28 December 2015

আবু উবায়দাহ তামিম




=১=
অফিসের ছুটি হয়েছে আজকে অনেক তাড়াতাড়ি, তাই আজাদ সাহেবও এই সুযোগে বাড়ি না গিয়ে অফিস থেকে গন্তব্যহীন ঘুরে বেড়ানোর জন্য একটি রিক্সা ঠিক করলেন। রিক্সাওয়ালা কোথায় যাবে, কোথায় থামবে সে জানে না এমনকি আজাদ সাহেব নিজেও জানেন না তার গন্তব্য কোথায়! যেখানে মন চাইবে সেখানেই রিক্সা থামাতে বলবেআজাদ সাহেবের এই ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাসটা ছোটকাল থেকে আছে আগে স্কুল ছুটি
দিলে বন্ধু বান্ধবদের সাথে ঘু
রতেন, আর এখন অফিস ছুটি হলে একাই বেড়িয়ে পড়েন ঘুরে বেড়ানোর জন্য। তবে তার সেই বহুল পরিচিত সমস্যাটা তার সাথে আঠার মতোই লেগে রয়েছে।
স্কুলজীবনে তার এই হেলায় ফেলায় ঘুরে বেড়ানোর জন্য বাবা মা বহুত বকাঝকা করতেন, আর এখন তার চটপটে বৌ টা বকাঝকা করেন। বৌয়ের এই টকঝাল বকাঝকা শুনতে শুনতে আজাদ সাহেব অভ্যাস্ত হয়ে গেছে, তাই বৌয়ের বকাঝকা শুনে প্রথমে কিছুটা খারাপ লাগলেও পরে সেটা মানিয়ে নেন।জকেও কোথায় যাবেন তিনি কিছু ঠিক করেন নি। রিক্সার চাকা ঘুরছিল অবিরাম। আজাদ সাহেবের কথায় হঠা করে ব্রেক কষলেন মধ্যবয়সী রিক্সাচালকটি।
-এইখানে থামাও, আমি নামবোএই বলে আজাদ সাহেব রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া
দেওয়ার জন্য মানিব্যাগটি বের করলেন,
সেখানে সবগুলো একশ’ আর পাঁচশ’ টাকার
নোট।
ভাড়া হয়েছে ত্রিশ টাকা, কিন্তু ত্রিশ টাকা খুচরা নেই। আজাদ সাহেব কিছুক্ষণ মনে মনে কী যেন ভাবলেন। শেষমেষ তিনি রিক্সাওয়ালাকে একশ’ টাকার একটি চকচকে নোট বের করে বললেন, এটার পুরোটা রেখে দেন। এমনকান্ড দেখে রিক্সাওয়ালার চামড়া ভাঁজ পড়া চোখ দু’তিন বার লাফিয়ে উঠলো। বোঝা গেল সে খুব খুশি হয়েছে। বিষয়টি স্বাভাবিক করার জন্য আজাদ সাহেব তার বুকে হাত দিয়ে বললেন, ছেলে পেলেদের জন্য কিছু কিনে নিয়েন।
হঠা পিছন থেকে ‘স্যার’ বলে ডাক দিয়ে আজাদ সাহেবের সাদা শার্টে হালকা টান পড়ল। আজাদ সাহেব কোন কিছুতেই রাগেন না। জামা-কাপড়ে হাত দেওয়াটা তার মনবিরুদ্ধ একটা কাজ। তাই এখন তার মেজাজটা একটু খারাপ হয়ে গেলো। কপাল গুটিয়ে পিছন দিকে তাকালেন। পিছন দিকে তাকাতেই তার মুখ টা নিমিষেই কেমন যেন দরদমাখা হয়ে গেলো!
হালকা গড়নের একটি ছেলে লাজুক ভঙ্গিতে দাড়িয়ে আছে। তের চৌদ্দ বছর বয়স হবে। গায়ে একটা ফুল হাতার শার্ট, আর পরনে হাফ প্যান্ট। হাফ পান্টটা একটু ভাল মানের হলেও শার্টটা বেশ পুরোনো। দুইটা বোতাম নেই; ছিড়ে গেছে। মাঝের একটা দিয়েই শার্টের দুই পাশ একত্রিত হয়ে আছে শরীরে। ছেলেটার নাম মুঈন। আজাদ সাহেব বললেন, ‘কী হয়েছে বাবু? নাম কী তোমার? ছেলেটা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘স্যার, আমাকে কিছু সাহায্য করে যান। আমাদের সঙসারটা একেবারে অচল। আমার বাবা...।
আজাদ সাহেব খুব মনযোগ দিয়ে মুঈনের কথাগুলো শুনছিলেন; তার মন খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু তিনি শোনার সাথে আরেকটা বিষয়ও খেয়াল করলেন। ছেলেটা একটুও ভিক্ষুকের মতো নয়। না চাল-চলনে কথাবার্তায়, না চেহারা ছবিতে। ছেলেটা কে দেখে আজাদ সাহেবের খুব মায়া হল। একবার ভাবলেন, মানিব্যাগে
যতগুলো টাকা আছে সব ছেলেটা কে দিয়ে দেবেন, কিন্তু পরক্ষণেই তার চিন্তার
মোড় ঘুরে গেল। তিনি ভাবলেন ছেলেটি যদি অস হয়, যদিও তার হাবভাবে সেটা
মোটেও প্রকাশ পাচ্ছে না।
তারপর তিনি কিছুক্ষণ ভেবে চিন্তে বললেন, ‘আচ্ছা
মুঈন!
তোমাদের বাড়ি কোথায়? আমি যাবো সেখানে। আমি তোমার পরিবারকে সাহায্য
করবো।’
আজাদ সাহেবের কথায় ছেলেটি অবাক চোখে তাকিয়ে থাকলো তার দিকে। সে কখনো
কল্পনাও করে নি যে, এমন দরদী মানুষ এখনো পৃথিবীতে বেঁচে আছে।
সে জানত,
অনেক আগেই গত হয়েছে সেইসব হাতেম তাঈদের মতো মানুষগুলো।
পৃথিবীতে এখন শুধু
খারাপ মানুষদের বসবাস।

==
সন্ধা হয়ে গেছে অনেক, চারিদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। বেশী অন্ধকার নেমে এসেছে এই ছোট্ট বস্তিতেও, যেটায় মুঈনরা থাকে। আজাদ সাহেব মুঈনের সাথে মুঈনদের বাড়ি যাচ্ছে। আজাদ সাহেবের নিজের কাছে একবার খারাপ লাগলো যে, একজনকে সাহায্য করবে তাই বলে তার বাড়িতে যাচ্ছে। তবে মুঈনের মুখে একটি খুশির রেখা দেখা যাচ্ছে। এই বস্তির মানুষগুলো থাকে কিভাবে? একে তো সব ছোট ছোট ঘর। তারপর আবার আলো বাতাসের সমস্যা। বড় অদ্ভু এই মানুষগুলোর বসবাস। এমন নানান সব ভাবনা আজাদ
সাহেবের মনে ভীড় করল।
মুঈন আজাদ সাহেবের একটু আগে আগে হাঁটছিল। তারপর মুঈন বস্তির একটা ঘরের মধ্যে ঢুকে বলল, ‘আসেন স্যার ভিতরে, এটাই আমাদের ঘর।’ আজাদ সাহেব মুঈনের কথা শুনে সেই ঘরে প্রবেশ করলেন। মুঈন একটা ঘুনে খাওয়া চেয়ার এগিয়ে দিল আজাদ সাহেবকে বসতে। তিনি চেয়ারটা টেনে বসতে যেয়েও বসলেন না। কী যেন ভেবে আগের মতো দাড়িয়ে থাকলেন। মুঈনদের ঘরের মধ্যে ছোট্ট একটা মোমবাতি জ্বলছে। ঘরের একপাশে একটা  অনেক পুরনো চৌকি, তার উপর চি পটাঙ হয়ে শুয়ে আছে প্যারালাইসে আক্রান্ত মুঈনের বাবা। অন্যদিকে মুঈনের মা বসে বসে পাখা দিয়ে বাতাশ করছে অসুস্থ স্বামীকে।
এসব বেদনাদায়ক দৃশ্য দেখে খুব খারাপ লাগলো আজাদ সাহেবের কাছে। হঠা
তার চোখ গেলো মুঈনের টেবিলটার দিকে। কত সুন্দর করে বইপত্র দিয়ে সাজানো। তাহলে ছেলেটা পড়ালেখাও করে আবার। আযাদ সাহেবের মনটা অনেক নরম হয়ে গেছে এখন। তিনি মুঈনের মাকে ডেকে বললেন,‘আমি আপনাদের পরিবারকে সাহায্য করতে চাই। তাই বলে তিনি পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে যতগুলি পাঁচশ টাকার এবং একশ টাকার নোট ছিলো, সব দিয়ে দিলো মুঈনের মার হাতে। মুঈনের মা সঙসারের জন্য এতগুলি টাকা পেয়ে আনন্দে কেঁদে ফেললেন। তারপর আজাদ সাহেবের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘আল্লাহ আপনাকে অনেক সুখী রাখুক।’ মুঈনের মুখটা অনেক খুশী খুশী লাগছে এখন।

==
আজ অনেক রাতে বাড়ী ফিরছে আজাদ সাহেব। তিনি যেদিনই দেরী করে বাড়ি ফেরেন, তার রাগী বউয়ের কিছু ঝালবাটা কথা শুনতে হয়। এই ঝালবাটা কথার বেশ ভয় পান আজাদ সাহেব। কিন্তু আজ তিনি মোটেও ভয় পাচ্ছেন না। তার মনটা অন্যদিনের থেকে আজকে অনেক ফুরফুর লাগছে। তার হৃদয় টা আকাশের মত প্রশস্ত লাগছে। আজকে তার কাছে যতগুলি টাকা ছিলো তা মুঈনদের অনাথ পরিবারে দিয়ে আসার কারনে তার
পকেটে একটি পয়সাও নেই। তাই কোন রিক্সাতেও আসতে পারলেন না তিনি। স্নিগ্ধ
চাঁদের আলোয় উদাস মনে হেঁটে যাচ্ছেন তিনি। তার মনে বারবার ভেসে উঠছে মুঈন আর মুঈনের মার সুখ-দুঃখ মিশ্রিত হাসিগুলো-
তিনি ভাবলেন, পৃথিবীর সব ধনীরা যদি গরীবদের পাশে দাড়াত, তাহলে আর কেউ
দুঃখী হতো না। ভখন পৃথিবীতে কতো শান্তি বিরাজ করতো। ইশ...।



সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment