বুড়ি সারারাত কাশে। একনাগাড়ে। থেমে থেমে।
শ্লেষ্মাটুকু উগরে ফেলার শক্তি পায় না। শেষ হেমন্তের ঠান্ডা বাতাস শিরশির করে ভাঙা
চাটাই বেড়ার ফাঁক গলিয়ে ঝুপড়িতে ঢোকে। বুড়িকে আরও কাবু করে দেয়। অবসন্ন হাতের আঙুলগুলোর
স্থবিরতা বৃদ্ধি পায়। ওরই মধ্যে আধছেঁড়া কম্বল
টেনে টেনে গায়ে জড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা। ঝুপড়ির দক্ষিণ দিক ঘেঁষে একটি বাচ্চা কুকুর সামনের
দু-পায়ে মাথা গুঁজে কুণ্ডলিত শুয়ে থাকে। বুড়ির কাশির গমকে কুঁইকুঁই আর্তনাদে সাড়া দেয়।
বুড়ি কুণ্ডলিত শুয়ে থাকে। বিড়বিড় করে। অনন্তকাল দূর থেকে ভেসে আসা স্বরে ডাক দেয়,
‘ভগবান ভগবান’। সে ঘুমোয় না। ঘুমোতে পারে না। কান পেতে শোনে। পাশের বাড়ির টিনের চালে
শিশির পড়ছে; টিপ্ টিপ্ টিপ্। রাতের নিস্তব্ধতার মধ্যে ভয়ংকর হয়ে শোনা যায়। বুড়ি দ্রুত
স্পন্দিত হৃদপিণ্ডের নিস্তেজ ধুকপুকে কখনো নিজেই চমকে ওঠে। সে তা হলে বেঁচে আছে!
দূরে সিনেমা হলের নাইট শো শেষে লোকজনেরা হল
থেকে বের হয়ে যায়। ভেসে আসে তাদের কণ্ঠস্বর। হট্টগোল আর উল্লাসী চিৎকার। বুড়ির কানের
পর্দায় সে-সব বিস্ফোরণের মতো হামলে পড়ে। শিস্ দেয়া শব্দে হঠাৎ থেকে থেকে বাতাসে আন্দোলিত
কলাগাছের পাতাগুলো ঝুপড়ির সঙ্গে সংঘর্ষ করে। বুড়ি কখনো খুব মনোযোগের সঙ্গে কান পেতে
শোনে। তারপর সেই উৎসুক মন আনমনা হয়ে যায়। অদৃশ্য ভাবাবেগে তার মন পেছনের দিনগুলোয় সুখ
হাতড়ে বেড়ায়। অনুভবের সমগ্র স্নায়ু অমসৃণ হয়ে পড়ে। দূর আকাশের গায়ে তারাগুলো মিটমিট
করে আর ঝুপড়ির ছেঁড়া চটের চালের ফাঁক গলিয়ে কখনো ঝাঁপসা কখনো উজ্জ্বল লাগে। তাকে কোনো
স্বপ্নের জগতে নিয়ে যেতে চায়। তার ঘুম আসে না। সে ঘুমোয় না। শুধু কাশে। কেশে কেশে হাঁপিয়ে
ওঠে। ছোট ছোট বদ্ধ নিঃশ্বাস ক্ষীণভাবে ছেড়ে ছেড়ে বিড় বিড় করতে থাকে, ভগবান ভগবান।
সন্ধ্যেয় জগা বলেছিল, রাতে নাকি মধু এনে দেবে।
অথচ ছেলের দেখাই পেল না। অবশেষে মধ্যরাতে কাশতে কাশতে নাচার হয়ে একবার চেঁচিয়ে ওঠে,
-
‘জগা এলি বাপ, মধু এনেছিস্ ব্যাটা?’
কতবার চেঁচিয়েছিল মনে নেই। মানসী একসময় ঘর
থেকে ছুটে এসে ঝাঁজালো গলায় বলে, -
‘কি...কি হয়েছে এই রাতবিরেতে? মধু? আপনার
ছেলে মধু আনবে? দেখেন গিয়ে গিলে এসে ঘরের কি হাল করেছে! ভালো পুত্তুর পেটে ধরেছিলেন!
মরণ...মরণ হয় না কেন আমার?’
‘তুই কেন মরবি মা, আমাকেই মরতে দে। থাক মা
মধু লাগবে না। যদি পারিস একটু গরম পানি দিস। কাশিটা আজ খুব জ্বালাচ্ছে। মনে হচ্ছে এর
চেয়ে মরে যাওয়াই বোধহয়...।’
‘সে আমি এখন পারব টারব না। মাঝরাতে চুলো ধরাব,
না নবাবজাদার বমি পরিষ্কার করব এ্যাঁ!’
‘থাক মা থাক, তুই যা, কিছু লাগবে নাকো; জগাকে
দেখ।’
বুড়ি আরও জড়সড় কুণ্ডলিত হয়ে শোয়। থিরথির করে
কাঁপে। পাঁজরের সবটুকুতে চাপা ব্যথা। আপন মনে বিড়বিড় করে, -
‘ভগবান এ যন্তোনা থেকে তুলে নে, তুলে নে আমাকে;
সেই কবে থেকে কাশ আর ভালো হয়ে কাজ নেই।’
বুড়ি চালের ফাঁক দিয়ে আবার আকাশে দৃষ্টি রাখে।
ঠিকমতো দেখা যায় না। চোখের আলো কমে গেছে। যাবেই তো! তবু বোঝা যায়, মধ্যরাত; আকাশে তারার
মেলা। কুয়াশাভেজা কোনো কোণায় হয়তো একটি চাঁদ জেগে আছে। তার কোমল আভায় অদ্ভুত আলোছায়া
আচ্ছন্ন করে রেখেছে চারপাশ। নিঃসঙ্গ একাকী নিস্তব্ধ আর ভয়ানক। শিরশিরে কোনো ভয় বুড়ির
অন্তর কাঁপিয়ে দেয়। সে বার বার আকাশে নিমগ্ন হতে চায়। দেখা যায় ছায়াপথ। অনেক আলোময়...স্বর্গের
রাস্তা। মাঝে মধ্যে কাশির গমকে চোখে জল এসে তার দৃষ্টি আবার ঝাঁপসা করে দিতে থাকে।
তখন কোনো আকাশ নেই। কোনো তারা নেই। তারাদের আলো নেই। শুধু কি সব অদ্ভুত ছবি ভাসে দুচোখের
সামনে। হয়তো অতীত। অথবা কোনো না বলা কথার চলমান চিত্র।
জগন্নাথের বাবা মারা যাবার পর সে একলা অকূল
সাগরে পড়েছিল। কী করবে কোথায় যাবে ভেবে সুরাহা পায় না। এর বাড়ি ওর বাড়ি ঠিকা ঝি’এর
কাজ শেষ করে রাতে নিজের ঘরে কাঁথা সেলাইয়ে বসতো। বস্তির আর দু-চারজন মহিলা বলে, -
‘জগার মা অতো খেটো না...একটু শান্তি দাও শরীরে...আরাম
করো।’
সে হাসত। সে হাসি কষ্টার্জিত করুণ। হাসি না
কান্নার স্ফুরণ? সে জানে না। শান্তি আর বিশ্রাম হলো কোথায়? বড় দায়িত্ব তার জগন্নাথকে
নিয়ে। তখন ওর বয়স কত? সবে এগারোয় পা দিয়েছে। স্কুলে পড়ে। একদিন জগা বড় হবে। বড় চাকুরি
করবে। সমাজে মানুষের মতো সম্মান পাবে। তখন তার দুঃখ থাকবে না। নিজেরও নিরাপদ জীবন থাকবে।
সে কত কি ভেবেছিল! প্রচণ্ড আশার বলে প্রাণের প্রতিটি রক্তকণায় ছিল অপরিমেয় শক্তি। বেঁচে
থাকার দৃঢ় প্রেরণা। একদিন ছেলে তাকে সকল কষ্টের বিনিময়ে আনন্দ এনে দেবে। সেই তো বিধবার
একমাত্র অবলম্বন। অনাগত স্বপ্নময় দিনের কথা ভেবে শত লাঞ্ছনা গঞ্জনা নীরবে হজম করে গেছে
তাই।
অথচ কি ছিল বিধাতার মনে! ছয় ছয়টি বছর পর কৈশোরের
শেষ প্রান্তে এসে জগন্নাথ বদলে গেল। লেখাপড়া না করে হাউজি লটারি আর নিত্য নতুন বন্ধুদের
নিয়ে মত্ত। মা হয়ে সে কি জানত ছেলের বদলে যাবার কথা? মনে পড়ে না। হয়তো সে কোনোকিছু
জানত না কিংবা জেনেও গুরুত্ব দেয়নি। জগা মাঝে মধ্যে টুকিটাকি বাজার, এই ইলিশ কিংবা
কচি পাঠার মাংস ইত্যাদি এনে দিত। আবদার করত, মা ভালো করে
ঝালেঝোলে রাধো তো, দুপুরে একজন বন্ধু খাবে। কখনো তার সার্টের পকেটে দু-চারখানা বিশ
পঞ্চাশ টাকার নোট। এসব দেখে প্রচ্ছন্ন খুশির চাপা ড্রাম তার বুকেও বেজেছে। ছেলে পড়ালেখার
ফাঁকে দু-চার টাকা রোজগার করতে শিখেছে, ভালোই তো! কিন্তু ভাবনা আর বাস্তব...দুস্তর ব্যবধান। চাপা উল্লাসের মধ্যে নাছোড়বান্দা
কোনো আশঙ্কা কিংবা খুঁতখুঁতে প্রশ্ন মনকে কামড়াতে থাকে। কোনোদিন ছেলের মন মেজাজ দেখে
জিজ্ঞেস করে বসতো, -
‘এত
টাকা কোথায় পেলি?’
‘এক
বন্ধুর বায়োলজি খাতায় ড্রইং করে দিলাম তো, সে দিয়েছে।’
‘আর
যাই কর বাবা, নিজের পড়ালেখার ক্ষতি করিস না।’
‘সে
তুমি চিন্তা করো না মা।’
ছেলে খুব স্বাভাবিকভাবে এমনই জবাব দিত। নয়তো
টিউবওয়েলের পাড়ে যাবার ব্যস্ততা দেখিয়ে প্রশ্নের পাশ কেটে যেত। সে ছেলেকে বিব্রত হতে
দিতে চাইত না। তার বড় আদরের ধন। একটি তো সন্তান...অনাথ। সে ছেলের জন্য কী করতে পারল?
আহা এই ছেলেই তার একমাত্র অবলম্বন! এর জন্যেই সে বেঁচে আছে!
কোনো একদিন জগার সার্ট ধুতে গিয়ে পকেটে আকস্মিক
আবিষকৃত হলো কতগুলো শ টাকার নোট, যা সে নিজেও কোনোদিন একসঙ্গে দেখেনি। অনেক বাদানুবাদ
হতে পারত, কিন্তু ছেলেকে সে কিছু জিজ্ঞেস
করতে পারল না। পাছে হিতে বিপরীত হয়! ছেলের
টেবিলে খুব গোপনে যেন চুরির ধন সেই টাকা রেখে দিল। তারপর সারারাত নানান দুর্ভাবনায়
নির্ঘুম নিজের সঙ্গে লড়াই। এই করে হাঁপিয়ে প্রাণান্ত। অবশেষে নিয়তির হাতে সবকিছু ছেড়ে
দেয়া ছাড়া কোনো বুদ্ধি পেল না। ভেবে নিল, একদিন জগা আপনা আপনিই ঠিক হয়ে যাবে। বয়সের
তো সামান্য দোষ থাকে...ছেলেমানুষ!
জগন্নাথ ঠিক হলো না। যা তার ভাবনা, মনের গহিনে
সযত্নে লালিত স্বপ্ন, সব কাঁচের মতো নিমেষে ভেঙে গেল। দিন যখন খারাপ যায়, ঈশ্বর বুঝি
উপর থেকে অট্টহাসি দিতে দিতে ভ্রুকুটি করে। ছেলের পড়ালেখা শিঁকেয় উঠল। পড়ালেখা ভালো
লাগে না...মন বসে না। বিরক্তিকর কঠিন কাজ। সে স্কুলের নাম করে সাইকেল মেকানিক শামসুলের
দোকানে বসে থাকে। বিড়ি খায়। মেকানিকের কাজ করে। ওই খবর বাতাসে ভাসতে ভাসতে অনেক দেরিতে
পৌঁছল তার কাছে। তার চোখ ফেটে পানি ঝরে। কাঁদতে কাঁদতে ছেলেকে অনেক বোঝাল। অনুরোধ উপরোধ।
কোনো কাজ হলো না। জগা রিকশা সাইকেল সম্পূর্ণ খুলে আবার সাজাতে পারে। নতুনের মতো ঝকঝকে
করা তার অল্প সময়ের কাজ। এই কাজে টাকা আছে। বিদ্যে নিয়ে কী হবে? কোনো চাকুরি তো জুটবে
না। মেকানিকের কাজ করতে করতে একদিন বাস ট্রাক খুলে আবার জোড়া লাগাবে। একটি গ্যারেজ
থাকবে তার। তার মতো গরিব ঘরের লোকজন কাজ করবে সেখানে। এই স্বপ্ন যে অলীক কল্পনা সে
কিছুতে ছেলেকে বোঝাতে পারল না। জগা তখন রোজগার করছে। টাকার চকচকে মুখ দেখেছে, সে কি
অসহায় মায়ের কথা শোনে? দুঃখ বোঝে? হয়তো তার মনেও স্বপ্ন-কল্পনার ছায়া রেখাপাত করে থাকবে।
কিন্তু একদিন সব ভেঙে গেল।
জগা বছর দেড়েকের মাথায় রিকশা ধরল। ছেলেকে নিষেধ করার ক্ষমতা তখন নেই। শরীর ভেঙে পড়েছে।
ভোরবেলার খুসখুসে শুকনো কাশি কিছুতে সারে না। হাসপাতালের ওষুধ গিলে গিলে পেট পচে গেছে।
নিয়মমতো রোজ বিকেলে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর। সে তখন বোঝে, দিন শেষ। পরাজিত সত্ত্বায় আত্মসমর্পনের
ডাক। বুড়িয়ে গেল সে কয়েক মাসেই। অস্থির এলোমেলো জগা, তার
আদরের ছেলে কখনো কখনো বলে, -
‘দেখ মা, তোকে আমি ভালো ডাক্তার দেখাব, সুস্থ করে তুলব। তুই ছাড়া আমার কে আছে?’
ডাক্তার দেখিয়েছিল। যতটুকু তার সামর্থ। সে
কিছু বলেনি। তারপর পরাজিত মনে সুপ্ত আশা। আবার একদিন সে ভালো হয়ে উঠবে। উঠে দাঁড়াবে।
শক্ত করে ধরবে সংসারের হাল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো
না। ক্রমে ইত্যাদি আশাগুলো মরে যেতে শুরু করে। তার স্বাপ্নিক চোখে বাসা বাঁধে ফ্যাল
ফ্যাল চাহনি। সে দৃষ্টির প্রান্ত বেয়ে নেমে যায় অবাধ্য নোনা জল। ভাষা তখন বোবা। জগা
অকূল পাথারে পড়ে। ছেলে যে গোপনে একাকী ফুঁপিয়ে কাঁদে, সে বেশ বুঝতে পারে; অথচ মা হয়ে
সে কিছু করতে পারে না। এই যন্ত্রণা তাকে আরও শুকিয়ে মারে। তবু সে ওষুধ খায়...বাঁচতে
চায়। সবকিছু নতুন করে সাজানোর স্বপ্ন দেখে।
জগা বাসায় খুব একটা থাকত না। সকালে মডার্ণ
মোড়ের রেস্তোরাঁ থেকে ক-খানা লুচি আর তরকারি এনে তাকে খাইয়ে বেরিয়ে যেত রিকশা মহাজনের
বাড়ি। কোনোদিন দুপুরে ফিরে ব্যস্ত হয়ে তার খোঁজ নেয়, কোনোদিন রাতের আগে ছেলের দেখা
নেই। তবে তার দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করে রাখত। যেটুকু
সময় বাসায়, ছেলে তার কাছে এসে মাথা তুলে ধরে ওষুধ পথ্য খাইয়ে দেয়। সে মুখে ওষুধ নিয়ে
অনেককিছু ভাবে। দেখে সে ভালো হয়ে গেছে। আবার কাজ করছে। ছেলে তার স্কুলের ব্যাগ নিয়ে
রাস্তায় হেঁটে যায়। কত ছবি...কত আনন্দ! মনে বিশ্বাস জাগে, সন্তানের হাতে যে অমৃত পেয়েছে
সে ভালো না হয়ে পারে? সে ভালো হলো না। সব তার কল্পনা অসুস্থ স্বপ্ন বিকার। এক ওষুধ বদলিয়ে অন্য ওষুধ খেয়ে গেল শুধু। তার
স্বল্প রোজগেরে ছেলে আর কত ওষুধ পথ্য জোগাবে? সে সক্ষমতা কোথায়?
সে জগার মুখের দিকে তাকাতে পারে না। শুকিয়ে
কেমন কাঠ আর রাশভারী হয়ে উঠেছে চেহারা। মনের মধ্যে হয়তো কোনো বেদনা তাকে স্বস্তি দেয়
না। সে তো মা, সব বুঝতে পারে। পাছে আবার হিতে বিপরীত হয়, ভয়ে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করতেও
ভয় পায়। সে ছেলের কথা শোনে। বিছানায় বিশ্রাম নেয়। পাশের বাসার বউটি দুপুরে কিংবা সন্ধ্যেরাতে
তাকে খাওয়াতে এলে তার সঙ্গে টুকটাক কথা বলে। সে-সব কথা হারানো দিনের কাব্যকথা। এলোমেলো
স্বপ্নের পুঁথিপাঠ। গল্প করে আর ওষুধ খায়। ওষুধে আর কত? জীবন তো প্রায় শেষ। হয়তো তবু
আশা-প্রত্যাশার কিছু তলানি তার মনে বেঁচে থাকে, কখনো ঝিলিক দিয়ে ওঠে রোগশয্যায়। বেদনার
ফাঁকে ফাঁকে আকস্মিক নিজের মনের সঙ্গে কথা বলে। একদিন আবার ঠিক উঠে দাঁড়াবে সে। ছেলেকে
আর রিকশা চালাতে দেবে না। স্কুলে পাঠাবে। কতইবা তার বয়স? তা ছাড়া কর্মজীবি মানুষের
স্কুল আছে। যেখানে তার মতো একটু বড় কিশোরেরা পড়াশুনা করে। তাকে যে লেখাপড়া শিখে মানুষ
হতে হবে।
কিন্তু সে আর উঠতে পারল না। বিধাতার এক বাণেই আশা ভরসা মিলিয়ে গেল।
জীবন শুধু যায় যায় করে নিভে গেল না। কেন? সেই তো ভালো হতো। দামি দামি ওষুধের পয়সা জোগাড়
করতে জগাও যে হাঁপিয়ে উঠেছে! মায়ের মন সব বোঝে। অন্তরের অশ্রু সমুদ্রের মতো নীরবে গর্জন
করে ওঠে। সে কত বড় পোড়াকপালি! দেখে শুনেও সে কিছু করতে পারে না।
আকস্মিক তার শরীর একটু সুস্থ হয়। রক্তমিশ্রিত শ্লেষ্মা রেহাই দেয় কয়েক
মাস, শুধু থেকে থেকে খুসখুসে কাশি। সে কাশি কখনো কমে...কখনো বাড়ে। যমের ঠাট্টা পরিহাসের
সীমা নেই। এরমধ্যে জগা একদিন নিজের থেকে বেশি বয়সি এক মহিলাকে এনে বলে যে, সে বিয়ে
করেছে; এ হলো তার বউ। সে এত দুঃখের বোঝা কোথায় রাখে! খুব সাধ ছিল, টুকটুকে পরীর মতো
কোনো কিশোরীকে বউ করে আনবে। মেয়ের মতো করে রাখবে। কী ভেবেছিল আর কি হলো! ছেলে তা হলে
সুনিলের বাড়ির জুয়ার আড্ডা ছাড়েনি। সুনিল যে কৌশলে তার বাড়ি পালিয়ে যাওয়া শ্যালিকাকে
জগার ঘাড়ে গছিয়ে দিয়েছে, বুঝতে বাকি থাকে না। সে ঘটনা কত বছর আগের? কত দিন হয়ে গেল!
এই দুঃখকথা তার বৃদ্ধ বুকে গোপনে থেকে যায়। কিছু কিছু দুঃখ কথা কাউকে বলা যায় না, একান্ত
নিজস্ব গোপন বেদনা...শুধু মনকে পোড়ায়। মানসীকে অবশেষে স্বীকার করে নেয় সে।
বুড়ি আবার চটের চালের ফাঁক দিয়ে আলোছায়া অন্ধকার
আকাশ দেখে। মাথা উঁচু করে তুলতে বড় কষ্ট। তারাগুলো আর তেমন দেখা যায় না। আকাশ থেকে
ধোঁয়ার ফোয়ারার মতো কুয়াশা নামছে। শীত আরও জেঁকে বসে। তার মন অসি'র হয়ে ওঠে। মনে হয়,
কোথাও পালিয়ে যায়। এই পৃথিবীর রূপ-রস সব তো শিঁকেয় উঠেছে। যেদিন বৈধব্যের বেশ এলো শাঁখা
ভাঙা হাতে। কি বিচিত্র জীবন! সেদিন সকালবেলা জগন্নাথের বাবার সঙ্গে কী নিয়ে ঠাট্টা
হাসাহাসি। আর সন্ধ্যেয় এলো কালবেলা! আজও তার সকল দৃশ্যপট স্পষ্ট। সেই দিব্যকান্তি পুরুষ,
উন্নত ললাট...প্রসন্ন মুখ। দুটি কালো চোখে সবসময় আনন্দের দ্যুতি। স্বামী না দেবতা...দেবতা!
সেই দেবতার বুকে ছোট পাখির মতো পরম নির্ভরতায় সে মুখ লুকোত। যে অমৃতের বন্ধন এঁটেছিল
দুটি প্রাণে সে তো অবিনশ্বর। অথচ সেদিন জীবনে নেমে এলো নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাস! সারারাত
কেটে যাওয়া দুশ্চিন্তার পর চোখের নোনাজল। বুকের হাহাকার। বিধাতার কাছে ক্ষমাহীন আর্তনাদ।
প্রতিবাদ।
সংবাদপত্রে কাজ করত তার দেবতা। গ্রামগঞ্জের
হাটবাজার আর শহরের অলিগলির সকল খবর তার কাছে। মানুষের মহত্ত্ব, বিচিত্র স্বভাব আর নিষ্ঠুরতার
কত গল্প শুনেছে তার মুখে! সেই মানুষের খবর ছিল না। আকস্মিক নিখোঁজ হয়ে গেছে। দেশজুড়ে
তখন মুক্তিপিপাসু মানুষের শ্লোগান আকাশে বাতাসে প্রতিদিন বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গের মতো এ
প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটে চলেছে। মানুষের গোপন চাপা কথাবার্তায় আর চোখে-মুখে সন্দেহ
অবিশ্বাস। বোঝা যায়, একটা কিছু হতে চলেছে অথবা খুব শিগগির হবে আর হলোও তাই। এক মধ্যরাতে
গর্জে উঠল মারণাস্ত্রের গোলা। মানুষের আর্তনাদে কেঁপে উঠল নিস্তব্ধ রাত। প্রাণ আকুল
করা অমলিন বাতাসে ছড়িয়ে গেল বারুদের গন্ধ। সে একলা একজন নারী কী করে? কোথায় খোঁজে মানুষটিকে?
ভয়ে ভয়ে গলির মাথা রাস্তা আর যতদূর দৃষ্টি যায়...না নেই; কোথাও নেই। রাস্তায় চলেছে
অদ্ভুত সব গাড়ি আর সেগুলোর মধ্যে বিচিত্র পোশাকের মানুষ নাকি তারা অন্য কেউ, যাদের
সে চেনে না; কোনোদিন দেখেনি?
সারাদিন আর বিনিদ্র রাত অস্থিরতার সময় শেষে খবর এলো। কে দিয়েছিল নাকি শোনা কথা মনে
নেই। প্রেসক্লাবের বড় তিনটি ছাতিম গাছের ছায়া ছায়া অন্ধকারের কোনো কোণায় দেবতা পড়ে
আছে রক্তাক্ত। সেই পবিত্র দেহ আনতে কে যায়? কে এনে দেবে? আদৌ আছে কি না তার সত্যতা
কতটুকু? সবকিছু বোঝা কিংবা যাঁচাইয়ের ক্ষমতা তার কোথায়? তখন কোল জুড়ে পাঁচ বছরের জগন্নাথ।
সে আঁচল টেনে ধরে রাখে। তারপর কীভাবে যে ভারতের মাটিতে শরণার্থী হয়েছিল সবকিছু অচেনা
মনে হয়। সেই দুঃস্বপ্নের দিনরাত মনে পড়লে আজও ভেতরে ভেতরে শিহরে ওঠে সে। মানুষ কত ভয়ংকর!
এই মানুষকে বলা হয় কি না, সৃষ্টির সেরা জীব! পৃথিবীতে সামান্য কয়েকটি দিনের জীবনের
জন্য এত হানাহানি রক্তপাত! নিরপরাধ মানুষের জীবন কেড়ে নেয়া। একে সভ্যতা বলে না...এ
হলো বর্বরতা!
দেশ স্বাধীন হলে অনেকে নিজ মানুষকে ফিরে পেয়েছে।
মুক্তির আনন্দে হাতে পেয়েছে ফুলের মালা। কেউ পায়নি। পেয়েছে হারানোর ব্যথা। নির্মম স্মৃতি।
দুঃখের কালিমা। সে শেষের দলের। অবশেষে একদিন সাহস করে নিজ বাপের বাড়ির দেশে রওয়ানা
হয়। আগুনে পোড়া শূন্যভিটায় তখন কেউ ছিল না। কে তার ভার নেবে? সমাজ সবার দায় নেয় না।
অবশেষে নিজেকে সবকিছুর হাল ধরতে হয়।
বুড়ির কাশির বেগ আরও বাড়ে। গমকে গমকে বিকট
শব্দ তুলে কাশতে থাকে। হয়তোবা তার সঙ্গে কোরাস মিলিয়ে বড় রাস্তার কোনো নামগোত্রহীন
কুকুর কেঁউ কেঁউ করে ওঠে। প্রকম্পিত হয় রাত। তার ঝুপড়ির পাশে শুয়ে থাকা আপনজনের মতো
বাচ্চা কুকুরটি কুণ্ডলিত অবস্থা থেকে ঝটাম্ করে
উঠে দাঁড়ায়। দুকান ঝাঁকিয়ে পট পট শব্দ তুলে একঘেয়ে ডেকে
ওঠে। রাতের নিস্তব্ধতা আর একবার টুকরো টুকরো হয়ে যায়। বুড়ির কিইবা দিন কিইবা রাত। বিরতিহীন
কয়েক মুহূর্ত খুক্ খুক্ কেশে আবার চুপ করে যায়। হাঁপাতে থাকে। জগার বেড়ার ঘরের দরজা
খুলে যায়। মানসী ঘুমকাতর চোখে টিমটিমে লন্ঠন হাতে বেরিয়ে আসে। একদলা থুতু খুব শব্দ
করে সামনের অন্ধকারে ছুড়ে দেয়।
‘ছেই ছেই! পিত্তি জ্বলে যায় কুত্তার অত্যাচারে।
এতবার তাড়াচ্ছি...বুড়ির লাই পেয়ে আবার...।’
বুড়ি ঠিকমতো কিছু শুনতে পায় না। তার আশাহত
মনে কারও গলার স্বরে সান্ত্বনা জাগে। রাতের নীরবতায় তবে সে একা জেগে নেই! তার মনে পড়ে,
যেদিন ছেলে মানসীকে বিয়ে করে ঘরে নিয়ে আসে; সে অসুস্থ বিছানায় পড়ে আছে। তার ধৈর্য ভেঙে রাগ ওঠে। ভাঙা ভাঙা গলায় পড়শিদের
বলে, সে জল স্পর্শ করবে না। পরে সে রাগ আর থাকল কই? যে সংসার করবে তার যখন কোনো সমস্যা
নেই, তবে সে কেন কথা বলে? ছেলে কি আর নিজের বাঁধনে আছে? আজ বউকে নিয়ে মনের গোপনে পুরোনো
কোনো লালিত সাধ জেগে ওঠে তার। ছেলে বউয়ের হাতে সে সেবা পাবে। সেও আদর করে ভরে দেবে
বউমার মন। ভাবনায় তার দুটি চোখ চকচক করতে থাকে। তারপর ব্যগ্রকণ্ঠে বলে বসে, -
‘বউমা, ও বউমা...একটু শোন্ মা। মা দেখ্
না মা, জগা মধু এনেছে কি না?’
‘দাঁড়ান দেখছি। আর পারি না বাপু উফ্! একটু
যে শান্তিতে ঘুমাব তার কোনো উপায় নেই।
মানসী গজগজ করতে করতে চলে যায়। তার হেঁটে
যাবার ধুপধাপ শব্দ বুড়ির মনে বড় অলুক্ষণে লাগে। আজকালকার মেয়ে, কে শেখাবে আদব কায়দা?
অভাবের সংসারে পড়ে কার মনই বা ভালো থাকে? জগারও যে কি হলো! রোজ রাতে নেশা করে ঘরে ফেরে।
‘ভগবান কি পাপ করেছি ভগবান? তার ক্ষমা দাও ঠাকুর...ক্ষমা দাও।’ কোথাও কোনো গাছের আড়াল
থেকে এক হুতোম পেঁচা হুঁম হুঁম ডাকে রাতকে অসহ্য করে তোলে। বিরক্তিকর সেই ধ্বনি বাতাসে
ঢেউ তুলে তুলে ছড়িয়ে যায়। বুড়ির অন্তরাত্মা অমঙ্গল আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে। আতঙ্কে নিঃশ্বাস
স্তব্ধ হয়ে যেতে চায়। আবার পায়ের শব্দ। বউ আসে। বুড়ি তার অসম্ভভ ভারী মাথা উঁচিয়ে ধরার
চেষ্টা করে।
‘এই নেন মধু, এতে আফিম দেয়া আছে; অল্প একটু
খাবেন। বেশি খাবেন না আবার, নয়তো মরে ভূত। আমি শুতে চললাম। ডাকাডাকি করবেন না। চুপ
করে ঘুমাতে চেষ্টা করেন।
‘একটু দাঁড়া মা, জগা ভালো আছে এখন?’
‘হুহ্!’
আবার ধুপধাপ শব্দ। বুড়ির জড় আঙুলে আস্তে আস্তে
শক্তি এসে জমা হতে থাকে। শিশি খুলে সুড়ুৎ করে কিছু মধু মুখে টেনে নেয় সে। মধু...খাঁটি
মধু। মধু হলো অমৃত। কি তার স্বাদ! জগন্নাথ এনেছে। তার আদরের একমাত্র ছেলে। ছেলে ভালো
নেই। শরীর খারাপ...অসুস্থ। কীভাবে জীবন চলবে
তার? বুড়ির দুচোখ ভিজে ওঠে। জীবনভর শুধু তার দুঃখ। আনন্দের দিন নেই। আজ ছেলে যদি মানুষের
মতো মানুষ হতো, একটি জীবন; কত সুখ আর আনন্দ! হলো না, কেন হলো না? সে কথা বিধাতা জানে।
তার জীবনের সকল কষ্টের বিনিময়ে ছেলেকে সুখী করে দাও ঠাকুর। তার দৃষ্টি আবার ঝাপসা হতে
থাকে। আলোছায়া রাত মিলিয়ে যায় গভীর অন্ধকারে।
আজ ছেলে অনেক দূরে থাকে। সারাদিন তেমন করে
দেখা হয় না...কথা হয় না। নয়তো সে নিজে এসে তার মাথা তুলে ধরে আদর করে অমৃত খাইয়ে দিত।
কতদিন হয়ে গেল, ছেলে তার কাছে আসে না! কতদিন আদুরে গলায় ‘মা’ ডাক শোনেনি সে! বুড়ি ভেজা
দৃষ্টি নিয়ে দীর্ঘশ্বাসে বাতাস ভারী করে তোলে। ছেলের যে কি হলো! মুখে হাসি নেই। মনে
শান্তি নেই। তাই ওসব ছাইপাঁশ গিলে আসে। মনের দুঃখ হতাশা। মনে ব্যথা না থাকলে কেউ কি
নিজেকে শেষ করে দেয়? চোখের সামনে তার জগন্নাথ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, সে কিছু করতে পারছে
না। কেমন মা সে? সাত রাজার ধন একটি মাত্র ছেলে তার। ওর কাতর অসহায় চোখ সহ্য করা যায়
না। তার ইচ্ছে হয়, খুব করে কাঁদে; কেঁদে কেঁদে হালকা হোক মনের বোঝা। পারে না। অনেককিছু সে পারে না। জীবনভর পারল
না। একবার তবে মরে গিয়ে ভূত হবে সে। ছেলের জন্য মাটিরতলার কোনো গুপ্তধন খুঁজে বের করে
দেবে।
বুড়ি মধুর শিশিতে আর একটি চুমুক দেয়। ‘ভগবান
ভগবান।’ মধুর কি স্বাদ! বেশি খাওয়া বারণ। আফিমে নেশা হয়, কাশ কমিয়ে দেয়। হাজার নির্ঘুম
রাত শেষে এনে দেয় গভীর ঘুম। আহা কত দিন ঘুমোয় না সে! আজ ঘুমোবে। যেভাবে সে অসুস', বিছানায়
শুয়ে থাকত, আর আদরের ধন জগন্নাথ ঘুম পাড়িয়ে দেয়; আজ রাতে সে ঘুমোবে। বুড়ি বিড়বিড় করে
নিজের সঙ্গে কথা বলে। কোনো সুখের দিন কল্পনায় আনমনে হাসে।
‘আয় বাবা জগা, আমাকে একটু ঘুম পাড়িয়ে দে বাবা;
ছেলেবেলায় যেমন তুই এই মাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতি।’
বুড়িকে আবার কাশি চেপে ধরে। ঝুপড়ির পাশে শুয়ে
থাকা বাচ্চা কুকুরটি অন্ধকারে দৃষ্টি ছুড়ে দেয়। কুঁই কুঁই শব্দে জানান দেয় বিরক্তির
অস্তিত্ব। এলোমেলো হয়ে পড়ে রাতের আকাশ। কুয়াশায় হারিয়ে যায় ঝুলে থাকা সবগুলো তারা।
বুড়ি আরও একবার ঠোঁটে শিশি তুলে নেয়। মধু হলো অমৃত...অফুরন্ত জীবনী। মহাদেব সমুদ্র
মন্থন করে অমৃত পেয়েছেন। সেই অমৃত দেবতারা পান
করে হয়েছেন অমর। তার হারিয়ে যাওয়া দেবতা সমস্ত মন জুড়ে অমর হয়ে রয়েছে। দুচোখের ঘোলা
দৃষ্টিতে আজ তার ছবি। আলোছায়া অন্ধকার দেয়ালে ভেসে ওঠে উজ্জ্বল মুখ। অন্ধকার বাড়তে
থাকে...আলোকিত হয়ে ওঠে সেই চেহারা। বুড়ি আর একবার শিশির স্পর্শ খোঁজে। একবার...আর একবার।
ধীরে ধীরে শূন্য হতে থাকে অমৃত ভাণ্ডার। রাত আরও জেঁকে বসে। নিজ্ঝুম...চুপচাপ।
®
No comments:
Post a Comment