22 August 2017

সুধাংশু চক্রবর্ত্তী


মদের ঘোর কেটে যেতে হেমন্ত স্যান্যাল চোখ খুলে তাকিয়ে দেখেন পড়ে আছেন রাস্তার ধারে । গত রাত্রে অফিস পার্টিতে আকণ্ঠ মদ পান করেছিলেন বলে এই মুহূর্তে তাঁর কপালের রগদুটো প্রচণ্ড দপ্‌ দপ্‌ করছে । মনে হচ্ছে কপালটা এক্ষুনি ফেটে পড়বেগলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে ।   
হেমন্ত স্যান্যাল ধাতস্থ হয়ে রাস্তা থেকে উঠে দাঁড়ান । পা দুটো সামান্য কাঁপছে । টলমল করতে করতে হাঁটা দেন বাড়ির দিকে । একসময়ে কপালে হাত দিয়ে অনুভব করেন কপালের ডান দিকটা ফুলে আছে । গভীর ক্ষতের উপস্থিতিও অনুভব করেন সেখানেআঙ্গুল চ্যাট চ্যাটে করায় বোঝেন সামান্য হলেও রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে জায়গাটা থেকে । তাতেই মনে পড়ে যায় তাঁর । গত রাত্রে বাস থেকে নামার সময় টাল সামলাতে না পেরে দড়াম করে আছড়ে পড়েছিলেন পীচ রাস্তার ধারে । কপালের ক্ষতটা হয়তো তখনই হয়েছে কোনোকিছুতে লেগে ।
হেমন্ত স্যান্যাল ভাবনা ছেড়ে দ্রুত হাঁটতে শুরু করেন । তাঁর এই ছড়ে যাওয়া রক্তাক্ত কপাল, অবিন্যস্ত পদক্ষেপ, একমাথা উসখো-খুসখো চুল, ধূলিমলিন পোষাক দেখে তাঁকে পাগল ছাড়া আর কিছু ভাবা যায় না । বাড়ির সামনে এসে দেখেন স্ত্রী মন্দিরা দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন তাঁরই ফেরার পথ চেয়ে । স্বামীকে দেখেও চিনতে পারলেন না তিনি । হেমন্ত স্যান্যাল কাছে এসে একগাল হেসে কিছু বলতে যেতেই মন্দিরা অমনি চীৎকার জুড়ে দেন কে কোথায় আছো শিগগির এসো । একটা পাগল এসেছে আমাকে মারতে ।

হেমন্ত স্যান্যাল কাতর গলায় বলেন – ‘আমাকে চিনতে পারছো না মন্দিরা ? আমি......
মন্দিরা দ্রুত ঘরের ভিতরে ঢুকে গিয়ে পরিত্রাহি চিৎকার জুড়ে দেন । সেই চিৎকারে দু-চারজন প্রতিবেশী লাঠিসোটা হাতে ছুটে আসেন তাঁকে রক্ষা করতে । তারাও হেমন্ত সান্যালকে চিনতে পারেননিচিনতে পারেননি এই কারণে যে,তাঁরা একটি বিখ্যাত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ অফিসার হেমন্ত স্যান্যালকে  এই অবস্থায় আগে কখনো দেখেননি যে
অবস্থার বিপাকেয় পড়ে হেমন্ত স্যান্যাল কী করবেন ভেবে না পেয়ে আপাতত নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়াটাই শ্রেয় মনে করে পেছন ফিরে চোঁচা দৌড় মারেন । প্রতিবেশীরা লাঠিসোটা হাতে তাঁর পেছনে ছোটেন উচিৎ শিক্ষা দেবার জন্য ।  স্ত্রী মন্দিরা ততক্ষণে দোর দিয়ে ভিতরে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপছেন ঠক্‌ ঠক্‌ করে ।   

***
হেমন্ত স্যান্যাল অফিস পার্টি থেকে আকণ্ঠ মদ গিলে বাস থেকে নেমে টলোমলো পায়ে হাঁটছেন বাড়ির দিকে । পাড়ার রকে বসে আড্ডায় ব্যস্ত থাকা চারটি যুবক তাঁকে দেখে উঠে দাঁড়ায় ওদেরই একজন বলে – “শালা , রোজ মদ পাড়ায় ঢোকা ? আজই এসব বন্ধ করবো । এই চল দেখি, শুয়োরটাকে নদীর চড়ায় নিয়ে গিয়ে পুঁতে দিই । কেউ কোনোকালেও আর এই মদ্যপটার খোঁজ পাবে না ।
 অন্য একজন বলে – “তারচেয়ে বরং বেশ কঘা বসিয়ে দিয়ে আধমরা করে ফেলে আসি ও বাড়ির সামনে । তাতেই যথোপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হবে । দিনমানে  ভদ্রলোকের চেহারায় বুক ফুলিয়ে পাড়ায় ঘোরেন । রাত্রে ফেরেন মদ্যপ জানোয়ার হয়ে । আজ ওঁকে শাস্তি  পেতেই হবে।
যেমন কথা যুবকেরা তেমনটাই করে । মারধোর খেয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন হেমন্ত স্যান্যাল –“আর হবে না। কথা দিচ্ছি তোমাদের । এমনটা আর হবে না কখনো ।
যুবকেরা কি ভাবলো কে জানে তাঁকে টেনে হিঁচড়ে এনে ফেললো তাঁরই বাড়ির সামনে । ওরা যখন তাঁকে ফেলে রেখে ফিরে যেতে উদ্যত হয়েছে স্ত্রী মন্দিরা তখনই দরজা খুলে বেরিয়ে এসে স্বামীকে  আপাদমস্তক দেখে নিয়ে যুবকদের বলেন -  যেখান থেকে ওকে নিয়ে এসেছো সেখানেই ফেলে এলে না কেন ? তেমন কিছু করলে ভালো করতে। যাক্‌ এনে ফেলেছো যখন তখন আমার একটা অনুরোধ রেখো তোমরা । মেরেধরে ওর হাত-পা দুটো ভেঙ্গে দিয়ে যাও।
যুবকদেরই একহজন লজ্জিত গলায় বলে– “সরি বৌদি, এর বেশী আর কি শাস্তি দেবো আমরা? এবার যা করার আপনি করুন।
যুবকেরা চলে যাওয়ার পর মন্দিরা স্বামীর দিকে ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে  দোর দিলেন। হেমন্ত স্যান্যালের শত অনুরোধেও সেই দোর আর খুললো না।  লজ্জিত অপমানিত হেমন্ত স্যান্যাল খোলা আকাশের নিচে বসে তাকিয়ে থাকলেন তারা ঝলমলে কালো আকাশের দিকে। মন্দিরাও নির্ঘুম চোখে রাত কাটালেন । 
পরদিন কাকভোরে মন্দিরা ঘরের বাইরে এসে  দরজার পাশে স্বামীকে দেখতে না পেয়ে এদিক সেদিক খোঁজ করেন । তখনই সহসা দেখেন স্বামীর নিথর দেহটা হাওয়ায় দোল খাচ্ছে উঠোনের আমগাছের ডালে ঝুলে থেকে । 

০৬ আগস্ট, ২০১৭

No comments:

Post a Comment