03 December 2015

সুধাংশু চক্রবর্ত্তী




পাগল হয়ে গেছেন
মৃন্ময়বাবু খাওয়ার টেবিলে এসে একটা চেয়ারে খেতে বসতে যেতেই বৌমা ঋরীতা ঝংকার দিয়ে উঠলো, ওখানে বসেছেন কেন? ওটায় মিমি বসবে। মৃণ্ময়বাবু মুখ কাচুমাচু করে উঠে গিয়ে পাশের চেয়ারটায় বসতে যেতেই আবার ঝংকার উঠলো, ওটায় আপনার ছেলে বসবে। আপনি নিজের ঘরেই গিয়ে বসুন। ওখানেই দিয়ে আসছি আপনাকে।
সত্তুরোর্ধ্ব বয়সের মৃণ্ময়বাবু যেন বোঝা স্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছেন তাঁরই হাত গড়া সংসারে। আজকাল কারো সাথে কথা বলেন না মন খুলে। যে ঘরটা একসময় বাতিল আসবাবপত্রে বোঝাই থাকতো, ঋরীতা সেখানেই মৃণ্ময়বাবুকে ঠুসে দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, তিনি এখন বাতিলের দলে। একমাত্র পুত্র সৌম, এই সংসারের বর্তমান কর্তা, দেখেও না দেখার ভান যে করে থাকে তাও বিলক্ষণ জানেন।
মৃণ্ময়বাবু একটা অপরাধবোধের বোঝা বুকে নিয়ে চলতে চলতেই একদিন কঠিন অসুখে পড়লেন। কথাটা চেপেও গেলেন ছেলে-বৌমার কাছে। আজ দুপুরের দিকে চাপতে না পেরে বিছানাটা নোংরা করে ফেললেন অসুস্থ শরীরে। দুর্গন্ধে ঘরে ঢোকা দায়। তবুও নিজেকে গুঁজে রাখলেন সেই ঘরে। ঋরীতা টের পেয়ে শুরু করে দিলো অকথ্য গালাগাল। পারলে এক্ষুনি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় তাঁকে। মৃণ্ময়বাবু ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গিয়ে বাথরুমে চলে এলেন বিছানার চাদর সমেত। অসুস্থ শরীরে কাঁপা হাতে চাদর ধুতে যেতেই গোটা বাথরুমটা গেল নোংরা হয়ে।
বৌমা ঋরীতা তাঁর পেছন পেছন চলে এসেছে নাকে আঁচল চাপা দিয়ে। বাথরুমটা নোংরা হয়ে গেছে দেখেই মাথায় খুন চেপে গেল তার। ছুটে এসে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে যেতেই অসুস্থ মৃণ্ময়বাবু আছড়ে পড়লেন বাথরুমের এক পাশে। মাথাটা সজোরে ঠুকে গেল সাবান রাখার তাকে। রক্তের ধারা নেমে এলো তাঁর মুখের ওপর। মৃন্ময়বাবু কী করবেন ভেবে না পেয়ে হি-হি করে হেসে ফেললেন কষ্ট চাপতে গিয়ে।
সৌম সেদিন অফিস থেকে ফিরে এসে জানতে পারলো, বাবা পাগল হয়ে গেছেন। যত তারাতারি সম্ভব তাঁকে পাগলা গারদে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। 




বদমেজাজি
প্যাডেলে যতটা সম্ভব জোরে চাপ দিলো মাধাই। রিক্সাটা সামান্য গতি পেলো তাতে। আরোহীর মুখে দেখা দিলো হাসির মৃদু রেখা। বদমেজাজি দিবাকর মাথার ওপর বসে এদিকেই তাকিয়ে আছেন গনগনে চোখে। ঠান্ডা মাথার মাধাই কপালে জমে ওঠা ঘামের বিন্দুগুলো নিংড়ে ফেলে দিলো বাম হাতের তর্জনী বেঁকিয়ে। রিক্সার গতি কিছুটা শ্লথ হতেই গরম মাথার আরোহীটি কষে ধমক দিলেন, এই গরমে ইয়ার্কি মারছিস নাকি রে?    
-কি দোষ করলাম দাদা? মাধাই অমনি বিনয়ের অবতার হয়ে গেল।
সে আজকাল অন্যদের মতো বাবু বলে আর সম্বোধন করে না আরোহীদের। কেন করবে? গতর খাটিয়ে খায়। কারও ধার ধারে না। সে কি কারও থেকে কম? মোটেও না। বাবুদের মতো পয়সা না থাকতে পারে, মানসন্মান বলে বস্তুটা তো রয়েছে দস্তুর মতো।
-কি দোষ করেছিস? তখন থেকে ঢিকিস ঢিকিস করে চলেছিস যে বড়? আর কখন পৌঁছে দিবি আমাকে? এই গরমে রিক্সায় বসে থাকতে কষ্ট হয় না? তোদের মোষের চামড়া বলে গরম-ঠাণ্ডা বোধটা না থাকতে পারে আমার তো আছে। আরোহীর গলা দিয়ে গরম সীসে এসে আছড়ে পড়লো মাধাইয়ের কানের পর্দায়। বিনয়ের অবতার মাধাই কিছু না বলে খানিকক্ষণ পরই রিক্সাটাকে নিয়ে এসে দাঁড় করালো মেলপুকুরের ধারে। তাকে থামতে দেখে আরোহীটি অমনি হাঁ-হাঁ করে উঠলেন, ওকি রে? এখানে থামালি কেন? আমি তো ঠাকুরপাড়ায় যাবো। 
মাধাই বিগলিত গলায় বললো, মোষের চামড়া কি না তাই টলটলে জলে ভরা পুকুর দেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম। একছুটে গিয়ে গা ভিজিয়ে নিই পুকুরের জলে। আপনি ততক্ষণ বটগাছের ছায়ায় বিশ্রাম করুন। হেঁ হেঁ হেঁ।  




তথাস্তু
ছেলে পলাশের জ্বালায় দিনভর অস্থির হয়ে থাকেন সুতপা। এটা সেটা ভাঙছে চোখের নিমেষে। ছাদের কার্নিশে উঠে বসছে ইচ্ছে হলেই। আবার কখনো জ্বলন্ত উনুনে জল ঢেলে দিচ্ছে জোর করে। সুতপা কপাল চাপড়ে ঈশ্বরকে ডেকে বলেন, হে ঈশ্বর, আর যে সহ্য করতে পারছি না। এবার একটা কিছু উপায় করো দেখি।
ঈশ্বর অলক্ষ্যে বসে শোনেন আর হাসেন। আজ আর হাসলেন না। বললেন তথাস্তু। সুতপা শুনতে পেলেন না। দুপুরে সবাই যখন ভাতঘুম দিতে ব্যস্ত, পলাশ তখন বাগানে গিয়ে হাজির। বাগানের প্রাচীন জামগাছে থোকা থোকা কালোজাম ঝুলে থাকতে দেখে তড়তড়িয়ে উঠে গেল গাছে। জাম খেতে ব্যস্ত পলাশ হঠাৎ শুনতে পেলো একটা শব্দ। মট্‌ পরমুহূর্তেই এসে আছড়ে পড়লো গাছতলায়। মাথাটা সজোড়ে আছড়ে পড়লো একটা আধলা ইটের ওপর। ছটফট করতে করতে একসময় স্থির হয়ে গেল কচি শরীরটা। কেউ জানলো না ।  
বিকেলে ঘুম ভাঙতেই ছেলের কথা মনে পড়লো সুতপার। ওরে পলাশ, আর পারি না বাপু তোর জ্বালায়। হে ঈশ্বর, এই দস্যি ছেলেটাকে তুলে নিয়ে আমায় রেহাই দাও দিকি। দিনরাত জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারছে!
কথাগুলি বলতে বলতেই ছেলেকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে সেখানে হয়ে অবশেষে বাগানে চলে এলেন। দূর থেকে দেখলেন পলাশ পড়ে রয়েছে জামগাছতলায়। হাতে ধরে আছে জামের থোকা সমেত কচি একটা ডাল। দেখেই সুতপা একবুক আশঙ্কা নিয়ে ছুটতে শুরু করলেন সেদিকে, হে ঈশ্বর, এ কি সর্বনাশ করলে আমার? কথাটা যে অনেক দুঃখে বলেছিলাম। তাবলে সেটাই সত্যি বলে ধরে নিলে-এ-এ-এ-এ।
 

No comments:

Post a Comment