ব্রহ্মপুত্রের
ডাকে
সারারাত ট্রেনে দোলদুলুনি কু
ঝিকঝিক। দুটি শিশু আমাদের আঁকড়ে, আমরা তিনজন বার্থে গুটিসুটি। সন্ধ্যে রাতে ভাঁপে
ভ্যাপসানো, হাফ বয়েল ডিম। শেষ হেমন্তের আচ্ছা রসিকতা ! বাইরে তাকালাম মাঠ ঘাট
পাহাড় উপত্যকা কালচে ধোঁয়ার বালাপোষ গায়ে। ঝিমুচ্ছে ঝিমঝিম আফিমখোরের মতন। ট্রেনের
হুইসেল আত্মা কাঁপানো ঝিম ধরানো। সঙ্গীরা ঘুমের আঁতাতে, আমার ঘুম নেই। বঁধুয়া নিদ
নাহি আঁখি পাতে ! রাত গড়িয়ে গড়িয়ে চলছে মানে গড়াচ্ছে। একই বার্থে দুটি বাচ্চা সহ
আমি। তাই হাঁচড়পাঁচড় ওদের শুইয়ে পাহারা পড়ে না যায়। সঙ্গী দুজন নাক বাজাচ্ছেন
তালে বেতালে। ধন্যি বটে !
এবার যেন শীত শীত গায়ে কাঁটা!
ব্যাগ হাতড়ে গায়ের কালো চাদর হাল্কা গায়ে চড়ালাম। হাল্কা খরগোস নরম ব্ল্যাঙ্কেটে
বাচ্চাদের জড়িয়ে দিলাম। কামরাটা এবার জড়োসড়ো আঁটোসাঁটো ঘুমন্ত। কোন স্টেশন জানি
না, চা ...গ্রম...হাত বাড়িয়ে দাও এক কাপ। উপর থেকে না না তিন ...যা শীত বাবা!
জব্বর! ঘুমোওনি তোমরা ... তবে যে নাক...। ভেঙ্গে গেলো কী শীত! ব্ল্যাঙ্কেট
নাও...দাও না মাইরি ...প্লিজ...! দিচ্ছি, বকবক না ...বাচ্চারা।
আবার ঝিমঝিম সবাই ঘুমে। এবার সত্যি ঘুম। রাত জমজমাট জানালায়। গাঢ় হচ্ছে ক্রমে অন্ধকার, ফুটি ফুটকি আলো এই দেখি এই নেই। সরলরেখায় ছুটছে জোনাকি! চোখের পাতা ভারি ভারি শীত গা কামড়ানো। হঠাৎ ও কে? কালো জোব্বা কালো মুখোশ চোখ দুটি ফোঁকরে জ্বলছে পিস্তল হাতে। নিশানা আমি। গয়না খোল, সবগুলো শিগগির দে শিগগির। ও এই, চাদরের ঘেরাটোপ থেকে দুহাত বাইরে শাঁখা পলা লোহা! কিস্যু নেই, গলা কান সুনসান রিক্ত শীতের মুক্ত শাখা! ফোঁকরের চোখ দুটো মরা মাছের। জোব্বা ঢাকা শরীর দুলছে হতাশায় ! ব্যাগটা দে, দিলাম, আমার ভেতরে হুলুস্থুল সিঁটিয়ে যাচ্ছে আত্মা আতঙ্কে! খুলছে ছুঁড়ে ফেলছে চিরুনি ছোট্ট মুখদেখা আয়না কিছু চুলের ক্লিপ কৌটো কোল্ড ক্রিম মুখ মোছার রুমাল কবিতার ডায়েরি পেন আর একটা কৌটো নারকেল নাড়ু বাচ্চারা খাবে বলে মাসীমা দেন! সর্বসাকুল্যে ব্যাগের সম্পত্তি।
ডায়েরির উপর আক্রোশ! পিস্তল
পকেটে চালান ফরফর ফরফর ছিঁড়ছে! হায় গেল গেল ও ভাই ওটা কি দোষ করলো? প্লি ...জ ...পদ্যি
লিখিস? তাই কিসসু নেই গড়ের মাঠ ঠনঠনে! দুটো নাড়ু খেয়ে নাও প্লিজ ওটা দিয়ে দাও। নে
নে কী অবহেলা, আমার হাতে ডায়েরি ছেঁড়াপাতা গায়ে আগুন। এই শোনো চিৎকার করে সবাইকে
বলে দিচ্ছি খেলনা পিস্তল হা হা! মাইরি বলিস না পিলিজ গুঁড়িয়ে ফেলবে একগাড়ি লোক...।
পালাতে গিয়ে পড়বি পড় মামদো লোকটির ঘাড়ে...! ঘামছি আমি নিচে থেকে পিস্তল আমার হাতে।
আরে এটা নিয়ে যাও না আমার চিৎকার...। কী হলো? কে কি নেবে? আমি গোঁ গোঁ করছি জাগো
জাগো, আরে বাবা বসে বসে এমন ঘুম? আবার স্বপ্ন ! বোবায় ধরলো? ভ্যাবাচ্যাকা আমি আরে
সত্যিই লোকটা নেই তো! আমার হাতে খোকার খেলনা পিস্তল ব্যাগ থেকে জিনিস বের করতে...!
আমার ঠোঁটে চিলতে লাজুক হাসি গা ঘিনঘিনে ঘাম। শুয়ে পড়ো রাতের একদম শেষ আমি আছি
বললাম!
আবার জানালা আসুক ঠাণ্ডা তবু বেশ। আসছে খোলা মাঠের কুণ্ডলী পাকানো ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা কুল কুল কুয়াশা ! পেঁচিয়ে জানালা গলিয়ে আমাকে জড়িয়ে কামরায় সেঁধিয়ে। আসুক। অভিনব অভিজ্ঞতা ! যাচ্ছি আমরা ডিব্রুগড়। আর হয়তো ঘন্টা খানেক একটু কম বেশি। অনেক পুরনো শহর নাম আছে। কিন্তু শহর দেখা শখ না, নদ দেখবো ব্রহ্মপুত্র।বুঝি না নদ আর নদী আলাদা কিভাবে? পুরুষ নারী? কিভাবে? অনেক ভেবেও ঠিকঠিকানা অধরাই মানে বুঝতে পারিনি। ব্রহ্মপুত্র ডিব্রুগড়ে সবচে বেশি চওড়া আর পৃথিবীর একমাত্র নদী গঠিত দ্বীপ এখানে, মাজুলি দ্বীপ ! দেখার সাধ কতোদিনের আজ দেখা হবেই !
তর সইছে না, রাত পোহাতে কত দেরি? ঝাপসা আকাশ শীতল বাতাস কুয়াশার মাতলামি ! এরই মাঝে অবাক নির্বাক ! পৃথিবী কতবড় সিঁদুর টিপ পরেছে দেখোনা ! পৃথিবী কি নারী? নারীই হবে, এর সমার্থক সব বাংলা শব্দ কি বলে? জানা মত ধরিত্রী বসুন্ধরা বসুধা আরো বহু স্ত্রীবাচক শব্দ বলেই জানি। নারীর মত কত বৃক্ষ লতা গুল্ম তৃণ এসবের জন্ম দেদার দিচ্ছেই পৃথিবী। এবার ঝাপসা আলো, এইতো দেখো দিগন্ত ছোঁয়া ধানের ক্ষেতে লেগেছে দোলা। পোয়াতি পৃথিবীর অন্নপূর্ণা মূর্তি! ওরেএএএ বাবা কেমন হাঁড় কাঁপানো শীত! শেষ হেমন্তে! শীতটা কেমন জবুথবু হবে বা! সূয্যিঠাকুর এখন আর সিঁদুর টিপ নয়। মায়াবী। এমনি পৌঁছে গেলাম ইস্টিশনে। আহা! ' ইস্টিশনের মিস্টি কুল / শখের বাদাম গোলাপফুল। '
'চায় চাহিয়ে গ্র..ম....চায় .....' 'কুলি চাহিয়ে কু...লি..' ' বাদাম ...মংফুলি ...ই...ই...'! সনাতন ভারতের স্টেশন! শব্দে জনতার ব্যস্ততায় জমজমাট ভারত ! কে কাকে দেখে! 'কেবা আগে প্রাণ করিবেক দান', 'থুড়ি চাচা আপন প্রাণ বাঁচা'... অতি কষ্টে মহাযুদ্ধ শেষে ঠেলে দুমড়ে মুচড়ে সপুত্রকন্যা বেরোলাম। হামারা দেবরজী ঔর গাইড শ্রীমান অমল এবার স্বমূর্তিতে' চাহিয়া দেখো রসের ধারা বহিছে নিরন্তর'...। হ্যাঁ বইছে ছুটছে ছলকাচ্ছে! এই জনারণ্য মহারণ্য থেকে বেরিয়ে সোজা দুটো রিক্সো পাকড়াও। নাহ্ বলা উচিত রিক্সো আমাদের পাকড়ালো। সামনে দুজন মরদ জোয়ান, পেছনে আমি হাফ দুগ্গা! ভুল বলছি না রিক্সোওলা তো মা দুগ্গাই বললো! 'আইয়ে মা জননী দুগ্গা, বৈঠিয়ে...'! কোলে আমার শ্রীমান, পাশে কন্যা, হাফই বটে! তর সইছে না নাহেজাল আর কতদূর তুমি ব্রহ্মার পুত্র হে ! পেটে দৌড়াচ্ছে রাশ রাশ নেংটি, থুড়ি গনেশকা বাহন! বাচ্চা দুটি ঘ্যান ঘ্যানর! অমল পেছনে তাকিয়ে কি যেন বলল। শুনতে পেলাম না, শোঁ শোঁ ঝড়ের আওয়াজ মন কুঁকড়ে। শীতটাও বেমক্কা বাড়াবাড়ি। দেখলাম ওরা দুজন নেমে পয়সা দিচ্ছে। মানে? এসে গেছি! আমরাও নামলাম, রিক্সোর ভাড়া দেবেখন! আগে দেখি!
একী কোথায় কী! সামনে ধু ধু
কুয়াশা কুয়াশা আর কুয়াশা! নেই নেই কিচ্ছু নেই! ও অমল কোথায়? এই তো সামনে, এই তো
নদী! কোথায় নদী শোঁ শোঁ আরো ভারি গর্জন, কোথায়? বাঁধের মত, মত নয়
রীতিমতো বাঁধ! পার হয়ে সামলে নামলাম। চোখ কচলানো হলো। ও মা! এ কী দেখছি? ঢেউ ঢেউ
আর ঢেউ ...তরঙ্গ মহাতরঙ্গ ...! কূল নাই কিনার নাই শুধু জল আর জল! ওপারও নাই! এযে
দেখছি মহাসমুদ্র। এ কে নদী বলে? ওপারের চিহ্ন সীমারেখা কিচ্ছু নেই ! শুধু
অসীম অনন্ত জলরাশি। মহাপয়োধি ! এর আগে গৌহাটিতে ব্রহ্মপুত্র দেখেছি ! এমন তো
দেখিনি ! একটা ঠাণ্ডা হাওয়া হাত পা জমানো। অজান্তে হাত. জোড় হয়ে গেলো। কাকে প্রণাম
করলাম জানি না। শুধু আমার সমগ্র আমি একত্রিত হয়ে যেন অবনত হলো, অস্পষ্ট
উচ্চারণ, ' হে বিশাল প্রলয় পয়োধি, ক্ষুদ্র এই আমার প্রণাম গ্রহণ করো ! '
স্বপ্ন সত্যি হলো, সত্যি হবার
আনন্দে উথালপাথাল। শুনেছি পড়েছি ব্রহ্মপুত্র ডিব্রুগড়ে সবচেয়ে প্রশস্ত, কিন্তু এতো?
কল্পনা হার মানলো যে! মাজুলি? এতোবড় নদী গঠিত দ্বীপ আর নেই। দূর থেকে সবুজে সবুজে
মাখামাখি বহু দূরের মাজুলিকে দেখলাম। বাহ্! এও তো কম যায় না ! কল্পনা হার মানে।
ওখানে যাবার জন্য লঞ্চ মেলে। আজ আমাদের কপাল মন্দ, লঞ্চ যাবে না ভারি কুয়াশা
চারদিকে। নৌকো করে যাবার কথা কেউ কেউ ভাবছিলেন। ছোট বাচ্চা নিয়ে আমরা রাজি হলাম না
যদিও মাঝি মাল্লারা বলছিলো এখন তো প্রায় শীত, নদী শান্ত। বর্ষায় উত্তাল ঢেউয়ের
দিনে ওরা কত্ত যায় আসে। কিন্তু কোন যাত্রী সায় দিলে না, গেলো না। এই যদি নদী শান্ত
হয় তো অশান্ত কাকে বলবো? যাকগে আবার কোনদিন হবে বা!
এবার পেটের ছুঁচোগুলোকে শান্ত করার ব্যবস্থা করতেই হয়। আহারে, আমাদের কপাল সত্যিই মন্দ। মাজুলির মাটি ছোঁয়া হলো না, দেখা হলো না ওখানকার বিচিত্র জনজীবন। খাবার দোকানগুলিতে ঠাঁই নেই ঠাঁইটুকু নেই। কোনও কোনটির খাবার শেষ, তল্পিতল্পা গুটিয়ে নিচ্ছে । এদিকে ওদিকে তল্লাশি করে দেখা গেলো ঐ কোণে একটা প্ল্যাকার্ডে লেখা' বুড়িমার দোকান আসুন'। অমল ছুটে গেলো, দেখেশুনে হাতে ডাকলো। ইতিবাচক। যদিও দোকানটার হালহকিকত বেজার হবার মত, তবু গত্যন্তর নেই। গেলাম সপরিবারে। বসার ব্যবস্থা আছে, ডুমো ডুমো কেটে বাঁশের বেঞ্চ, তেমনি টেবিল। প্রত্যাশার চেয়ে বেশি পরিচ্ছন্ন। অন্য দোকানে দাঁড়িয়ে হাতে নিয়ে খেতে হয়। রান্না করে সব্জি পরোটা বাড়ি থেকে নিয়ে আসে পাত্র করে, শেষ হলে শেষ। কেবল স্টোভের গরম চা। বুড়িমার দোকানে মাটির তোলা উনুনে এই নদীতীরেই রান্না হচ্ছে। গরম গরম পরোটা, তরকারি আর আচার। অন্য দোকানে আচার নেই। খেতে গিয়ে দেখেছিলাম এমন স্বাদের আচার মেলা ভার, জেনেছিলাম বুড়িমা ঘরে নিজে বানায়, কেনা কৌটোর প্রিজারভেটিভ দেয়া আচার নয়। আগেকার দিনের ঠাকুমা দিদিমার হাতে তৈরি আচারের মত। খাবার দেয়া হয় পরিষ্কার ধোয়া ইউজ এ্যাড থ্রো কলাপাতায়। অন্যরা দেয় প্লাস্টিকের প্লেটে। বুড়িমা দেয় কাচের ঝকঝকে গ্লাসে জল টলমল। অন্যেরা প্লাস্টিকের গ্লাসে। অন্যদের তুলনায় সবকিছু সুপার্ব। কিন্তু ...খদ্দের কম আসে। ডেলিভারিতে দেরি হয়, এতো সময় ধৈর্য কার থাকবে? তবু এখানেই বসলাম আমরা, তাগিদ নেই, তাড়া নেই। বরং একটু বেশি সময় ব্রহ্মপুত্রের ঢেউয়ের মহিমা দেখা যাবে!
দেখছিলাম, তন্ময় হয়ে
যাচ্ছিলাম! হঠাৎ দেখি দুটি অগ্নবর্ষী চোখ আমাকে যেন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দেবে!
বুড়িমার চোখ! ' তাড়াতাড়ি খেয়ে পয়সা ফেলে পালাও'...ধমকে উঠলো বুড়ি মা। আমরা থতমত।
যে ডুমো ডুমো চালকুমড়োর সাথে কড়াইশুঁটি আর সয়াবিনের মাখামাখা তরকারি অমৃতের মত
লাগছিলো, আচারটা দারুণ টেস্টি মনে হচ্ছিল, এখন যেন তা পানসে বাজে মনে হলো। কারও আর
খাওয়া পুরো হলো না আমাদের। দাম ফেলে বেরিয়ে এলাম। কানে এলো বুড়ির চিৎকার., 'পিরিতি
দেখাচ্ছে ব্রহ্মদৈত্যর সাথে ! জানে না তো মানুষখেকো এই নদীটাকে! হায়রে আমার পরাণ রে,
ও বাবা ফিরে আয়রে...'। নদীতীরের কাদাবালিতে লুটোপুটি বুড়িমার বুক চাপড়ে সেকী আকাশ
পৃথিবী কাঁপানো উতরোল কান্না! .. .
অন্যদের কাছে জেনেছিলাম ব্রহ্মপুত্রের প্রতি কোন দর্শকের অতিরিক্ত মুগ্ধতা দেখলে বুড়িমা এমনি পাগল হয়ে যায়। বুড়িমার একমাত্র ছেলে পরাণ তার বৌকে নিয়ে ছোট ডিঙি নৌকো নিয়ে এক কুয়াশায় আচ্ছন্ন সকালে বেপরোয়া হয়ে মাজুলি দ্বীপে যাচ্ছিলো। বুড়িমার হাজারো কাকুতি মিনতি শোনেনি। পরিণতি বিকট ঘূর্ণিতে পড়ে নৌকোসুদ্ধ সেই যে ডুবলো, আর ওঠেনি। তারপর থেকে এমনি চলছে। আমরা বাকরুদ্ধ!
উদ্গত অশ্রু রুমালে মুছে আমরা এগিয়ে গেলাম। বিদায় ব্রহ্মপুত্র, তুমি এতো নিষ্ঠুর কেন? অনুচ্চারিত প্রশ্ন বুকের অন্দরে বাজতে লাগলো ঝিমঝিম। আমরা এগোলাম। আপার আসামের ডিব্রুগড় জেলা সদরের মেডিকেল কলেজ, ডিব্রুগড় ইউনিভার্সিটি আর টুকিটাকি দেখে রাতের ট্রেনেই রওনা দিতে হবে ডিগবয়ের উদ্দেশ্যে। ভুলবো না তোমাকে ব্রহ্মপুত্র আর ভুলবো না তোমাকে বুড়িমা।
No comments:
Post a Comment