01 December 2015

নুসরাত জাহান আজমী







মাঝরাতে ঘুম ভাঙাটা খুব বিব্রতকর। কেমন যেন অস্বস্তি লাগে। সমস্যা হচ্ছে এই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে আমাকে প্রায় প্রতিদিনই পড়তে হচ্ছে।  প্রথম প্রথম নিজের উপর বিরক্ত লাগত। যেন ঘুম ভাঙাটা আমারই অপরাধ। ঘুম ভাঙ্গার পর যখন বুঝতে পারি, এই ঘুম সহজে আসবেনা, তখনই বিছানা ছেড়ে উঠে আসি। ১৫ তলার উপর আমার এই ফ্ল্যাটের বারান্দায় দাঁড়ালে কিছুক্ষণের মধ্যেই মন ভালো হয়ে যায়। মাঝরাতে কোথাও বাতি জ্বালানো, কোথাও বা ঘুটঘুটে অন্ধকার...যেন হলুদ রঙের জোনাকি পোকা গেঁথে আছে কোথাও কোথাও, দেখতে বেশ লাগে।
ইদানিং আমার রুটিন হয়েছে, ঘুম ভাঙ্গার পর সোজা কিচেনে যাওয়া। চায়ের জন্য চুলায় গরম পানি দেয়া। প্রত্যেকটা কাজ খুব সূক্ষ্মভাবে খেয়াল করা হয় এই মাঝরাতে। এই যেমন গরম পানি চুলায় দেয়ার পর কিছুক্ষণের মাঝেই কেমন বিজ বিজ একটা শব্দ হতে থাকে। সুনসান নীরবতায় এই পানির শব্দটাও কেমন যেন অন্যরকম লাগে। মনে হয় কেমন এক শূন্যতা এসে জায়গা করে নিলো মনটার মাঝে। অদ্ভুত ভাবনা, তাই না?
চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আমি আবার ভাবুক হয়ে যাই। মাঝে মাঝে চিন্তা করি, হঠাৎ ঘুমটা কেন ভাঙল। এরকম কি আরো মানুষের হয়? তখন তারা কি করে? আমার মতই চা বানায়?
এলোমেলো এবং অবশ্যই অযথা চিন্তা ভাবনা। কি আর করা? আমার চিন্তা বলে কথা। অপদার্থ মানুষের চিন্তা এর চেয়ে ভালো কিছু হবার অবকাশ রাখেনা। “অপদার্থ” শব্দটা আমাকে নিলা বলেছিল। আমার সাথে সম্পর্কের শেষটা হয়েছে এই শব্দ দিয়ে।
মাঝে মাঝে মাঝরাতে নিলা কে ফোন করতে খুব ইচ্ছে হয়। ওর ঘুম ঘুম কণ্ঠটা আজো কানে বাজে। যার সাথে এখন কোন সম্পর্ক নেই, তাকে মাঝরাতে ফোন করা আমার কোন অধিকারের মধ্যে পড়ে না। চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই।
 
অনেকের কাছে শুনি, খুব উঁচু জায়গায় দাঁড়ালে নিচে তাকাতে নাকি ভয় করে। উচ্চতাভীতি যেটাকে বলে। অথচ আমার কাছে মনে হয়, ইস! একটা লাফ দিতে পারতাম। লাফ দেয়ার সময় মনের অনুভূতি কেমন হবে? মাথাটা নিশ্চয়ই থেতলে যাবে একদম। রক্ত পড়বে অনেক? কেমন হবে দৃশ্যটা?
অদ্ভুত সব খেয়াল...তাই না?
 
ইদানীং জীবনের ব্যর্থতাগুলো খুব ভাবায়। আর একটু গুছিয়ে রাখার অভ্যাস করলে এখন নিশ্চয়ই চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বারান্দায় দাড়িয়ে থাকতে হত না। জীবন নামের ব্যাপারটা আমার কাছে এখন একটা বিভীষিকা ছাড়া আর কিছুই নয়। খুব সুখী মানুষ এই কথা শুনলে আমাকে জ্যান্ত কেটে ফেলবে, আমি জানি। মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে, কাউকে সাথে নিয়ে এই বারান্দায় দাড়িয়ে ভোর হওয়া দেখি। মাঝরাতে ঘুম ভাঙলেও যেন গুটুর-গুটুর করে কথা বলার কেউ থাকে। ইদানীং আমার খুব সুখী হতে ইচ্ছে করে। প্রচন্ড হতাশায় ছেয়ে থাকা এই জীবনটা আমার কাছে এখন শুধুই একটা বোঝা। যাকে যখন তখন এমনকি মাঝরাতেও সহ্য করতে হয়। একাকীত্ব আসলে খুব খারাপ।
চায়ের কাপে আর দু/এক ফোঁটা চা অবশিষ্ট আছে, ভোরের আলো একটু একটু দেখা দিতে শুরু করেছে। চায়ের কাপটা হাত থেকে ফেলে দিলে এতদূরে আওয়াজ আসবে? নাহ, তেমন আওয়াজ আসলো না।তবে কিছুক্ষণ পর ভারি কিছু একটা পড়ে যাওয়ার আওয়াজ আসলো। চায়ের কাপের মত এটার আওয়াজও খুব ক্ষীণ হল।
 
ভোর ৬টাঃ
১৫ তলার অগোছালো মানুষটা মাটিতে পড়ে আছে অগোছালো ভাবে। আশেপাশে চায়ের কাপের ভাঙ্গা টুকরো। মাথা থেতলে রক্তে ছেয়ে গেছে চারিদিক।
 
বিঃদ্রঃ মাটিতে পড়ে যাবার আগ মুহূর্তে কেমন যেন অন্যরকম একটা অনুভূতি হচ্ছিল। খুব বেশি রকম শূন্যতা, কেমন যেন এক বিষণ্ণতা... তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমার কারো জন্য বিন্দুমাত্র খারাপ লাগেনি। বেঁচে থাকার প্রতি এত ঘৃণা মনের ভিতর লালন করে রেখেছিলাম, এটা চিন্তা করে খুব বেশি অবাক হয়েছি...     

No comments:

Post a Comment