01 December 2015

নিভৃতচারী




জায়গাটা সুন্দর। ছিমছাম। নিরিবিলি বেশ। ওরা এমনটাই চেয়েছে। একে অন্যকে একটু নিরালায়ও তো পেতে হবে। নগর জীবনে নিভৃতি কোথায়। দেড় কোটির শহর যেন উঁই ঢিবি। দম ফেলবি তো অন্যের ঘাড়ে। নিঃশ্বাস নিতে গেলে বিষ। ওরা তাই এমন কোথাওর কথাই ভেবেছে মনে মনে। তা ভাবনার এই বাস্তবতাটুকুও নেহায়েত খারাপ কিন্তু না।
কবোষ্ণ বিকেল। শান্ত লেকে পাড়ের গাছেরা সারে সারে ছায়া হয়ে ভাসছে। লেকের একটা অংশে দ্বীপ মত। তাতে যেতে ছোট্ট কাঠের ফুল পেরনো। তারপর তারও মাঝে অষ্টভুজ আকৃতির ঘর একখানা। চারদিক কাঁচে মোড়া। ছাউনিটা টালীর। ঠিক ফাস্টফুড শপ কিংবা রেস্টুরেন্টেও না। এই দুই এর মাঝামাঝি কিছু। যেন ওদের মত আরোর মৌন চাহিদার কথা ভেবেছেন কোনও উদ্যমী সামর্থবান। আর সেই মত এই আয়োজন।
কাঁচঘর ঘিরে স্নিগ্ধ বাগান। ইঁট বিছানো পায়ে চলার পথ। গোল টেবিল আর ছাতা। সংখ‍্যায় পর্যাপ্ত। তাদের ঘিরে প্লাস্টিকের সাজানো চেয়ার। খানিক দূরে ইটের পথটা কংক্রিট কলামের ওপর চড়ে লেকের পানিতে গিয়ে আর একটা ছোট অষ্টভুজা হয়েছে। এই মাচান ঘরের চারপাশটা খোলা আর ছাউনি খড়ের। বসার আয়োজন আছে, আছে খাবারেরও।
নিভৃতক্ষণ। নামকরণ মনে হয় সার্থক পুরোপুরি। এমনিতেই জায়গাটা শহর থেকে বেশ দূরে। তার উপর লোকজনের আনাগোনা নেই বললেই চলে। এবং নেই বলেই এখানে যারা আসে তারা আসেযখনই মনে হয় কিছুটা সময় নিভৃতিরও পাওনা। উদ্যোক্তা শৌখিন। বাণিজ্যিক ভাবনার থেকে বরং তার সৌন্দর্য ও রুচিবোধ প্রশংসার দাবী রাখে। ট্যুরিস্ট কিংবা শুটিংস্পট হিসাবে বেশ টুপাইস তিনি চাইলেই কামাতে পারেন। সে ইচ্ছে বোধকরি তার কম। নইলে এমন একটা জায়গা কী করে এমন ভিড় মুক্ত পড়ে থাকে। নিভৃতক্ষণের এই নির্জনতা ভবিষ্যতেও থাকবে, বলা যায়নাতবু যদ্দিন।
পানিতে মৃদু বাতাসে তোলা ঢেউয়ে গাছের সজল ছায়াদের তিরতির কাঁপন দেখতে দেখতে এইসব বিচিত্র ভাবছে ওরা। ঠিক ওরা না। ছেলেটা। মাচান ঘরে ওরা দুজনে বসে। সামনে টেবিলে রাখা কফি নির্বিবাদে মগেই জুড়িয়ে যেতে দিচ্ছে। অনেক্ষণ ধরেই ওরা চুপচাপ। কী জানি, চারপাশে ভিড়ে থাকা গভীর নৈঃশব্দের সরাসরি প্রভাবও হতে পারে!
হতে পারে। তবে পুরোপুরি না। ওরা আসলে বেশ কিছু দিন ধরেই একটা সিদ্ধান্তে আসতে চেয়েছে। সিদ্ধান্ত সে অবশ্য একটা নেয়া হয়েছে। কেবল মুখ ফুটে বলাটাই সমস্যা। কঠিন সমস্যা।
ওরা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না, কী দিয়ে শুরু করে। কিভাবে কথাটা তোলা যায়। একথা ঠিক যে, ছেলেটার চোখে স্বপ্নময়তা এখন আর ঝিলিক দেয় না। বাস্তবতা যেন এখন পরিণত পুরুষের কাঠিন্য নিয়ে তার মুখে চোখে এঁটে বসেছে দৃঢ়। মেয়েটা এখনও তার অদূর অতীতের কিশোরীসুলভ সরলতা মাখা। স্বপ্নের জাল বুনতে সবে শুরু করেছে। তার দুচোখে আজও হারিয়ে যাওয়ার হাতছানি।
টেবিলের দিকে চেয়ে চেয়ে ইতস্তত ছেলেটা ইতিউতি ভাবে খানিক, খানিক হিজিবিজি আঁচড় কাটে, কলম দিয়ে আঁকিবুকি করে তার নোটপ্যাডে। হঠা কী মনে হতে প্যাডের একটা পাতা ছিঁড়ে নিয়ে গোটা গোটা করে লেখে, ‘কী চাও?’ তারপর মেয়েটার কাছে ঠেলে দেয়।ভালোবাসামেয়েটা উত্তরে লেখে। ছেলেটা উদাস ভাবে ভাবে কিছুক্ষণ। নির্বিকার লেখে, ‘ভালো বাসার তো অনেক দাম।’ ‘কিন্তু আমি যে ভালোবাসি।যেন বোঝেনি কিছুই, ভাবখানা এমন ছেলেটার। কে বললো বাসি ভালো? বাসি কখনও ভালো হয় না।মেয়েটার আহত চোখে প্রশ্ন, ‘ভালোবাস, আমাকে?’ ‘আমি এমন কখনও বলিনি যে তোমাকে খারাপ বাসি!’ ‘তবে
লেখনি সংলাপ এর বেশি আর যায় না। দুজনেই দুজনের দিকে চেয়ে থাকে। অপলকে। কিছুক্ষণ কাটে এভাবে। এক সময় ছেলেটা উঠে পড়ে। চারদিকে তখন সন্ধ‍্যার ছায়াঘন বিস্তার। সন্ধ‍্যার কোমলতা নিয়ে বিহ্বল বোবামত মেয়েটাও ওঠে। আলতো হাত ধরে ছেলেটার। কোনও রকম অভিব্যক্তি সে চেহারায় ভাষা পায় না। বাঁ হাতে মুচড়ে রাখা নোটপ্যাডের ছেঁড়া পাতাটা আলগোছে ফেলে দেয় মেয়েটা। লেকের পানিতে কিছুই না পড়ার মত করে ছোট্ট দলা পাকানো কাগজটা পড়ে। এরই মধ‍্যে কখন মেয়েটার চোখ বয়ে নিঃশব্দে নেমে এসেছে এক ফোঁটা অভিমান। সে খেয়াল মাত্র করে না। অথচ দেখা যায় ছেলেটার একটা হাত উঠে আসে, গভীর মমতায় মুছে দেয় সে অশ্রুকণা। মেয়েটার ঠোঁট নাকি গোটা অস্তিত্ব হাসে, নিরুচ্চারেঠিক বোঝা যায় না।
বেশিক্ষণ হয়নি, ওরা একে অন‍্যকে অবলম্বন করে নিভৃতক্ষণছেড়ে গেছে। সন্ধ‍্যা রাত্রির দিকে পথ হাঁটা দিয়েছে সেও অল্পক্ষণ। তবে এই সন্ধ‍্যা বেশ খুশি।
কিছু আগে সন্ধ‍্যাময়তার পুরো প্রকৃতি একটা মায়াবী মুখের নিঃশব্দ হাসিতে অংশ নিয়েছে কিনা !

No comments:

Post a Comment