায়ক এবং নির্ঝঞ্ঝাটই মনে হইছিলো। আমার ভূতে প্রেতে দেবে বিশ্বাস
নেই, ভয়ও পাই না। দোতালার নীচে আমি থাকি একরুমে, পাশের রুম দুইটা পরিত্যক্তই বলা
যায়। দোতালায় কেউ থাকে না। মাঝে মাঝে একজন পাগলিনী এসে থাকেন। একদিন আমার রুমে
ঢুকে বলতেছেন, আমার খাবার কোথায় হারামজাদা, আমার কাঁথাকম্বল কোথায়? আমি তো অবাক,
বলে কী? ঠিক তারপরেই, দেখি, সারা বাড়িতেই আগুনের হলকা। আমি দৌড়ে গিয়ে দেখি উনি
আগুন জ্বালাইতেছেন আর এতো বেশি লাকড়ি দিছেন যে, সেই তাপ সমস্ত বাড়ি আলোকিত হয়ে
গেছে। আমি জিজ্ঞেস করতেই উনি ক্ষেপে গেলেন। আমার শীত লাগলে কার বাপের কী? আমি ফিরে
আসবো শুনি, উনি আমাকে গালি দিচ্ছেন, হারামির বাচ্চা বলে। পরে শোনলাম, উনার একমাত্র
ছেলে অজিৎ, যে তার মাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে, সেই ছেলেকেই তিনি সারাদিন
গালাগালি করেন, এইটাই তার পাগলামি।
আমার রুমের সামনে বেশ খোলামেলা
জায়গা, অনেকটাই গাছপালা ঘেরা। শিরিষ,
সেগুন এবং একটা গাছের নাম জানি না। অসংখ্য পাখি, বিশেষ করে পেঁচা, চড়ুই আর শালিক।
পেচার ক্যাচক্যাচ রব বিরক্তিকর হলেও পেচার চোখ জীবনানন্দকে স্মৃতিতে এনে দেয়।
বিকেলে শিরিষের ডালপালার ভেতর দিয়ে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে কোন সুদূরে হারিয়ে যাই।
এই জায়গায় বাস করার পক্ষে যে কটা কারণ আমি ভেবেছি তার সবকটাই এই নির্জনতা, এই
গাছপালা, এই বিকেলের পাতাগলা সূর্যাস্তের মর্মরের জন্যই। আর লোকমুখে শ্রুত আছে,
আমি অসামাজিক। এইটাও একটা বড় কারণ।
এখানে থাকার জন্য আমি শুরু থেকেই
প্রস্তুত ছিলাম। একটা প্রজেক্টে কাজ করতে দুবছরের জন্য এখানে আসা। উপজেলা সদর
প্রায় পাচ কিলোমিটার দূরে বলে হেমন্তে যোগাযোগহীনতাই একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে
ওঠে। এসব ভেবে বর্ষাকাল আমি সদরেই কাটিয়েছি। নৌকা চলাচল বন্ধ হবার আগেই
তল্পিতল্পাসহ আমি এখানেই তাবু গেড়েছি। আশেপাশে কারেন্ট নেই কিন্তু এই বাড়িটাতেই
আছে। মানে, এলাকায় এখনো কারেন্ট সাপ্লাই আসে নি, এতোটাই অজপাড়াগা। আমি মোটামুটি
দিব্যিই আছি। একা একটা রাজ্য শাসন করার মজাই আলাদা। জনস্রোতে থেকেও আমি একলাই
থাকি। তবে এখানের মত এতোটাই একলা এর আগে কখনোই থাকি নি। আর সেটা আমার জন্য একটা
দারুণ অভিজ্ঞতাই বটে!
ডানপাশে যে বিল্ডিং আছে সেটা
দেখতে অনেকটা একলা দাঁড়ানো নিঃসঙ্গ মানুষের ছায়া। ঐদিকে দিনের বেলা আমি সাধারণত
যাই না। কিন্তু রাত্রে, টয়লেট দূরে বলে এইদিকেই সেরে নেই কাজকর্মাদি। নাম না জানা
যে গাছটার কথা বলেছি অইটার নিচেই আমি প্রাকৃতিক কর্মাদি সারি। কেনো জানি না, যখনি ওখানে যাই একটা সাপ যেনো ফনা তুলে আছে সামনে এরকম একটা অনুভূতি হয়। আর গাছের ঝোপে
মনে হয় রাজ্যের শাঁকচুন্নিরা বসে থাকে। আমি ভূতে ভয় পাই না অথচ এরকম একটা
শিরশিরানি টের পাই। আমার সিক্সসেন্স প্রখর। কিন্তু কথা হলো যাহা বিশ্বাস করি না
অথবা ভয় পাই না তাতে অহেতুক ভয় করে লাভ কী।
আমার খাবার আসে পাশের একটা বাড়ি
থেকে। অনেকটা পেয়িং গেস্টের মত। কিন্তু এই অজপাড়াগার মানুষ কাউকে খাইয়ে পয়সা নেবে
না। তাতে তাদের অমঙ্গল হয়। তাতে কিছু যায় আসে না। আমি অবশ্য নানা বাহানায় এটা ওটা,
মাঝে মাঝে বাজার থেকে ভালোকিছু এনে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পে করে দেই।
একরাত্রে, অখিল দা, মানে সেই লোকটা যার সাথে আমি খাই তিনি আমার রুমে এলে নানা
প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ তিনি বলেন এই বাড়িতে বহুদিনের একটা সাপ আছে। অনেকেই
দেখেছে। উনি দুই-তিনবার দেখেছেন। সাইজ
বিশাল বড়। অনেক বছর থেকেই এখানে থাকে। এবং আমি যে গাছের নিচে রাত্রিকালীন
ক্রিয়াকর্মাদি সারি সেটা একটা শ্মশান। গুনে গুনে তিনি বের করলেন সেই শ্মশানের বয়স
বত্রিশ বছর। চুরাশির বন্যায় যখন একমুঠো মাটিও অবশিষ্ট নেই, তখন এই পুরোনো বাড়ির
উচুভিটার সামান্য জায়গাটুকুতেই কোনোরকম লাশকে দাহ করে এখানে সমাহিত করা হয়েছে। আমি চেপে গেলাম যে আমি অই জায়গায় রাত্রে যাই।
উনি আমাকে সাবধান করে গেলেন যাতে লাইট ছাড়া কখনো বাইরে না যাই। বাস্তুসাপ সম্বন্ধে
আমি ভালোই জানি। আমার শৈশবের বাড়িতে একটা ইয়া বড় সাপ ছিলো। সবাই ভয় পেতো কিন্তু
আমার নানি সেইটাকে দুধকলা দিতেন। আর শুয়ে শুয়ে খেয়ে দিব্যি চলে যেতো। আমি দেখলেই
পালাতাম। এই জন্যই কিনা বেচারা আমার সামনে আসতে চাইতোই না। শ্মশানে ভূত থাকেই,
এইটা উনার জোর দাবি। আমি দাবিদাওয়া মেনে নিলাম। উনি চলে গেলেন।
রাত্রে লাইট নিয়ে গেলাম অই
জায়গায়। শীতের দিনে প্রসাবের বেগ এতো থাকে যে, কোনো দিগদিশা থাকে না। অনেকদিনের
অভ্যাস বলে ভুলে আগের জায়গাতেই বসে যাচ্ছিলাম। তখন, প্রতিদিন যা মনে হয় তা হলেও,
অখিলদার সাবধানবাণী কানে বাজলো। লাইট অন করে একটু সরে বামে মোড় নিতেই দেখি কালো
একটা আলোর রেখা সরসর করে চলে যাচ্ছে। ওমা, সেই সাপ, বিশাল সাইজ- চারফিটের কম হবে
না লম্বায়। আর বেড় প্রায় পাচ ছয় ইঞ্চিতো হবেই। আসতে যখন পা ফেলেছি ঠিক তখুনি, একঝাঁক পেঁচা এমন বিকট আওয়াজ করতে লাগলো যে আমি
প্রায় ভয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম। গা সওয়া পেচার ডাকে এমন ভয় কাজ করবে বুঝতেই পারি নি। কী
মনে করেরে আমি জীবনানন্দের কবিতাসমগ্র বের করে আবৃত্তি করতে থাকলাম। জোরে জোড়ে। আর
আশচর্য্য হলাম, পেঁচাগুলো শান্তধীর নীরবতার দিকে ঘুরে গেলো। পরে, পেচার ডাক থামাতে
আমি সকালে ওঠেই জীবনানন্দের কবিতাসমগ্র থেকে একটা পবিত্র পেঁচাবিষয়ক কবিতা তেলাওয়াত
করে আমার দিন শুরু করি।
No comments:
Post a Comment