22 August 2017

হাফিজ রহমান




স্বপ্নটা ফেলে রেখে যায়
ঈশানে জমেছে মেঘ, দ্যাখ,
ঠিক যেন সেদিনের মত
দুজনেই রঙিন হয়ে মেতেছি যে,
ভীরু মনে, অবাধ্য বোশেখে

মনে পড়ে
কৃষ্ণচূড়ার লাল লেগেছিল অধরেও তোমার
বোশেখের প্রথম দ্যাওয়া লেগেছিল ঠোঁটে,
শিহরণ ছিল সেই ভীরু চাহনিতে
মেঘেদের গর্জনে
আরও কত কাছে টানে
দূর অতীতের মত সব যায় মিশে
খেয়ালী মেঘের মত যায় দূরদেশে

সব যায়, স্বপ্নটা ফেলে রেখে যায়
আমার এই দুঃখ-ক্লিষ্ট বুকে

রাতের কবিতা
এখন মধ্যরাত, চারিদিকে নিঃশব্দ, ভৌতিক নীরবতা
যেন গ্রাস করেছে কোন আসুরিক দানবের ঝাঁক,
বিকেলের পাখিগুলো ঘরে ফিরে গেছে
সান্ধ্যভ্রমণের সুখকর স্মৃতি নিয়ে জ্ঞানী আর বয়স্ক যারা
তারাও ফিরেছে ঘরে, তারাও আহার সেরে অঘোরে ঘুমায়!

বলতে গেলে এ পর্যন্ত সবকিছু ভালই ছিল,
এ শহরে আর কোন উটকো ঝামেলা ছিলনা,
নীরব শহরটার রাতের বাতাস ভারী হতে হতে
একেবারে স্তব্ধ হলে -
ক্রমে ক্রমে নরকটা নড়েচড়ে জেগে ওঠে
জেগে ওঠে কতিপয় বরাহ-শাবক,
জেগে ওঠে চিৎকারে, - শীৎকারে
                   পাশবিক উল্লাসে,
তারা ছুঁড়ে ফেলে গোলাপের ঘ্রাণ,
তারা ছুঁড়ে ফেলে নিষ্পাপ ভ্রুণ-
তারা শুষে খায় মাতৃ-জরায়ু শ্বাস
ক্রমে আরো ভারী হয় রাতের বাতাস!

আমি জেগে থাকি অক্ষম বেদনায়, ক্ষোভে
আমি জেগে থাকি সুন্দরের ইশারার লোভে
আমি জেগে থাকি-- জেগে থাকি--
আমি জানি, তারা জাগবে,
ফুলের সুবাস নিয়ে তারা জাগবে,
আলো আসবে, সে আলোর মোহন-স্পর্শে
তারা জাগবে-----


একদিন বর্ষার জলে
একদিন বর্ষার জলে,
তোমাকে প্রলুব্ধ করে সে কোন ছলে
সামনের অবারিত মাঠে-
টইটম্বুর জলের সাগর যেন
ভেসেছি যে কখন হঠাতে

তুমি ছিলে, নির্মেঘ আকাশ আর তপ্ত দুপুর
নাওয়ের পাটাতনে পায়ের নুপূর,
বাজিয়ে বালিকা তুমি হতবিহ্বলে
ভেসেছিলে একদিন বর্ষার জলে

সেইদিন ঠিক,
হই যেন দূরন্ত নাবিক
ভাসিয়েছি প্রেমের সাম্পান
তোমাকেই বুকে নিয়ে, হে প্রেম,
          হে মোর প্রাণ!

দখিনা বাতাস ছিল,
নিস্তরঙ্গ সেই মাঠে তরঙ্গ জেগেছিল
শাপলার গন্ধে বাতাস মেতেছিল,
যেন তোমার গোপন ঘ্রাণ
আমার শরীরে ঢুকে নাচায় পরাণ!
সেই মাঠে দুপুরের রোদে
লাল লাল দুপুরের ফুল
          যেন তোমার কপোল
ভীরু বাতাসে যেন কাঁপে অবিচল

যেন লাজরাঙা বধূর মতই তুমি কিশোরী বয়সে,
চেয়েছিলে অপলকে, পুলকিত ভীরু প্রেমরসে
অভাগা আমি বুঝিনি যে তাই
অনিশ্চিতের পথে নৌকা ভাসাই!

চলে যাই ধানক্ষেত ছেড়ে,
মাঝেমাঝে বাঁশঝাড়, হিজলের মুগ্ধ বিবরে
মাঠমাঝে লাটিমের ডালে,
টুপটাপ ঝরে পড়ে ভেসে যায় জলে
আমি শুধু এইসব দেখি-
মুগ্ধ নয়ন তোমার
          হায় হায় চোখে পড়ে না-কি!

কখন যে অস্ফুটে,
শুধালে কোমল ঠোঁটে,
প্রেম শুধু হৃদয়ের শুধা?
নেই কি চুম্বন-তৃষ্ণা,
          নেই কি জৈবিক ক্ষুধা?”

শুনি নাই, শুনি নাই, নির্বোধ আমি,
আজও তাই খুঁজে মরি
তোমাকেই, হে অনামী!



চলো, অতীতে ফিরি
এসো হাত ধরে ফিরে যাই সবুজ অরণ্যে,
আমাদের লুকোচুরি খড়ের গাঁদায়,
কিম্বা সোনালী আঁশের গাছ ঘন হয়ে দিগন্ত ছাড়ায়!
চলো সাদাকালো জীবনের অপার বিস্ময় ভরা সারল্যে ভাসি,
নৌকার গলুই ছুঁয়ে গোধূলির আলো মেখে রক্তিম অধরে,
একটা ফড়িঙ উড়ে ছুঁয়ে যেতে চাইবে তোমায়,
আমি ত্রস্ত হাতে ধরে দেবো, তোমার ললাটে
 ঝিঁঝিঁপোকা ডাকার আগেই সবটুকু আলো মেখে তোমার শরীরে,
আমি আকাশের আলোটুকু আঁধারে ঢেকে রাত্রির কাছে সমর্পিত হবো
আমাদের চাওয়ার কি বিশেষ কিছু ছিল?
সেই কতদিন আগের কথা তাই সাদাকালো ছবির মতই
কিছুকিছু অস্পষ্ট হয়ে যায়, কিছু রাখি গহীন বুকের নীচে উষ্ণ প্লাবনে




এ ছবি আমারই আঁকা
এই যে ছবিটা দেখছো, এটা আমারই আঁকা!
হৃদয়ের সবটুকু সুষমা দিয়ে এঁকেছি,
এইযে সবুজ দেশ, গাছে গাছে পাখির কলতান,
মাঠে মাঠে ফসলের ঘ্রাণ,
নদীতে ভাটিয়ালীর সুরে ভেসে যাওয়া নৌকা,
ছইয়ের আড়ালে যুবতী বধূর কৌতূহলী চোখ,
এসবই দেখেছি আমি স্বপ্নালু দুই চোখে,
এসবই এঁকেছি আমি শৈল্পিক এই হাতে!

তারপর যখন দেখলাম, পাখিরা পালিয়ে গেল,
বন উজাড়, সবুজ ফসল খায় প্রমত্ত বরাহ,
নদীর প্লাবণ হারায় কোন অগোচরে,
পালতোলা নৌকা ক্রমশঃ অপসৃয়মান
এ ছবিতে যুক্ত হয় সম্ভ্রমহারা মায়ের করুণ আর্তি,
ধর্ষিতা নারীর নগ্ন শরীর,
এ ছবিতে এসে পড়ে অবাঞ্ছিত ভ্রুণ,
এ ছবিতে হাসে কোন অদৃশ্য কালো হাত,
কোন আসুরিক শক্তির ছায়া!
ক্ষমতার চোরাগলি দিয়ে হঠাৎ জেগে ওঠা
কোন অপদেবতার কদর্য আকার!
আমার অশ্রুসজল চোখের নিষেধ সত্বেও
 সেসবও আঁকি,আঁকতে হয় আমার অবাধ্য হাতে
আমি জানি, আমি আর প্রতিরোধের তীর
ছুঁড়ে মারতে পারবো না অক্ষম এই হাতে,
তাই সেই অবাধ্য হাতদুটিও এঁকে রাখি এককোণে
আর এভাবেই ব্যর্থতার ছবি এঁকে রাখি,
তারপর ছবির মতই অথর্ব হাত কেটে ফেলি!
নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করি,
কেননা আমি আর স্বপ্ন দেখবো না,
কেননা, আমি আর স্বপ্নের ছবি আঁকবো না!





No comments:

Post a Comment