প্রায় ঘন্টা দুয়েক সময় ধরে প্রদীপ কুমার সাহা বড় রাস্তার মোড়ে বুড়ো বটের নিচে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। এবার খুব অসহায় লাগছে তার। গাছের নিচে কিংবা আশেপাশের টঙে দাঁড়িয়ে বা বসে সময় কাটাচ্ছেন তিনি। বসে স্বস্তি না পেলে দাঁড়াচ্ছেন। দাঁড়াতে স্বস্তি না পেলে বসছেন। দুই পায়ের হাঁটু বারবার ভাঁজ করা আর সোজা করা এই বয়সে তার জন্য খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার। মাঝে মাঝে অবশ্য তিনি দুই হাত দুপাশে ছড়িয়ে দিয়ে গাছের মতো শরীরের বিস্তৃতি ঘটাচ্ছেন। এই বিষয়টাতে খুব ছেলেমানুষি অনুভূতি হচ্ছে তার। ডালপালার মতো দু’হাত ছড়িয়ে দিলে বেশ গাছ গাছ লাগছে নিজেকে
বটগাছটা বেশ লাগছে। প্রায় পাতাহীন গাছের শাখার বিন্যস্ততা মনে করিয়ে দিচ্ছে, এই যে বৃক্ষ, আবার প্রস্তুত হও। আর কদিন পরেই বাদ বাকি বাদামী পাতা খসে গিয়ে সবুজ মখমলে ছেয়ে যাবে। সাজসজ্জা ক্রমশ নিপুণ হয়ে উঠবে সবুজের ভারে। তারপর ডালপালার মায়াবী পরিসরে আড়াল করবে রোদের নির্দয় আঁচ বা ঝড়ো বাতাসের কুণ্ডলি। প্রদীপ কুমার দুহাত দুপাশে মেলে দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন। তার ভালোই লাগছে। অভিজ্ঞতা, বয়স আর সহনশীলতার দিক থেকে প্রদীপ কুমার সাহার জীবনের সাথে এই বুড়ো বটের জীবনপঞ্জির ভালই মিল আছে। দেশভাগের ইতিহাসের মেটো রঙ, মুক্তিযুদ্ধের লাল রঙের প্লাবন, স্বাধীন দেশের আগুনের রঙ বুড়ো বটের মতো তার শরীরেও লেগেছে।
বটগাছটা বেশ লাগছে। প্রায় পাতাহীন গাছের শাখার বিন্যস্ততা মনে করিয়ে দিচ্ছে, এই যে বৃক্ষ, আবার প্রস্তুত হও। আর কদিন পরেই বাদ বাকি বাদামী পাতা খসে গিয়ে সবুজ মখমলে ছেয়ে যাবে। সাজসজ্জা ক্রমশ নিপুণ হয়ে উঠবে সবুজের ভারে। তারপর ডালপালার মায়াবী পরিসরে আড়াল করবে রোদের নির্দয় আঁচ বা ঝড়ো বাতাসের কুণ্ডলি। প্রদীপ কুমার দুহাত দুপাশে মেলে দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন। তার ভালোই লাগছে। অভিজ্ঞতা, বয়স আর সহনশীলতার দিক থেকে প্রদীপ কুমার সাহার জীবনের সাথে এই বুড়ো বটের জীবনপঞ্জির ভালই মিল আছে। দেশভাগের ইতিহাসের মেটো রঙ, মুক্তিযুদ্ধের লাল রঙের প্লাবন, স্বাধীন দেশের আগুনের রঙ বুড়ো বটের মতো তার শরীরেও লেগেছে।
ভ্যাপসা গরম লাগছে এখন। প্রদীপ কুমারের পরনে ভয়েল কাপড়ের শাদা ফতুয়া আর ফুলপ্যান্ট। ফতুয়ার পিঠের দিকটা ঘামে ভিজে শরীরের সাথে লেপটে গেছে। শীতের প্রস্থানে প্রকৃতির রুক্ষতা ঢেকে দিতে মরিয়া ফাল্গুন কিন্তু ফাল্গুনের বাতাসের মৃদু কাঁপন রোদের তেজ কমাতে পারছে না। আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবেন তিনি? বেলা বাড়ছে। ছেলেটা তো তাকে এখানেই দাঁড়াতে বলেছে। নাকি তিনি ভুল করছেন? আসলে একটা ভুল তো হয়েছে বটে, অতি আগ্রহের কারণে তাকে দেয়া সময়ের অনেক আগেই তিনি চলে এসেছেন।
বনহাটি বাজারে মোজাম্মেলের চালের আড়তে প্রদীপ বসতে চেয়েছিলেন কিন্তু ছেলেটা বলেছিল, ‘কাকু আপনি বড় রাস্তার মোড়ের বট গাছের নিচে দাঁড়ালেই হবে, আমি ঠিক ওখানটাতেই বাস থেকে নেমে যাবো। নেমেই আপনাকে ফোন দিবো।’ ফতুয়ার বুক পকেটে প্রদীপ বাবুর মোবাইল রাখা। তার ছোট ছেলে নিতেশ বেশ কায়দা করে গলার সাথে ফিতে দিয়ে মোবাইল ঝুলিয়ে দিয়েছে। এতে মোবাইল হারানোর ভয় কম। গলায় ঝুলিয়ে মোবাইল বুক পকেটে ঢুকিয়ে দিলেই হয়। মোবাইলটা বের করে আবার তিনি ছেলেটিকে ফোন করেন কিন্তু সেই একই যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর বলে ওঠে, আনরিচেবল।
প্রদীপ কুমার সাহা এবার অস্থির হয়ে ওঠেন। ক্ষুধাও লেগেছে। মাঝখানে একবার চা-বিস্কুট খেয়েছেন। বেশি আনন্দ আর উত্তেজনা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হতে গিয়ে ভালো মতো খাওয়া হয়নি তার। দেশের জন্মলগ্নের মর্মস্পর্শী স্মৃতি রোমন্থনের সাথে প্রাপ্তির আনন্দের তীব্রতাও এখনো ভীষণ আপ্লুত করে তাকে। প্রতি রাতে ঘুমোবার আগে যে স্মৃতি হাতড়ান, তা যেন ঝাপসা না হয় সেই আনন্দেই আজ বাসা থেকে বের হয়েছিলেন তিনি। আনন্দ এখন অপেক্ষার টানাপোড়েনে পড়েছে। এবার তিনি চোখ বন্ধ করে বসেন। মন্ত্রপাঠের মতো সেরে নেন ইতিহাসের পুনঃপাঠ। নাহ্ সব এখনো সকালের মতোই স্পষ্ট, সজীব।
সুখনন্দী প্রাইমারি স্কুলে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প ছিল। তার বড় ছেলে নিখিলেশের খবর পাবেন বলে সেদিনও সন্ধে আহ্নিকের পর স্কুলে গিয়েছিলেন। তখন নভেম্বরের মাঝামাঝি। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী সেইসময় তাদের গ্রাম থেকে পিছু হটেছে। তবু অভ্যাসবশত ঘর থেকে বের হবার আগে তিনি পড়ছিলেন, আল্লাহুমা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালেমিন। পরক্ষণেই তার মনে পড়ে গিয়েছিল তাকে আজ রাস্তায় আটকাবার কেউ নেই। কোন দিক থেকে মিলিটারি এসে ধরে সেই আশংকায় বন্ধু রুহুলের কাছ থেকে পাঁচ কলেমাসহ এই দোয়াটা শিখে রেখেছিলেন। সেদিনের কথা মনে পড়লে আজো তার শরীরের রক্ত হিম হয়ে আসে। সেদিন, আগস্টের শেষদিকে, দীঘা ব্রিজের কাছে চেকপোস্ট বসিয়ে লোকজনকে পরীক্ষা করা হচ্ছিল। একজন সেনা প্রদীপ কুমারের লুঙ্গির গিঁটে যেই হাত দিতে যাবে তখনই আরেকজন পাকসেনা এসে হুঙ্কার দিলেন, নাম ক্যায়া হ্যায়? কলমা বাতাও! ওদের সাথে সেদিন কোনো রাজাকার ছিল না বলেই হয়তো তাকে আর লুঙ্গিও খুঁট খুলতে হয়নি, তিনি কেবল কলমা বলে বেঁচে গিয়েছিলেন।
আরেকবার টানা সাতদিন বাড়িঘর থেকে প্রদীপ আর তার পরিবার বের হননি। সেই সময়ে কী খেয়ে যে বেঁচে ছিলেন তা কেবল ভগবানই দেখেছে। সাতদিনের মধ্যে ছয়টা দিনই ক্ষণে ক্ষণে গুলির ঝাঁ ঝাঁ শব্দে পুরো গ্রাম মুখরিত ছিল। সাতদিনের মাথায় সব নিশ্চুপ দেখে যখন বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন তখন পুরো গ্রাম মুত্যুপুরীর মতো খাঁ খাঁ করছিল। যুদ্ধের সেই দিনগুলোতে হৃদয়ের দরদ দিয়ে প্রদীপ একবার ভগবান ডেকেছে, একবার আল্লাহ। যেই মন্ত্রে বা সুরাতেই সৃষ্টিকর্তাকে ডাকুক না কেনো তিনি যে একজনই জেনে প্রদীপ ছেলের খোঁজে সুখনন্দী প্রাইমারি স্কুলে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে গিয়েছিলেন। যেতে যেতে রাস্তায় প্রদীপ ভক্তিভরেই সেদিন পাঁচ কলেমা পড়েছিলেন, যদি নিখিলেশের খবর পান! ছেলেগুলো তখন চলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। উসকো-খুসকো চুল-দাড়িতে মুখ ঢাকা সবুজ নামের ছেলেটা তার দিকে চোখ তুলে তাকায়নি সেদিন। ক্লাসরুমের দেয়ালের দিকে মুখ করে বলেছিল, চাচা, ফিরে যান। নিখিলেশ আসবে। ক’দিন পরেই আসবে। ছেলেটার গলার অনিশ্চয়তা আর শীতলতায় প্রদীপ বুঝে গিয়েছিল, নিখিলেশ আসবে না। নিখিলেশ আসেনি আজো।
প্রদীপ কুমার সাহা জলজ চোখে বড় রাস্তায় তাকান। তারপর চোখ রাখেন আকাশের বুকে। আকাশের কত আলো! রোদের তীব্রতায় চোখ নামিয়ে নেন তিনি। সেই যে পৃথিবী যখন বিশ্বযুদ্ধে মেতে উঠেছিল, এই আকাশের বুকে সাঁই সাঁই করে যুদ্ধবিমান ছুটে যেত। তখন তার বয়স চার হবে। গুনতে শিখেছেন, এক দুই, তিন করে দশ পর্যন্ত গুনতেই শেষ। রোদের ঝলকানিতে চোখ ফেরাতে ফেরাতে আকাশের দূর প্রান্তে বিমানগুলো মিলিয়ে যেত।
আচমকা পকেটে মোবাইলটা যুদ্ধবিমানের মতো ভোঁ ভোঁ করে ওঠে। কাঁপা কাঁপা হাতে প্রদীপ মোবাইলে চাপ দেন, ছেলেটা ফোন করলো বুঝি।
-বাবা তোমার দেরি হইতেছে ক্যান? কোনো বিপদে পড় নাই তো বাবা?
-না কাকু, বিপদ না। একটু ঝামেলা হয়েছে। আপনাকে কষ্ট দিলাম। কাজ ফেলে বসে আছেন।
-না কষ্ট না, আমি তো বইসাই আছি। বুড়া মাইনষের আর কাজ কি বলো। তোমার আর কতক্ষণ লাগবো?
-কাকু আপনি বাড়ি ফিরে যান, আমি আসছি না। ভাবছি ইন্টারনেট থেকে তথ্য নিয়ে আর্টিকেলটা তৈরি করে ফেলবো। আমার এক বন্ধু দারুণ একটা আর্টিকেল লিখেছে গুগলে ঢুঁ মেরেই। এখন তো ঘরে বসেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা যায়। সরি কাকু কষ্ট করলেন।
অপেক্ষার ক্লান্তিতে নুয়ে আসা শরীর-মাথা শূন্য লাগে প্রদীপ কুমার সাহার। তবু তিনি সামনে পা বাড়ান। ঠিক তখনই সূর্য তার শরীরী অবয়বকে দুর্দান্ত রঙে আরো উজ্জ্বল করে তোলে। আর সেই আলোতে প্রদীপ কুমার সাহা সূর্যদিনের ইতিহাস চোখের তারায় বন্দি করে বুকের ভেতরে কী এক হাহাকার নিয়ে সামনে হাঁটতে থাকেন।
No comments:
Post a Comment