01 December 2015

সানবির আলম





আতশী আয়না দিয়ে খুব সূক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল বাম হাতের রেখাগুলো। নাহ, কেমন যেন গণ্ডগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। লোকটার হাবভাব বেশি সুবিধার বলে মনে হচ্ছে না। অবশেষে রমেশবাবু বলেই ফেলল, ভাই, আপনার লক্ষণ বেশি সুবিধার মনে হচ্ছে না। দয়া করে এই কাজে যাবেন না। কাজটা বড়ই বিপদজনক। লোকটা চোখ রাঙ্গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনাকে কে বলেছে?
কেউ বলেনি, আপনার রেখায় সাক্ষ্য দিচ্ছে, জবাব দেয় রমেশবাবু।
লোকটা তখন কি জানি চিন্তা করে বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন চাচা। আমি সত্যিই একটা লোভের পিছনে ছুটে চলেছি। আমার ভাগ্যটাকে একটু বদলে দিন না। আমি শুধু হাত দেখতে জানি, ভাগ্য পরিবর্তনের ব্যাপারে তো তিনিই ভাল জানেন, যিনি উপরে বসে আছেন। রমেশবাবুর কথা শুনে লোকটা এক মূহুর্তের জন্যও বসে না থেকে চলে গেল।

প্রতিদিনকার মতো আজো তিন রাস্তার মোড়ে বসে মানুষের হাত দেখছে রমেশবাবু। বেশ ভদ্র টাইপের লোক। কথা খুব কম বলেন । সারাদিন মানুষের হাত দেখে ভবিষ্যৎ বাণী করলেও, ঘরে ফেরার পর নিজের ভবিষ্যৎ যে কি হয় তা কখনো আন্দাজ করতে পারতো না সে। সারাদিন বউয়ের ঘ্যান ঘ্যান শুনতে শুনতে কান দুটোতে তালা লাগার অবস্থা। আজো তার ব্যাতিক্রম হয়নি। ঘরে ঢুকার সাথে সাথে, "বলি, আজ কত টাকা রোজগার হলো, ঘরে আসতে দেরি হলো কেন, সারাদিন অলসের মতো বসে বসে মানুষের হাত না দেখে একটা কাজ জুটিয়ে নিলেই তো পারে" ইত্যাদি ইত্যাদি শুনতে শুনতে তার কান ঝালাপালা হয়ে গেল। এখন সে অভ্যস্ত। তাই বউয়ের কথার কোন প্রতিবাদ করে না সে। আর যখন করার ছিল তখন কোন প্রতিবাদ করেনি, এখন করলেই কি আর না করলেই কি? সে জানে, ঘর জামাই থাকতে গেলে তেমন কিছু কথা শুনতে হয়।

সোফার মাঝে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর সে বলল, কোথায় গেলে, এক কাপ চা দিয়ে যাও। তখন রান্নাঘর থেকে জবাব এলো, ব্যস্ত আছি। নাহ, রমেশবাবুর আজ চা খাওয়া হবে না। রিমোট দিয়ে টিভি অন করে পত্রিকার কাগজটা মেলে ধরলো।
-এই নাও তোমার চা।
পত্রিকার কাগজ থেকে চোখ ফিরিয়ে দেখে, তার স্ত্রী হাতে চা'য়ের কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রমেশবাবু যে অবাক! একি দেখছে আজ! চা'য়ের কাপটা হাতে নিয়ে তার স্ত্রীকে পাশে বসতে বলল। তার স্ত্রী পাশে বসলে সে আপন মনে স্ত্রীর হাতের ওপর তার একটা হাত রাখলো। হঠাৎ স্ত্রীর হাতের রেখার দিকে নজর পড়তেই সে চমকে গেল! হাবার মতো তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইল। এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে স্ত্রী জিজ্ঞাসা করল, "এভাবে কি দেখছো"
-না কিছু না, আজ তুমি একটু সাবধানে থেকো। নয়তো বিপদ হতে পারে।
রমেশবাবুর কথা শুনে তার স্ত্রী যেন হেসেই খুন! বলল, বাইরে যা-তা ভন্ডামি করে এসে এখন আমাকেও তাই বুঝাতে চাচ্ছো? তা কিন্তু হবে না"।
রমেশবাবু কিছু বলতে যাবে, তখন তার স্ত্রী আবার বলল, "ছাদে যাচ্ছি, কাপড় শুকাতে দিয়েছিলাম "। তার স্ত্রী চলে গেলে সে আবারো পত্রিকা পড়াতে মনোযোগ দিল।
হঠাৎ বাহিরে কারো চিৎকার শুনতে পেল। তার মনে পড়ল, একটু আগেই তো তার স্ত্রী কাপড় আনতে ছাদে গিয়েছিল। সে দৌড়ে ছাদে গেল। কিন্তু তার স্ত্রীকে সে দেখতে পাচ্ছে না। আসতে আসতে ছাদের কার্নিশের দিকে এগিয়ে গেল। তারপর চোখদুটো চলে গেল ছাদ থেকে সোজা মাটিতে। আর মুহূর্তেই চোখের পর্দায় ভেসে উঠলো একটা রক্তাক্ত মহিলার নিথর দেহ।
জেলখানার এক কোণে বসে রমেশবাবু বিড়বিড় করে কি যেন পড়ছে। চোখদুটো বন্ধ। যে লোকটা পুলিশ দেখে ভয় পেত, আজ সে জেলখানায় ফাঁসির আসামী। অভিযোগ উঠেছে, স্ত্রীর সাথে তেমন বনিবনা হতো না। তাই রমেশবাবু
নিজের স্ত্রীকে ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে মেরে ফেলেছে। অথচ রমেশবাবু তার স্ত্রীকে অনেক ভালবাসে। সে কি করে তার স্ত্রীকে হত্যা করতে পারে? আর একসঙ্গে থাকতে গেলে তো মাঝে মাঝে কিছু ঝগড়া হবেই।এটা তো সব সংসারেই হয়ে থাকে। হয়তো পা ফসকে, নয়তো মাথা ঘুরে ছাদ থেকে পড়ে গেছে" এই কথাটা সে কাউকে বুঝাতে পারছে না। তাই সে নিজের ভাগ্যকে মেনে নিতে বাধ্য হলো।
রমেশ বাবুকে এভাবে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে জেলখানার আরেকজন আসামী এসে রমেশবাবুর পিঠে হাত চাপড়ে জিজ্ঞাসা করল, এভাবে চুপচাপ কেন?
রমেশবাবুর নিশ্চুপ উত্তর, ভাগ্য গণনা করছি, কখন এসে যাবে সেই অন্তিম ডাক।

No comments:

Post a Comment