03 December 2015

মাসুম বিল্লাহ



তকাল বাবুইর এস.এস.সি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। কয়েকদিনের জন্য মাঠে ক্রিকেট নিয়ে মেতে থাকতে পারবে। পরীক্ষার জন্য ব্যাট-বল হাতে নিতে পারেনি। বিকেলে সবার আগে মাঠে এসে বসে আছে বাবুই। মাঠের এক কোণে বসে আছে একা। বন্ধুরা কেউ নেই মাঠে। কিছুক্ষণ পরেই সবার দল বেঁধে মাঠে চলে আসবে। 
মাঠে এসেও বাবুইর মন ভালো হচ্ছে না। পরীক্ষার দেড় মাস আগেই ওর দাদুভাই মারা গেছেন। দাদুর মৃত্যুর কারণে বাবুই পরীক্ষাও ভালো হয়নি। বাবা-মাও সে কারণে বাড়তি চাপ দেয়নি। দাদুকে বাবুই অনেক পছন্দ করত। দাদু ছিল ওর সব সময়ের সঙ্গী। সময় পেলেই দাদুভাইয়ের কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনে। গল্প বলার সময় দাদু সহযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধাদের কথাই বেশি বলতেন। কিন্তু বাবুই বলত, দাদুভাই, তোমার নিজের কথা বলো। বাবুইয়ের কথা শুনে দাদু বলতেন, ‘নিজের কথা বলতে কেমন শরম লাগে দাদুভাই। 
এই মাঠেই দাদুর সাথে বাবুই কতো ঘুরে বেড়িয়েছে। আজ কেন জানি দাদাভাইয়ের কথা বেশি বেশি মনে পড়ছে। একটা কারণে বাবুই দাদুভাইয়ের ওপর অনেক মন খারাপ করেছিল। দাদু মাঝে মাঝেই কী সব যেন লিখত ডায়েরিতে। ডায়েরিটা দেখতে চাইলে, না না বলতেন। একবার চুরি করে পড়তে গিয়েও পারেনি বাবুই। একদিন দাদুভাই নিজেই বললেন, ‘যখন আমি থাকব না, তখন তুই এটা পড়িস দাদা ভাই।এতোদিন লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকার ফলে ডায়েরির কথা ভুলেই গিয়েছিল। আজ মনে মনে বাবুই বলল, বাসায় গিয়েই দাদুভাইয়ের ডায়েরিটা পড়তে হবে তো।


২.
বিকেলের সূর্যের রঙ কুসুম লাল রঙের হতে শুরু করেছে। দূরে গাছের মাথার ওপর দিয়ে নিচে নামছে একটু একটু করে। নীল-সাদা আকাশটা আর নেই। মন খারাপের আকাশ এখন। বকের সারি নীড়ে ফিরছে। বাবুই বন্ধুদের বিদায় জানিয়ে বাসার দিকে একা একা হাঁটা শুরু করে।
বাসায় ফিরে মাকে খুঁজছে। কাছে পিঠে মাকে দেখতে না পেয়ে, মা মা বলে ডাকতে লাগল বাবুই। পাশে রুম থেকে মা ছুটে এসে বললেন, ‘কী  রে বাবু, তোর কী হয়েছে, এভাবে ডাকছিস কেন?’ ‘মা, দাদু ভাইয়ের আলমারির চাবিটা দাও।  বাবুই আবার চাবি চাইলে মা বলেন, ‘তুই এই চাবী দিয়ে কী করবি?’
দাদু ভাইয়ের ডায়েরিটা আমার দরকার।জোর দিয়ে বাবুই বলল মাকে।
একটু রাগের স্বরে বলেন মা, ‘কী দরকার তোর। যত্ন করে রেখে দিয়েছি আলমারিতে।
মা, দাদুভাই ডায়েরিটা আমাকে পড়তে বলেছিলেন না? পরীক্ষার জন্যই তো এতোদিন পড়তে পারিনি। কিন্তু আজ পড়ব।  দাও তো মা ডায়েরিটা।
মা আর কথা না বাড়িয়ে ডায়েরিটা বের করে দেন বাবুইয়ের হাতে। ডায়েরি হাতে পেয়ে খুশী মনে রুমে চলে আসে বাবুই।


৩.
বাবুই ওর পড়ার টেবিলে টেবিলে রাখল ডায়েরিটা। পুরনো হয়ে পরা ডায়েরিটা ধীরস্থির হাতে মেলে ধরল। বাবুইয়ের বুকের ভেতর ধকধক্ করছে। মন বলছে, ‘কী লেখা আছে এতে। আমাকে পড়তে বলেছিলেন কেন দাদুভাই?’
প্রথম পাতা থেকে পড়া শুরু করল বাবুই। দাদুভাইয়ের জীবনের একান্ত কথা। সাথে অনেক উল্লেখযোগ্য ঘটনার বিবরণ। কিছু কিছু পৃষ্ঠায় এসে বাবুই আপন মনে হেসে উঠে। কিছু সময় পর বাবুই মন খারাপ করে অন্যদিকে চেয়ে থাকছে।
এভাবে বেশ কিছু পৃষ্ঠা পড়ে ফেলে বাবুই। একসময় আর পড়ে না। রুম থেকে বের হয়ে আসে। মিনিট বিশেক বাইরে কাটিয়ে ঘরে ফিরে আসে বাবুই।


৪.
ফাল্গুনের মাঝামাঝির এক বিকেল। ফুরফুরে বসন্তের মিষ্টি বাতাস সর্বত্র। মুক্তিযোদ্ধার দাদুর ডায়েরিটা আবারো পড়া শুরু করে বাবুই। কিছু অংশ পড়ার পর চমকে ওঠে। এ কী লিখেছে দাদুভাই, নিজের মনে প্রশ্ন করে। বাবুই অবাক হয়। এত দিন ধরে শুনে আসছি এক রকম, কিন্তু দাদুভাই কী লিখে রেখেছে এখানে? বাবুই যেখান থেকে শেষ করেছিলো সেখান থেকে আবার পড়তে লাগল। দাদু ডায়েরিতে লিখেছেন,

...তাদের মধ্যে আমিও একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম। ৯ (নয়) মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলো। স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে লাল-সবুজের পতাকা নতুন করে উড়ল। বুক ভরে দেশের মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিলাম। সবার চোখে আনন্দ। কে বলবে গতকালও সবাই যুদ্ধ করেছে। এরপর বাড়িতে ফিরে এলাম। আবার নতুন করে বাঁচার আনন্দ অনুভব করছি। কখনও ভাবিনি ফিরে আসতে পারবে জীবন নিয়ে।

...বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠিত হলো। বিধ্বস্ত দেশটা শক্ত হাতে পুন:নির্মাণ শুরু করল। সরকারকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল। এভাবে চলতে লাগল সব কিছু। কয়েক বছরের মধ্যে আমরা একটি সুন্দর বাংলাদেশ পেলাম। যেখানে, কোনো অভাব অভিযোগ নেই। কোথাও কোনো অন্যায়-অনিয়ম হয় না। যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সবাই মিলেমিশে বসবাস করছে দেশজুড়ে।

...একটানা দুই মেয়াদে দেশ পরিচালনা করল একটি দল। পরবর্তীতে তারা অন্য দলের কাছে স্বইচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দিল। ক্ষমতা পেয়ে অন্য দলও মন-প্রাণ ঢেলে দেশ ও মানুষের সেবার নিজেদের নিয়োজিত করল। শেষে...

***
ডায়েরির এই পর্যন্ত পড়ে বাবুইর মনে প্রশ্ন জাগলো, এইসব কি লিখেছে দাদুভাই? দাদুর লেখার সাথে তো আমার জানার সাথে কিছু মিলছে না। আজ এত বছর পরেও দাদুর  লেখার সাথে কোন মিল খুজে পাই না। স্বাধীনতার পর আমাদের দেশটা কেমন করে পরিচালিত হয়েছে, তা আমি বই পড়ে জেনেছি। বর্তমানে কেমন করে দেশটা পরিচালিত হচ্ছে, তাও তো দেখছি। কিন্তু দাদুভাই...! আর ভাবতে পারে না বাবুই। গায়ের জামা ভিজে ওঠে। বাবুইর মনে প্রশ্ন জাগে, তবে কি দাদুভাইয়ের কোন প্রকার বিকার দেখা দিয়ে ছিল? তাই এমন লিখেছে?
রাতের খাবার খাওয়ার জন্য মা এসে বারবার বাবুই কে ডেকে যাচ্ছেন। মা বিরক্ত হচ্ছে দেখে বাবুই খাবার রুমে গেল।


৫.
বাসার সবাই ঘুমিয়ে পড়লে বাবুই আবার ডায়েরিটা পড়া শুরু করে। কিছুক্ষণ পর বাবুই চমকে উঠল। মনে মনে বাবুই বলে, না আমার দাদুভাইয়ের মাথায় কোন গণ্ডগোল দেখা দেয়নি; তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।

দাদু ডায়েরিতে লিখেছেন,

...এমনই সুন্দর একটা দেশের স্বপ্ন দেখে ছিলাম সবাই। মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের জন্য যুদ্ধ করেনি। কোনো স্বার্থের জন্য, ক্ষমতার জন্য যুদ্ধ করেনি। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের আজ চরম অবস্থা। বলতেও লজ্জা হয় আমার। মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ ভিক্ষা করে,  কেউ রিক্সা চালায়। কেউ আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছেন। যুদ্ধে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁরা বেঁচে গেছেন। আমি যুদ্ধ করে একা এত বছর পর্যন্ত  বেঁচে থাকলাম, কিন্তু দেশের কোন পরিবর্তন হলো না, হলো না দেশের মানুষের। তবুও স্বপ্ন দেখি এই প্রজন্ম অথবা এর পরের প্রজন্ম নতুন করে দেশটাকে সাজাবে। আমরা তা দেখে যেতে পারলাম না, কিন্তু বাবুইরা হয়তো পারবে। বাবুইদের তো পারতেই হবে। কারণ চিরদিন একই রকম চলতে পারে না।

...স্বাধীনতার নতুন সূর্য উঠবেই। দেশটা বদলে যাবে, উন্নত হবে, শান্তির দেশে পরিনত হবে। স্বাধীনতার মানে, স্বাধীনতার সুখ খুঁজে পাবে আগামী মানুষ। হয়তো-তা আরও অনেক অনেক বছর পর। জানি, আমার স্বপ্ন সত্যি হবেই

***
ডায়েরি পাতা ঝাপসা দেখছে বাবুই। জলে ভরে গেছে  চোখ। হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে নেয়। তবুও এক ফোটা অশ্রু ডায়েরির পাতায় পড়ে। টের পায় না বাবুই। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। মনে দৃঢ় শপথ নেয় বাবুই। দাদুভাইয়ের স্বপ্নটা সত্যি করতে হবেই। রুম থেকে বের হয়ে বাইরে এলো ওপা বাড়ায় আঁধার রাত পেরিয়ে নতুন সকালের খোঁজে। 

No comments:

Post a Comment