জীবন্যাস
গত দুইদিন
অথবা দুইশত বছর যদিও তুমি পিরামিডের মতো স্থির থাকতে চেয়েছো, ভেতরে অনুভূত হয়েছে
ফেরাউনের মমির কম্পন। মরুতাপে উচ্চকিত ধ্বনি বার বার মিশে গেছে বালির প্রপাতে-
খুফু রে, রে ফেরাউন... ঈষৎ ফেটে-যাওয়া মমির ভেতর ঢুকে পড়েছে কয়েকটি উঁইপোকা; তোমার
মনে পড়েছে শৈশবের ইতিহাস বইয়ের সবুজ মলাটটির কথা। গত দুইদিন তুমি স্থির থাকতে
চেয়েছো অথচ দেখলে- তাড়া-খাওয়া পূর্ণিমা হঠাৎ ঢুকে পড়েছে তোমাদের কলাপসিবল গেটের
ভেতর। আহারে জ্যোৎস্না! এমন সুন্দরী রাতে কেবল মরে যেতে ইচ্ছে করে। তুমি ভাবো-
সুন্দরী চৌথাই নদীটি যেভাবে মারা গেলো... আর ঐ যে নারী কোনো এক ডুবন্ত বিকেলে বউ
হয়ে চলে গেলো দূরের গ্রামে। দূর পর্বতে দৃশ্যমান হলো ঝর্ণাগুলি- শুধু আত্মহত্যা
করছে গড়িয়ে গড়িয়ে। রক্তাক্ত তুমি ছায়া সন্ধান করো। দৃশ্যমান হয়- ফাল্গুনের চাঁদের
আলোয় তোমাদের গ্রামের উঠোনে আড়াআড়ি পড়ে আছে ডালিম ডালটির চিরল ছায়া। বাতাস বইছে
ছেঁড়া ছেঁড়া। ছায়াগুলি ছায়ার শিরচ্ছেদ করছে ধীরে। দেখতে পাও- তোমাদের বাগিচা
বাজারে লণ্ঠনের নিম-আলোয় ইলিশের পেটির মতো চিকচিক করছে ঘাতকের ছোরা। এ দৃশ্যে তুমি
নিদ্রা যেতে পারো না। বরং শুনতে পাও- তোমার শিথানের পাশে লাল-পাকুড়ে বৃক্ষের বয়স্ক
পায়ের আওয়াজ। তারা হাঁটচলা করছে; গুড়ি-কন্দের শব্দ থেঁতলে দিচ্ছে নৈঃশব্দ্য। দৃশ্য
উচিয়ে চলে যাও দৃশ্যান্তরে। লোহার গালিচায় বিষণ্ন বালিকারা বসে আছে। তাহাদের হাতে
নীল নয়নের নুড়ি। বুঝে উঠতে সামান্য সময় লাগে- বালিকারা কোটর হতে চক্ষুদ্বয় খুলে
ফেলেছে, বালিকাদের হাতে এখন মার্বেলের মাছি; তারা চক্ষু খেলায় মনোযোগী হয়- দপ্পা
এক, দপ্পা দুই... নির্ঘুম সারারাত ভাবিত হও- ঐ বন মর্মর আর হরপ্পা নদীর নির্মাণশৈলী
নিয়ে। তোমার হাতের কাছে প্যারামাকন, পাখিদের ঠোঁট; তোমার হাতের পাশে ম্রিয়মাণ
খাগড়ার কলম ছিলো। যুদ্ধ করেছো সারারাত অথচ কিছুই লিখতে পারোনি। তাকিয়েছো হাতের
কৈশিক শিরা উপশিরা আর রক্তপ্রবাহের দিকে। হস্তদ্বয় গুটিয়ে গেছে কেঁচোর মতো। তোমার
হাতে রঙিন কোনো কমলা নেই, শিশিরের স্তন নেই। আপাতত তোমার কোনো হাত নেই; পৃথিবীতে
আর কোনো হাতের অস্তিত্ব নেই। তোমার চোখ নেই, কান নেই, তোমার চারপাশে মুহীন
জোলেখা সুন্দরী কুহু কুহু রবে... তুমি তাকিয়েছো দূরতম দেশের দিকে- ঐ দেশে কিছুই
নাই বন্যাকবলিত পিতার কবর ব্যতিরেকে। তোমার ঘাড়ের ডানদিকে শিলং শহর। কে যেনো বলে
যায়- ঐ শহরে সরকারি দিঘিতে একটা নীলপদ্ম ফুটেছে; আর যে নারী যুবতী, তার জানালায়
সামান্য ঝুলে পড়েছে জুঁই আর শেফালির ঝোঁপ, বাঁ দিকে ঘাড় ঘোরাতেই তুমি বিমর্ষ হও।
ল্যাম্পপোস্টের ঘোলা আলোর ভেতর একপাল জন্মান্ধ পতঙ্গ উড়ছে, উড়ছে...
যে তোমার
বন্ধু ছিলো, প্রিয় কিশওয়ার এখন মৃত্যুর রাজা...
...সুবেহ
সাদিক ভরা মাঠ। অশ্বারোহী তুমি যাচ্ছো প্রভাতের দিকে। দূর গাঁয়ে ঝুলে আছে কুয়াশার
রেখা। শিশিরসিক্ত মাঠে হৃদকম্পন থেমে থেমেই শুনতে পাচ্ছো আর দিগন্তের দিকে মিলিয়ে
যাচ্ছে অচিন পশুদের মগ্নতার শীৎকার। দুরন্ত তোমার হস্তদ্বয় কে যেনো ঝাপটে ধরে
হঠাৎ। প্রাণপণ যুদ্ধ করো তুমি; কিছুতেই মুক্ত হতে পারো না। সে এক কালো মানুষের
হাত, হাতের কব্জি... শেষবারের মতো তাকিয়ে দেখো- লাল ঘোড়াটি তোমায় ফেলে রেখে
কুয়াশার গ্রামে মিলিয়ে যাচ্ছে।
কোনো এক
শাকিলা পাখির ডাকে তুমি ইচ্ছে করলেই এখন জেগে উঠতে পারো না। এখন তুমি আর কেউ না।
অথচ একদিন ছায়ার ঘনত্ব খুঁজতে যেয়ে লুকিয়ে পড়েছিলে ঝুনা নারকেলের পেটের ভেতরে।
নারকেলের ভেতরে জল; আসলে জল নয়, মেঘের মগজ। তুমি বসে থাকলে ফলের পূর্ণিমায়। নিজেকে
মনে হলো অনেক অনেক কুচবর্ণ অথচ অভিজ্ঞ, প্রাচীন শিলাখন্ডের মতো; মনে হলো তুমি এক
কুকাপত, বসে আছো কুকাশাস্ত্র হাতে; দুই কাঁধে দুইখ- অজগর যাদের রয়েছে নয়শত
মাথা...। মাঝে মাঝে উলঙ্গ দুপুরে তুমি আসন পেতেছো নীলনদের তীরে। প্রাচীন গুণীন
তুমি, উড়ন্ত কবুতর দুইখ- করে প্রেয়সীর পায়ের কাছে ফেলে দিয়েছিলে আর ঘর্মাক্ত তুমি
শিশির খুঁজেছিলে নারী সর্বংসহার বুকের গহিনে।
সময় চলে
গেছে; মহাকালের হা-করা গর্তের ভেতর সময় অনেক তো চলে গেছে। বহুবর্ষ আগে ঐ সুবেহ
সাদিকের মাঠে তোমায় চেপে ধরেছিলো ঐ যে হস্তদ্বয়, থামিয়ে দিয়েছিল রথযাত্রা তোমার,
পাঁজর ফুঁড়ে সর্বভুক যে শিকড় গুলি মুখের দিকে ধাবমান তা হলো বৃক্ষের দাঁত,
জিহ্বাবলি। ঠিক দুইদিন নয়, দুই হাজার বছর ধরে তুমি মানুষ নও; তুমি মূলত বৃক্ষের
আহার...
আলোচ্য পেটকাটা ঘুড়ি ও কমলা রঙের হাতি
পরম্পরা
একটা
পেটকাটা ঘুড়ির ভেতর বাতাসের মুখ আবিস্কার করতে পেরে আশির দশকের শেষের দিকে
চরকাসিমপুর গ্রামের একদল বালক ভাঙা দাঁত ও ছেড়া জিহ্বা বের করে যদিও হেসে উঠেছিলো
কিন্তু বড় হয়ে আকাশ ভর্তি শকুনের ঠোঁট ও মানুষের ছিন্নভিন্ন হা-পা-পাঁজর এবং মৃত
কুকুরের ছায়া প্রত্যক্ষণের পর চিরদিনের জন্য ঘুড়ি ওড়ানোর কৌশল ভুলে গিয়ে দলবদ্ধ
তারা যখন নগর মুখো হয় তখন কেউ কেউ সাঁকো ভেঙে জলের গর্তে অগত্যা হারিয়ে যায় এবং
দু-তিনজন ছাড়া সকলেই দশ-বরো বছরের ব্যবধানে
ভেসে ওঠে পৃথক পৃথক জল ও স্থলখ-ে- লেবাননে আফগানিস্তানে জয়দেবপুরে শমসেরনগরে এবং
যারা যাত্রা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয় তারা হাত ধরাধরি করে সড়কের পর মহাসড়ক পেরুতে
যেয়ে জ্ঞাত হয়- এ পন্থে চলাচলকারী প্রতিটি ট্রাক বাস মহিলা-বাসসহ অটোরিক্সা
হামাজীব নট-নটী এবং রাষ্ট্রপতি মহা-রাষ্ট্রপতিসহ সমগ্র বাংলাদেশের ওজন পাঁচটন করে অর্থাৎ
চরকাসিমপুর গ্রামের একটা তিনপায়া উনুনের ভেতর আগুনের ওজন অথবা গ্রামসুন্দরী
ভাবিটির স্তনের ওজনের সঙ্গে বিস্তর ফারাক অনুভব করে ঈষৎ বিস্মিত তারা মহাসড়কের
মধ্যবর্তী আয়ারল্যান্ডে দাঁড়িয়ে আপাতচঞ্চল ডানদিকে তাকিয়ে বাঁ দিকে ঘাড় ঘুরাতেই
কমলা রঙের হাতিগুলোর কথা ভুলে গিয়ে পেটকাটা ইঁদুরের ভেতর দলবদ্ধ মানুষের
লুকিয়ে-পড়ার-দৃশ্যে বেশ আশ্বস্থ যদিও তবু মনে পড়ে যায়- প্রতিমাসে আঠারোবেলা ভাত
খাওয়ার জন্য কমপক্ষে বিশটি সাপ ধরে কোনো প্রযত্নে যখন জীবনধারণ অসম্ভব হতো তখন
প্রতি বর্ষা-মৌসুমে কয়েক মণ ঘাড়–-ব্যাঙ ধরে কয়েক মণ ভাঙাধানের বন্দোবস্ত করতে
হতো... তারপরও তাদের নির্জন পল্লীতে পূর্ণিমা
আসতো আর ধবল উঠোনে আগুনে-পোড়া পূর্ব পুরুষের মুখ ভেসে ভেসে পুনরায় মিলিয়ে
যেতো... বেড়ালের হর্ষধ্বনি হতে অনেকগুলো নতুন বেড়ালের জন্ম হলেও কোনো এক প্রত্যুষে
নিদ্রা ভেঙে তারা নিরাধারা কান্না করেছিলো... ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ হতে হতে বাকরুদ্ধ
হয়েছিলো... এখন যদিও তা মনে নেই তবে নিগূঢ় দৃশ্যকল্পটি কিছুতেই ভুলতে পারে না এ
জন্যে যে- ঐ রাতে বেড়াল জননী তার সদ্যপ্রসূত ছানাটির মাথা ও ঘাড়সহ তলপেটের
অংশবিশেষ গিলে খেয়েছিলো এবং তা প্রত্যক্ষরণের পর অপ্রতিরোধ্য বিবমিষার সময় তারা
বুঝতে পেরেছিলো- মানুষ তার সারাটা পাকস্থলী সরু ছিদ্র দিয়ে উগলে দিতে পারে কিন্তু
পাকস্থলী হতে বেড়ালের মাথাটা উগলে দেয়া প্রায়-অসম্ভব...
No comments:
Post a Comment