তুষার অফিস থেকে ফিরল সন্ধ্যার
পর। জুলাই মাসের গরম পড়ছে ঢাকা শহরে। শার্ট-পাঞ্জাবি ভিজে লেপ্টে থাকে পিঠের সাথে।
ভেজা জামা অথবা ব্লাউজের নিচ থেকে ভেসে ওঠে ব্রার ফিতা। ফাঁকা রাস্তায় হাঁটলেও
ঘামের গন্ধ পাওয়া যায়। পুরো শহরটাই যেন ঘেমে দুর্গন্ধময় হয়ে আছে। তিনতলার সিঁড়ি
ভাঙতে ভাঙতে তুষারের মনে হল, যে
সুনামের সাথে সে অফিস করছে, এভাবে
আর তিনটে বছর গেলেই সে অফিস করার জন্য এসি গাড়ি পেতে পারে। তার অফিস মেধাবী
ক্লায়েন্টদের জন্য অকৃপণ-হস্ত। অফিস, এসি-গাড়ি এইসব ভাবনা আসতেই পুরনো সেই অস্বস্তি চিনচিনিয়ে উঠল বুকের ভেতর।
এ-জীবন তুষার চায়নি।
তুষার খুব মেধাবী ছেলে। মেধাবী
ছেলেরা জীবনের শুরুতেই মস্ত ধাক্কা খায়। শুধু ছেলে কেন, মেয়েরাও খায়। অন্তত, চারপাশ
সচেতন চোখে পর্যবেক্ষণ করলে এমনটাই মনে হয়। খুব ছোটবেলায় তুষারের মা মারা যায়।
মায়ের খুব খারাপ ধরণের এক অসুখ নাকি হয়েছিল। তুষারের সেসব মনে নেই। কারো কাছে
জানতেও ইচ্ছে করে না। যে নেই, যে
চলে গেছে, তার চলে যাওয়ার আখ্যান জেনে কী
লাভ? মায়ের মুখটাই যেখানে স্পষ্ট
চোখে ভাসে না।
মা মারা গেলে বাবা দ্বিতীয়
বিয়ে করলেন। প্রথম খাবারের লোকমা মুখ থেকে পড়ে গেলে যতটা সহজে দ্বিতীয় লোকমা মুখে
তোলা হয়, বিয়েটা তিনি ততটা সহজেই করলেন।
আর করবেনই-বা না কেন? যুবতী
বউ হারিয়ে পুরুষ মানুষ আবার বিয়ে করে না, এমন ইতিহাস আছে নাকি! দ্বিতীয় মাকে তুষারের বেশ পছন্দ হয়েছিল। বাবার ছোটবউ
হলেও সে ছিল প্রথম বউয়ের থেকে বয়স্ক। পান খেতো খুব। ঠোঁটে সবসময় লেগে থাকত পানের
লাল রস। মামারা তুষারকে সৎমায়ের
কাছে রাখল না। একদিন খুব ভোরে দুই মামা এসে মা-মরা ভাগ্নেকে নিয়ে গেল গ্রামে, মামাদের বাড়ি। তুষারের বাবা শহরে ভূমি অফিসে চাকরি
করতেন। শহরের ধারে সরকারি কলোনিতে ছিল তাদের বাসা। তুষারের জন্মও হয়েছিল শহরের
নার্সিংহোমে। মা মারা গেলে শহুরে শেকড় উপড়ে গেল তুষারের। সেই শেকড় গ্রোথিত হল
গ্রামের ভেজা মাটিতে। দুই মামির ভালবাসায় তুষারের দিনগুলো কাটতে লাগল বইয়ের পাতার
রাজপুত্তুরের মত। কিন্তু কিছুদিন পর, তুষারের হাত-পা শক্ত হলে, সে আর
রাজপুত্তুর রইল না। সে হয়ে গেল মামাদের বাঁধা রাখাল। গ্রামে দুই মামা চাষের
কারবার। বিশাল গোয়ালে বিরাট বিরাট গরু। দুটো শক্তপোক্ত রাখাল তাদের দেখাশোনায়
নিয়োজিত। এদের সাথে তিন নাম্বার রাখাল হিসেবে যোগ দিতে হল তুষারকে। কত আদর, কত সোহাগ করে মামারা তাকে এনেছিল গ্রামে। সৎমায়ের কাছে ভাগ্নে বঞ্চিত হবে— এসব ছিল বাহানা। বোন মরে গিয়ে মামাদের বরং সুবিধা করে দিয়ে গেল। তারা
মাগনায় এক রাখাল পেল। রাখালি করলেও তুষার পড়াশোনা বন্ধ করল না। এসএসসি পরীক্ষায়
প্লাস পেল সহজেই। মামারা আপাদমস্তক চাষি-গেরস্থ। এ-প্লাসের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক
নেই। চেনেও না। মেট্রিক পরীক্ষার পর মামারা পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে বলল। এতিম ছেলের
এত লেখাপড়া দিয়ে কী হবে। জজব্যারিস্টার তো আর হতে পারবে না। শুধু শুধু অর্থ, সময় আর মেধার অপচয়। তুষারের এবার মামাবাড়ি ছাড়তে হল।
ছাড়তে মানে পালিয়ে যেতে হল। বাবার সাথে তার কোন যোগাযোগ ছিল না। তিনি উদাসীন
প্রকৃতির মানুষ। অফিসের বাইরে সারাক্ষণ বই নিয়ে পড়ে থাকতেন। তার যে প্রথমপক্ষের এক
বউ ছিল, সেই বউয়ের পেটের এক ছেলে ছিল— এটা হয়ত তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন। বাবার কাছে ফিরে যাওয়াটা
তাই বোকামী।
তুষারের পকেটে পয়সা ছিল।
মামারা মূর্খ, কৃপণ, তবে অমানুষ নয়। খাওয়া পরা ছাড়াও তুষারকে তারা মাসে মাসে পয়সা দিতো। তুষার
সেসব টাকার কিছুই খরচ করেনি। জমিয়ে রেখেছিল সামনের দুর্দিনের জন্য। মামাবাড়ি থেকে
পালিয়ে, শহরে এসে, পড়াশোনা না হওয়া এক কলেজে ভর্তি হল তুষার। শহরের ধারে
বস্তিতে সস্তার এক রুম নিলো। কলেজে পড়াশোনা নেই। একটা ছেলেও কোন বছর প্লাস পায়নি।
সেই ভাঙাচোরা কলেজ মেট্রিকে প্লাস পাওয়া তুষারকে পেয়ে বর্তে গেল। তুষারের কলেজ খরচ
ফ্রি হয়ে গেল। কলেজ না হয় ফ্রি হল, বস্তির
ঘরভাড়া তো ফ্রি হয় না। তুষার হাইস্কুল আর প্রাইমারি লেভেলের ছাত্রছাত্রী পড়ানো
শুরু করল। তুষারের পড়ানোর টেকনিক ভাল। তার কাছে যেই পড়ে ভাল রেজাল্ট করে।
ছাত্রছাত্রী হুড়মুড় করে তার কাছে আসতে লাগল প্রাইভেট পড়তে। তার দিন কাটতে লাগল
ভয়াবহ ব্যস্ততায়। কলেজে ক্লাশ, নিজের
পড়া, তিনচার ব্যাচ ছাত্র পড়ানো। এর
ফাঁকে সে গানের রেওয়াজ করতে লাগল। একদিন কলেজে যাওয়ার পথে এক দোতলার বারান্দায় সে
দেখেছিল সাইনবোর্ড। সুর-সাধনা একাডেমি। তুষারের গলায় সুর অাছে, গান তার গলায় ধরা দেবে এই কথাটা প্রথম বলেছিল ইকরামুল।
ইকরামুল মামাবাড়ির রাখাল। তুষারের এক সময়ের সহকর্মী। মাঠে গরু চরাতে গিয়ে ইকরামুল
গলা ছেড়ে গান গাইত। তার দেখাদেখি গুনগুন করত তুষারও। গুনগুন থেকে উচ্চস্বরে গেয়ে
ওঠা। ইকরামুল একদিন খুব খেয়াল করে কান পেতে শুনল। তারপর গম্ভীর গলায় সার্টিফিকেট
দিয়ে দিলো—আরে আরে! তোর গলায় তো মদু ভরা
তুষার। কী মানান কণ্ঠ! গান ধরে রাকতি পাল্লি তুই বিরাট শিল্পী হবি। ইকরামুলে
একতরফা প্রশংসায় সেদিন খুব লজ্জা পেয়েছিল তুষার। ইকরামুলের সামনে সহজে সে আর কখনো
গলা ছেড়ে গান গায়নি। তখন লজ্জা পেলেও তুষার এখন বোঝে, গানে কোন লজ্জা নেই। সুর স্রষ্টার দান। অবহেলায় ফেলে রেখে মরিচা ধরানো কোন
কাজের কথা নয়। সপ্তাহে তিনটে দিন বিকেলে তুষার সুর-সাধনা একাডেমিতে রেওয়াজ করে।
ওস্তাদ তাকে পরামর্শ দিয়েছে নজরুলগীতি রেওয়াজ করতে। নজরুলগীতি গাওয়ার জন্যই নাকি
তার গলার সৃষ্টি। সে যখন গায়—মোর
প্রিয়া হবে এসো রানী, দেবো
খোঁপায় তারার ফুল, বুকটা
চনমন করে। মনে হয়, কোন
নারীর খোঁপায় ফুল গুঁজে দেবার মতো স্পর্ধা দিয়ে তাকে পাঠানো হয়নি। তার জীবনটা
রঙচটা কালো ছাতার মতো। যা দিয়ে শুধু রোদ আর বৃষ্টি তাড়ানো যায়।
এসএসসির মতোই রেজাল্ট হলো
এইচএসসিতে। সামনে সবচে' বড়
লড়াই—ভর্তিযুদ্ধ। এসএসসির রেজাল্ট
একটা বেসরকারি ব্যাংকের দুইবছর মেয়াদি মাসিক বৃত্তির সুযোগ করে দিয়েছিল। সেই টাকার
একটা অংশ সে জমিয়ে রেখেছিল ভর্তি পরীক্ষার জন্য। তুষারের চান্স হল জাহাঙ্গীরনগর আর
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভর্তি হল জাহাঙ্গীরনগরে এবং তার পরপরই রজনী নামের এক
সুন্দরী মেয়ের খোঁপায় ফুল গুঁজে দেবার স্পর্ধা তাকে দেয়া হল। ফার্স্টইয়ারের
মাঝামাঝি সময়ে কী এক অনুষ্ঠান হল ডিপার্টমেন্টে। তুষারকে নজরুলগীতি গাইতে হল। কোন
প্রতিভাই মাটিচাপা থাকে না। তুষার গানের রেওয়াজ করে, তার গলা ভাল, ডিপার্টমেন্টের
অনেকেই এটা জেনে গিয়েছিল। তাদের চক্রান্তে ছেলে এবং মেয়ে, অনেক মানুষের সামনে তাকে গাইতে হল— শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে...।
অনুষ্ঠানে যশোরের মেয়ে রজনী
ছিল। সে গানের সচেতন শ্রোতা। তুষারের গান তাকে ছুঁয়ে দিলো। এবং এই গানের হাত ধরেই
সে তুষারের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ল। তুষারেরও অমন একজন সুহৃদের দরকার ছিল। যাকে
সবকিছু বলা যায়। সারাজীবন সে মানুষের স্বার্থপরতা দেখে এসেছে। উপদ্রবহীন ভবিষ্যতের
আশায় বাবা তাকে ছেড়ে গেছে। মামারাও তাকে ব্যবহার করেছে স্বার্থের ফসল ঘরে তোলার
জন্য। কলেজজীবনে অনেক শিক্ষকের কাছ থেকে পেয়েছে কটূ মন্তব্য। তুষারের মতো
স্বাধীনচেতা ছেলের পক্ষে যা হজম করা কঠিনই বটে। এই যখন সঞ্চয় জীবনের, তখন কি একটা নিঃস্বার্থতা মানুষের কমনীয় স্পর্শ সে অাশা
করতে পারে না! সেই স্পর্শটুকু দিল রজনী। তুষারের জীবনট্রাজেডি শোনার পরেও। তার একই
কথা, অতীতের শেকড়বাকড়ই মানুষের মূল
পরিচয় নয়। মানুষের পরিচয় তার বর্তমান এবং ভবিষ্যতে। তুষার যদি পড়াশোনটা চালিয়ে যায়
আর ভাল একটা জব করে, তবে
পেছনের ইতিহাস কেউ মনে রাখবে না।
তুষারের বর্তমান ভাল হলেও
ভবিষ্যত ভাল হল না। কৃতিত্বের সাথে সে অনার্স মাস্টারস শেষ করল বটে। কিন্তু ধরা
খেলো চাকরির চক্রে। আজকাল সরকারি কেরানির চাকরি পেতেই পাঁচসাত লাখ টাকা প্রয়োজন।
তাও লবিং ছাড়া সম্ভব না। আর একটু সম্মানজনক পোস্টে বসতে হলে প্রয়োজন অন্তত বিশ
লাখ। এত টাকা তুষার কোথায় পাবে। তার জীবনের হিসেব হাজারি সংখ্যার ভেতরেই বন্দি।
লাখ বহুত দূরের প্রশ্ন। তার টাকা নেই, মামুও নেই। সরকারি চাকরির আশা ছেড়ে সে চেষ্টা করতে লাগল বেসরকারি চাকরির
জন্য। সেখানেও তুষারের কপাল খোলে না। রজনী আর কতদিন তার জন্য বসে থাকবে। তার বয়স
বাড়ছে। বাড়ি থেকে বাড়ছে বিয়ের চাপ। আয়ের একটা ভালো উৎস থাকলে তবু বাড়িতে বলা যেত— ছেলের
কিছু না থাক একটা চাকরি আছে। এক বিকেলে মন খারাপ করে তুষারের কাছ থেকে বিদায় নিলো
রজনী এবং বাবা-মার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করে ফেলল। ভেতরে ভেতরে গুমরে মরা ছাড়া
তুষারের আর কিছুই করার থাকল না। প্রেমিকার বিয়ে হওয়ার পর আরো তিনবছর চাকরির জন্য
ছোটাছুটি করল তুষার। ফলাফল শূন্য। সে-সময়, জীবন থেকে তুষার যখন সম্পূর্ণ নিরাশ, তখনই খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনটা চোখে পড়ল। ধানমন্ডির এক বাবা মেয়ের জন্য
পাত্র খুঁজছেন। বিয়ে করলে মেয়ের বাবা ছেলের চাকরি দিয়ে দেবে। শর্ত শুধু একটাই—ছেলেকে হতে হবে মেধাবী, পরিশ্রমী আর সৎ। একটা চাকরির জন্য তুষার তখন
মরিয়া হয়ে উঠেছিল। রজনীর উপরও ছিল চাপা অভিমান। বেকার বলেই রজনী তাকে উপেক্ষা
করেছে। কানাখোঁড়া যাই হোক, বিয়ে
করে একটা স্বাস্থ্যবান চাকরি বাগিয়ে সে রজনীকে দেখিয়ে দেবে।
সেদিনই বিজ্ঞাপনের ঠিকানায়
হাজির হল তুষার। মেয়ের বাবার সাথে সরাসরি কথা বলল। মেয়ের বাবা রায়হান সাহেব
কোনকিছুই গোপন করলেন না। মেয়ে শর্ট আর কালো। সামাজিক মর্যাদায় সমকক্ষ এমন অনেক
জায়গায়ই বিয়ে দেবার চেষ্টা করেছেন। হয়নি। আজকাল কেউ কালো আর শর্ট মেয়ে জেনেশুনে
বিয়ে করতে চায় না। ছেলে খোঁজার ফাঁকে মেয়ের বয়সও বসে থাকেনি। হাল ছেড়ে দিয়ে তিনি
এখন এমন এক ছেলের সন্ধান করছেন, যে
হবে গরিব, যার চাকরির খুব প্রয়োজন এবং
মেয়েটাকে মন থেকে গ্রহণ করবে। তুষার রাজি হয়ে গেল।
বউকে তুষারের পছন্দ হয়েছে।
রোজি কালো হলেও অসুন্দর নয়। তার চেহারায় অন্যরকম ঔজ্জ্বল্য আছে। যা সবার চেহারায়
থাকে না। অল্পদিনের ভেতরে তুষার রজনীর স্মৃতি অনেকটাই ভুলে যেতে পারল। রজনীর জায়গা
দখল করল রোজি। সে অনেক ব্যস্ত এখন। রোজির নামে একটা ফ্ল্যাট অনেক আগেই কিনে
রেখেছিলেন রায়হান সাহেব। তারা দুজন স্বামী-স্ত্রী সেই ফ্ল্যাটে থাকে। তুষার
স্যুট-টাই পরে নিয়মিত অফিস করে। বিদেশি পার্টির সাথে মিটিং করে। আর বাসায় ফিরে
বউকে আদর করে। তার জীবনে এখন অপূর্ণতা বলতে কিছু নেই। পেছনের সেই দুঃসহ স্মৃতি এখন
আর তাকে তাড়া করে না। সে নিপাট ভদ্রলোক আর কর্তব্যপরায়ণ সুখী স্বামী। তবু হঠাৎ হঠাৎ, যখন
সে একা থাকে, মনে হয়, তার আর রোজির যে সম্পর্ক, এ কি শুধুই ভালবাসার সম্পর্ক? নাকি একটা চুক্তি? কিছু
সুযোগসুবিধা পাওয়া আর একটা কালো মেয়েকে বিয়ে করার চুক্তি! এ তো কোন ভালবাসা হতে
পারে না। তবে এটা সত্য, তুষার
সত্যি সত্যি রোজিকে ভালবাসে। এই চাকরির সুবিধাটুকু না পেলেও সে একইরকম ভালবাসত
রোজিকে। তবু বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে অস্বস্তির কাঁটা খচখচ করে ওঠে। এই অস্বস্তি কি
রোজিকেও নড়বড়ে করে দেয় না? তার
কি মনে হয় না, তুষারের মতো সুশ্রী, হ্যান্ডসাম ছেলের বউ হওয়ার যোগ্যতা তার নেই। সে এক কালো
খাটো মেয়ে। কালো মেয়ে তো সিন্দুকের মতো। যার ভেতর শুধু গহনা লুকিয়ে রাখা যায়।
কিন্তু নিজে গহনা হতে পারে না। গহনা আছে তো সে মূল্যবান। গহনা নেই, সিন্দুকেরও দরকার নেই। ভালবাসা আসলে কী? ভালবাসা বলতে কিছু কি আছে পৃথিবীতে? নাকি সবটাই মোকি! এই সংসারে পুরুষের কোন মূল্য নেই, যদি না থাকে তার টাকা। আবার নারীও মূল্যহীন, যদি সে হয় কালো অথবা কুৎসিত।
তুষার আর রোজি সংসারকে এগিয়ে
নিয়ে যায়। নিজেদের ভেতর সব কথাই শেয়ার হয়। তবু একটা জায়গায় দুজনেই যেন লুকোচুরি
খেলে। তারা দুজনেই বুঝতে পারে, তারা
লুকোচুরি খেলা খেলছে। কিন্তু কেউ কখনো মুখ ফুটে বলে না। যেন এই গোপন গোপন খেলা
খেলে যাওয়াই তাদের নিয়তি। অথচ তুষার এই জীবন প্রত্যাশা করেনি। তার টাকা কম থাক, কিন্তু ভালবাস থাক নিঃস্বার্থ। তা কি হয়েছে? হয়নি। তার আর তার স্ত্রীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে এক
স্বার্থের দেয়াল। চুক্তির ভালবাসা।
তুষারের অস্থিরতা বাড়ে।
সময়গুলো জট পাকিয়ে থাকে। বাইরে যতক্ষণ থাকে, ভাল থাকে। যখন ঘরে ফেরে, রোজির
সামনে এই দমবন্ধ পরিবেশে নিজেকে মনে হয় হাজতবাসী। শারীরিক মিলনের সময় শরীর আর আগের
মত সাড়া দেয় না। রোজির শরীর মৈথুন করতে গিয়ে কোমরের বাঁকে দাঁড়িয়ে পড়ে হাত। সেখান
থেকে আর নিচে নামে না। রোজিরও সেই একই অবস্থা। শরীরের উপর তান ঘেন্না জমে গেছে। সে
এমন এক রঙ আর অবকাঠামো নিয়ে এসেছে পৃথিবীতে, স্বাভাবিকভাবে কেউ তাকে গ্রহণ করেনি।
একদিন বিকেলে আগে আগে অফিস
থেকে ফিরল তুষার। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টাইয়ের নট খুলতে খুলতে বলল— চাকরিটা ছেড়ে দিলাম। স্বামীর চাকরি ছাড়ার কথা শুনে
পৃথিবীর সকল স্ত্রী-ই আঁতকে ওঠে। রোজি আঁতকে উঠল না। সেও যেন মনে মনে এই সংবাদটা
শোনার অপেক্ষায় ছিল বহুদিন ধরে।
No comments:
Post a Comment