28 December 2015

আবু রাশেদ পলাশ




আমাদের পাড়ার প্রকাণ্ড আমগাছটা বিরুদের। আদিগাছ। ওর জন্মের হদিস দিতে পারে এ পাড়ায় সাধ্যি কার? জন্ম থেকে আমরা কেবল স্বগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি ওকে। ওটা কথা কয় জান? মামুদপুর গ্রামের প্রতিটা ঘরে ঘরে সজল দৃষ্টি ওর। সকালের কাক যখন ওর মগডালে বসে কা-কা আওয়াজ করে বোধকরি সবাই শুনে সে ধ্বনি। সংসারের ছোট ছোট ব্যাপার নিয়ে আহালু আর নঙ্ক যখন কলহ করে তখন সে চোখ রাঙায় নিশ্চয়। রতনের ঘরে জোড়া সন্তানের আগমনবার্তা শুনে সেও আহ্লাদী হয়। দখিনা বাতাসে পাতাগুলো দোল খায় তখন।
বিরুদের আমগাছটার পাশেই তাদের প্রকাণ্ড ফলের বাগান। তাতে মৌসুমি ফলের নৃত্য সমাহার। এগুলো ঘিরে কত স্মৃতি আমাদের। সময়গুলো ঝাপসা হয়ে যায় দিনে দিনে, মুছে যায়না নিজ থেকে। গাঁয়ের ঘরে ঘরে সন্ধ্যায় বউয়েরা খড়ের গাদা পুড়িয়ে রাতের খাবার প্রস্তুত করে। তাদের সৃষ্ট ধোঁয়াগুলো শূন্যে এসে সমবেত হলে জোটবদ্ধ মেঘের রূপ নেয়। আমাদের মুহূর্তগুলো ও এখন তদ্রূপ। 
মামুদপুর গ্রামে বিরুদের বাড়ী রায়ের বিল হতে উত্তরে। শুকনো মৌসুমে বিল পেরিয়ে আসতে সময় লাগে বেশ। আষাঢ়ে বানের জলে যখন গ্রাম ভাসে বিলের ভাসা জল তখন আমগাছটার গোড়া ছোঁয়। এ পাড়ার বাড়িগুলোতে সাদা জল লুটোপুটি খায়, বিরুদের বাড়ীতে সে দৃশ্য গবেষণার ব্যাপার। ওদের দহলিজটা বেশ উঁচু, ঘরগুলো আরও। মাঝিপাড়ার জেলে গুলো বন্যায় ঘাট হিসেবে ব্যবহার করে আমগাছকে। ওর গোড়ায় কত কত নৌকা ভাসে তখন!
মাঝি বাড়ীতে মানুষ মোটে দুজন । বয়স্ক হবিরন বিবি ভাল করে চোখে দেখেনা দিনে, রাতে তো নয়ই। বিরুর বাপ গুনাই মাঝিকে আমরা চোখে দেখিনি কেউ। নাম শুনেছি কেবল। গুনাই মাঝি যখন পরবাসী এ পাড়ায় হয়তো আমাদের আগমনী বার্তা বাজেনি তখনও। আমাদের আগমন গুনাই মাঝির উত্তরসূরি হয়ে, এখনতো গাঁয়ে আমরাই বর্তমান ।

হবিরন বিবি কিন্তু মানুষ ভাল। পাড়ায় আমরা কোনদিন কলহ করতে দেখিনি তাকে। যেচে কারো সাথে কথা বলতেও যায়না সে। মরার আগে স্বামীর রেখে যাওয়া আবাদি জমিগুলো বর্গা দিয়ে সংসার চলে তার। মৌসুমি ফল বিক্রির টাকাও যসামান্য নয়। ফলে বিরুদের অভাবের মুখোমুখি হতে হয়না কখনই। বরং এ গাঁয়ে আর সবার থেকে দাপটে চলে তারা। ঘটা করে উসব পালন করে বিভিন্ন। গুনাই মাঝির মৃত্যু দিবসে পাড়ায় ঘরে ঘরে ভোগ দেয়। হা-ভাতে ছেলেগুলোও বছরে একদিন ভাল মন্দে উদরপূর্তির লোভ করে দিনকে দিন। এতকিছুর পরেও মনে কোথাও যেন দুঃখ ছিল হবিরন বিবির। সংসারে একমাত্র ছেলে যে তার অন্য দশটা ছেলেদের মত নয়, হয়তো এটা ভেবেই অশ্রু বিসর্জন দিত সে। যাহোক বিরু কিন্তু জন্মেই এমন ছিলনা। গাঁয়ের মক্তবে ছোটবেলায় যখন কায়দা পড়েছি আমরা তখন ওর বয়স যখন পাঁচ কি ছয়। কি এক অসুখে পড়েছিল ও। তারপর সুস্থ হয়েছে সত্যি তবে কথা হারিয়েছে মুখে। মনের ভাব প্রকাশ করতে গেলে এখন কেবল অ্যাঁ অ্যাঁ শব্দ করে সে। মুখে লালা ঝরে সারাদিন। বুদ্ধিটাও বোধহয় আটকে আছে শৈশবেই। বয়সের ভারে কেবল দেহ বেড়েছে তার বুদ্ধি বাড়েনি মোটেও ।
পাশের বাড়ীর নজুখাঁর বউ হাঁসুলি বিকেলে পাড়া ঘোরার বাহানায় হবিরন বিবির সাথে খোশগল্পে মাতে। পানের বাটাটা এগিয়ে দিলে মুখে পান চিবোয় সময় ধরে তারপর বলে-
-একখান কতা মুনে আহে, কমুনি চাচি? হবিরন বলে, শরমাও যে, কও হুনি?
-বিরু ভাইনি জন্ম পাগল?
-অমুন কইরা কও যে, পুলা মোর পাগলনি? হুগনা বাতাস নাগচে মালুম অয়।
পরক্ষণে কথা বাড়ায়না হাঁসুলি। সে তো জানে এ পাড়ার সবাই যখন বিরুকে পাগল বলে সাব্যস্ত করে কেবল হবিরন বিবি সত্যটা মানতে নারাজ। উত্তর পাড়ার নয়াব আলীর ষোল বছর বয়সী মাথা পাগল ছেলেটা, কথা বলতে পারেনা সেও। নিজের খেয়াল রাখতেও অপারগ সে। অসচেতন হলে হয়তো গোপন অঙ্গ প্রদর্শিত হয় জনসম্মুখে। কই, বিরুর মধ্যে তো এমন হাবভাব নেই। তাহলে পাগল সে নয় নিশ্চয়ই। হবরন বিবি বিশ্বাস করে একদিন ভাল হবে ছেলে। কিন্তু কবে? কেবল সে দিনটাই জানা নেই তার।
রায়ের বিলের তীর ঘেঁষে যে কাঁচা সড়কটা বাজারমুখী ধাবমান তার কূল ঘেঁষে আমাদের বাড়িটা। প্রত্যহ সওদা করে ফেরার পথে বিরুদের বাড়িটা পাশ কাটিয়ে আসতে হয় আমাকে। সুযোগ পেলে সপ্তাহে এক দুইবার যাওয়া হয় সেদিকে। হবিরন বিবি পুলকিত হয় তাতে। আমার আগ্রহ না জানি এতেই। হবিরন বলে, বিন্দেনি, দুস্তেরে দেকতে আইলি মুনে কয়?
-হাঁচা, হগগল ভালানি চাচি?
-ভালা, শিগগির যাসন্যা আইজ। খাসীর বেনুন রানছি বিরুর লগে দিমুনে।
ইচ্ছে না হলেও নিষেধ করা হয়না সহসা। সাহসেও কেমন ঘাটতি পড়ে যেন। মাঝে মাঝেই রাতের খাবার খেয়ে আসতে হয় আমায়। মাঝি বাড়ী গেলে বিরুটা কেমন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আচমকা দৃষ্টি গেলে ভেতরে কোথাও ব্যথা হয় যেন।

অগ্রহায়ণের গোড়া অথবা পৌষের শুরুতে বিয়ের ধুম পড়ে মামুদপুর। নতুন ফসলের আগমনে ঘরে ঘরে নবান্ন উসব করে মেয়েরা। কামলা গোছের উড়নচণ্ডী ছেলেগুলো কাঁচাপয়সা উপার্জনের মুহে পড়লে ঘরে নতুন বউ আনার পাঁয়তারা করে। বিরুর বয়সী গেঁয়ো ছেলেগুলো সংসারি হয় এক এক করে। বছর ঘুরতেই কারো কারো ঘরে নবজাতকের কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়। বিরুর ক্ষেত্রে সে দৃশ্য কল্পনাতীত। ওরও বয়স হয়েছে বেশ। অন্তত যে বয়সে গাঁয়ের ছেলেরা সংসার মুখী হয় তার চেয়ে বেশীই। কিন্তু মনে বিয়ের কোন গোপন মোহ নেই বিরুর। দুনিয়ার হদিস জানেনা যে, অ্যাঁ অ্যাঁ করলে মুখে লালা ঝরে তাকে মেয়ে দিবে কে? কিন্তু হবিরন বিবি সে সত্য মানতে নারাজ। এ কূলে ছেলে তার একটাই। মরার পর এ সংসারে হাল ধরতেও মানুষ চাই তার। বিরুর উপর ভরসা কই? ইয়ার বন্ধুরা সংসারি হলে তাই ঘরে ছেলের বউ আনার পাঁয়তারা করে হবিরন বিবি। গাঁয়ের বউয়েরা খোশগল্পের বাহানায় সমবেত হলে একদিন মনোবাসনা খুলে বলে সে।
-হুনছনি বুজান, পুলার বউ দেহার খায়েশ অয় দিলে। এক দুই কথায় বাঁধ সাধে কেউ কেউ। বউনি, পাগলারে মাইয়্যা দিব কেডা কও তো?”
তখন প্রতিবাদ করে হবিরন-মুখ সামাল দেও বুচির মা, পুলা কই পাগল না।
-হাঁচানি, বিয়া কইরে ভাত দিব পুলা?
-নিয্যস ।
হবিরনের কথা মিথ্যে নয়। এপাড়ায় মাঝি বাড়ীর প্রতিপত্তির কথা অজানা নয় কারও। সংসারে অভাবের ছিটেফোঁটাও খোঁজে পাওয়া দায়। কামলা গোছের অভাবী মানুষগুলোর কাছে পেটের ক্ষুধায় শেষ কথা। দিন শেষে উদরপূর্তি করতে পারলে আর কিছু চাইনা কেউ। কে জানে হয়তো এ মুহেই কেউ কেউ কন্যা সম্প্রদান করতে পারে বিরুর হাতে। চেষ্টা করতে দোষ কি?
বারুইল গ্রামের ধলাই শেখ সম্পর্কে স ভাই হবিরন বিবির। একই বাবার দ্বিতীয় ঘরের সন্তান সে। ঘরে বউ ছাড়াও একটা মেয়ে আছে তার। নানকি। আহ ! কি ভাল দেখতে মেয়েটা। যেমন স্বভাবে তেমন সৌন্দর্যে। বিরু যখন শৈশবে তখন ওকে ঘরের বউ করতে চেয়েছিল হবিরন বিবি। এরপর কত বছর পার হয়েছে সাহস করে ভাইকে সত্যিটা বলতে পারেনি সে। ছেলে যে তার অন্য দশটা ছেলের মত নয়, এটা ভেবেই মনকে সান্ত্বনা দিয়েছে সে। ধলাই শেখের আর্থিক অবস্থা ভাল নয় এখন। কে জানে, বোনের প্রস্তাব হয়তো মেনে নিতেও পারে সে। অন্তত একবার চেষ্টা করে দেখতে চায় হবিরন। বুড়ো কলিমুদ্দিন সম্পর্কে চাচাতো ভাই গুনাই মাঝির। একদিন তাকে দিয়েই ভাইয়ের বাড়ী প্রস্তাব পাঠায় হবিরন বিবি। তারপর দিনভর আর দেখা পাওয়া যায়না কলিমুদ্দির। সন্ধ্যায় ফিরে এসে জানায়-
-ভাই তোমার রাজি নয়গো ভাবি, মনোবাঞ্ছা ছাড়ান দেও ।
তবুও আশাহত হয়না হবিরন। মনে মনে ছেলের বউ খোঁজে বেড়ায় সে। পার্শ্ববর্তী কুলকান্দি গ্রামের মতিঘটক বিয়ের কাজে পোক্ত লোক। এ পাড়ায় কতজনেরইতো বিয়ের পাত্রী জোগাড় করে দিয়েছে সে। সে খবর কে না জানে। হবিরন বিবি খবর দিলে একদিন মাঝি বাড়ী দেখা যায় তাকে। হবিরন বলে, হগগল খবর হুনছ মালুম অয় ঘটক?
মতি বলে, , ভরসা কইরো ভাবী চাইলে বাঘের চোখ আইন্যা দিমু।
-হাঁচানি ভাই?
-নিয্যস, মিছা কওনের মানুষনি মুই?
মতি ঘটক দেখতে পটকা মাছের মত মানুষটা, কনে দেখার ছলে মোটা টাকা হাতিয়ে নেয় হবিরন বিবির কাছ থেকে। এক এক করে দিন যায় সহসা কনের সন্ধান মেলেনা কোথাও। একদিন আশাহত হয় হবিরনও। কদিন পরের কথা। জিন্দারপুর গ্রামের মহেশ আলী, সংসারে অসচ্ছল গেরস্ত সে। ঘরে নিদারুণ অভাব। অভুক্ত স্ত্রী সন্তানদের অহর্নিশ আস্ফালন বিচলিত করে তাকে। বড় মেয়ে তিলক পনের বছরে পা দিল এবার। এ বয়সী মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার প্রচলন গ্রামে। তিলকের বয়সী মেয়েগুলোর বিয়ে হয়েছে কবেই। কারও কারও কূলে সন্তানও আছে এখন। তিলকের বিয়ে হয়নি এখনও। বিয়ের বাজারে ওকে নিয়ে আগ্রহী হতেও দেখেনি কেউ। পাত্রপক্ষের অনীহার কারণ হয়তো মহেশ আলীই। এজন্য গাঁয়ে কত কথাইতো শুনতে হয় তাকে। লোকে বলে, মাইয়্যা নাউয়ের বশ করনি মহেশ, বিয়া দেওনা যে?
লোকে নিন্দা করলে মিথ্যা বলে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করে সে।
সে বলে, দিমুগো মিয়া ভাই, সরেস পুলা পাইন্যা যে। সরেস পাত্রের কিন্তু সন্ধান করেনা মহেশ আলী। মেয়েকে কোন ভাবে পার করার চেষ্টা করে সে । সুযোগ বুঝে মতি ঘটক বিরুর বিয়ের প্রস্তাব দেয় তাকে।
সে বলে, ভালা গেরছ মিয়া ভাই মাইয়্যা দিবানি?
মহেশ বলে, কেডা কও তো?
-মামুদপুর গুনাই মাঝির পুলা বিরু।
সংসারে এ দুঃসময়ে মতির কথা মনে ধরে মহেশ আলীর। এর কদিন পর ইয়ার বন্ধুদের সাথে নিয়ে মেয়ের বিয়ের পাত্র দেখতে যায় সে। কিন্তু ফিরে আসে আশাহত হয়েই। যদিও বিরুর কথা আগেই বলেছিল ঘটক কিন্তু সে সমস্যা যে যসামান্য নয় এটা বুঝেই পিছাতে হয় তাকে। তবে আশা ছাড়ে না মতি ঘটক।
মহেশ বলে, ইতা কেমুন কও ভাই মাইয়ানি গাঙ্গে দিমু । মতি বলে, পুলার মাও দুই বিঘা জমি দিব কয় দিলে বুঝ দেও। তখনও রাজী হয়না মহেশ। তবে এর কদিন পরই হঠা লোক মারফ খবর আসে বিরুর সাথে মেয়ের বিয়েতে রাজী সে। তবে জমি আগেই নিঃশর্ত লিখে দিতে হবে তিলককে। হবিরন বিবি আপত্তি করেনা তাতে। এ সংসারে আল্লাহ অনেক দিছে তাদের। সেখানে দুবিঘা সামান্যই। তাছাড়া বিয়ের পর তিলক তো এখানেই থাকবে। যেখানে ছেলে পাগল তার সেখানে বউয়ের নামে সামান্য সম্পদ থাকলে মন্দ কি?
তিলকের কাছে কিন্তু সত্য প্রকাশ হয়না কখনই। পাত্র কে, কি করে বিবাহ অবধি এগুলো অজানাই থেকে যায়। জানতো, ওর মত মেয়েদের এসব জানার অধিকার থাকেনা। সংসারে পিতা বলে পরিচিত যে মানুষটা তার ইচ্ছেই শেষ এখানে। তারপর বিয়ের দিনই হয়তো জীবনে বড় ধাক্কাটার মুখোমুখি হয় তিলক। স্বামী নামক যে মানুষটার কাছে নিজের সর্বস্ব বিসর্জন দিতে এসেছে সে, সে মানুষটা যে অন্য সবার মত নয় এটা ভেবেই অশ্রু বিসর্জন দেয় সে। তিলক কিন্তু মেয়ে ভাল, দেখতেও বেশ। পরদিন বউ দেখে ধন্য ধন্য করে গাঁয়ের বউয়েরা।
-হুনছনি বইচির মা বিরুনি বিয়া করছে কাইল।
-হাঁচানি, বউ কেমুন কও তো?
-চান্দের ঢং সরেস কপাল পাগলার।
তারপর এক এক করে দিন যায়। দিনে দিনে হয়তো সংসারে বিতৃষ্ণা বাড়ে তিলকের। দেখতে তো সে মন্দ নয়। বিরু ও হয়তো ভাগ্যের লিখন ওর। তাতে কি, পাগলের সাথে সংসার করা যায় কি? ভালবাসা প্রত্যাশী মেয়েটা রাতে স্বামীর জন্য উতলা হয়। অবুঝ বিরু ভ্রূক্ষেপ করেনা তাতে। হবিরন বিবি হয়তো বোঝতে পারে সবই। তথাপি তিলককে খুশী রাখার চেষ্টা করে সে। মহেশের অসচ্ছল সংসারে আর্থিক সহায়তা দেয় দিনকে দিন। এতে সামান্য সচ্ছলতা আসে মহেশের। মন্দ কি? বিরু পাগল বলেই হয়তো জন দশেক মানুষের উদরপূর্তি হয় এখানে।
হাতে কাজ না থাকলে তিলকের সাথে খোশগল্পে মাতে হবিরন। নানা সুখ দুঃখের গল্প করে দুজন। হবিরন বলে, পুড়া কপালগো বউ । আমি মরলে দেইখো বিরুরে।
সহসা জবাব দেয়না তিলক। এ সংসারে এসে দুবেলা দুমুঠো ভাত ছাড়া বিশেষ কিছুই পায়নি সে। তবু তাকে প্রবোধ দিতে হয়। নিজেকে প্রবোধ দেয় সে নানা কিছু ভেবেই।
এরপর এক জ্যৈষ্ঠের কথা। আম কাঁঠালের মৌসুমে জামাই দাওয়াত করে খাওয়ানোর রীতি আছে গ্রামে। জ্যৈষ্ঠের দাওয়াতে শ্বশুরবাড়ী যাওয়ার ফুরস হয়না বিরুর। এ সবের গুরুত্ব জানা কথা নয় ওর। অবশেষে তিলক একাই যায়। বাপের বাড়ী গেলে পাড়ার মেয়েরা জটলা করে ওকে ঘিরে।
আচ্ছা, মনাইয়ের কথা মনে আছে? জিন্দারপুর গ্রামের হাছন আলীর ছেলে মনাই। সংসারে আপন  বলে কেউ নেই তার। উদরপূর্তির তাড়নায় আগে বারুইল বাজারে দুদু শেখের দোকানে পেট খোরাক মজুরী খাটতো সে। কৈশোরে মনাইয়ের সাথে মন দেওয়া নেওয়া করেছিল তিলক। সম্পর্ক ওদের বিবাহ পর্যন্ত গড়ায়নি। যেখানে নিজের পেটের ভাত জোগানোর সামর্থ্য ছিলনা মনাইয়ের, সেখানে তিলকের ভরণপোষণ অসাধ্য ছিল তার। মহেশ আলীও রাজী হয়নি মেয়ে দিতে। দুদু শেখের দোকানেই কাজ করে এখন মোটা টাকার মালিক হয়েছে মনাই। বাড়ীতে ছনের দুচালা ঘর তুলেছে নতুন । বাপের বাড়ী এলে একদিন মনাইয়ের সাথে দেখা হয় তিলকের। তিলক বলে, ভালা আছ মালুম অয়? মনাই বলে, ভালা, আইছ কবে?
-কাইল।
তারপর সময় ধরে নানা কথা বলে দুজন। মনাইয়ের বিয়ে হয়নি এখনও। ইয়ার বন্ধুদের নিয়ে কনে দেখছে সে। তিলক রাজী থাকলে ওকেই ঘরে নিতে চায় সে। সেদিন রাতে হঠা ভাবনায় পড়ে তিলক। বিরুকে মনে করে অশ্রু বিসর্জন দেয় সে। তারপর আচমকা সিদ্ধান্ত নেয় বিরুর সাথে সংসার করবেনা সে। সত্য প্রকাশিত হলে হুঙ্কার করে মহেশ আলী। মরিয়ম বোঝানোর চেষ্টা করে মেয়েকে। সেবার মামুদপুর এসে আচমকা বদলে যায় তিলক। নানা ক্ষুদ্র ব্যাপার নিয়েও কলহ করে সে। ওকে দেখে অবাক হয় হবিরন বিবিও। তবুও মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে নিজেকে মানানোর চেষ্টা করে সে। বিরুতো কথা বলতে পারেনা। মনের কথা প্রকাশ করতে কেবল অ্যাঁ অ্যাঁ শব্দ করে সে। অবশেষে একদিন সত্য প্রকাশিত হয় হবিরনের কাছে। তিলক বলে, এ সংসার করবার নয়। হামাক ক্ষেমা দেন।
তিলকের ইচ্ছায় অনীহা প্রকাশ করেনা হবিরন বিবি। সম্পর্ক ইচ্ছের বাইরে হয়না কখনই। জগত সংসারে এসে অন্তত এ সত্যি জানা হয়েছে তার। বিরুতো পাগল, তিলক নয়। জিন্দারপুর খবর গেলে মেয়েকে নিতে আসে মহেশ আলী। প্রস্থানে জমিটুকু ফেরত দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে সে। হবিরন বলে, জমিনি, কথাখান ছাড়ান দেন। জমিখান বউয়ের। তিলক ফিরে গেলে সেদিন বিরুকে উঠানে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে দেখেছে সবাই। হবিরন বিবি সহসা থামানোর চেষ্টা করেনি তাকে । দিনের শেষে রাতের অন্ধকার ঘনতর হয়। এক এক করে নীরবতা নামে সর্বত্র। ঘুমে আচ্ছন্ন হলে মুখের লালায় বালিশ ভিজে বিরুর । অনাহুত ভবিষ্য ভেবে বিচলিত হয় হবিরন। বয়সের ভারে ন্যুব্জ মানুষটা যখন প্রস্থান করবে তখন ভবপারে নিজের বলে কেউ থাকবেনা বিরুর। গোত্রের মানুষে ভরসা কি, হবিরন বিবি না থাকলে হয়তো তার সবটুকুই কেড়ে নিবে সবাই। তখন বিরুর ঠায় হবে কোথায়, রাস্তায়?

এর কদিন পরের কথা। তখন মসজিদে ফজরের আযান হয়েছে কেবল। প্রকাণ্ড আমগাছটার মগডালে প্রত্যহ যে কাকের আওয়াজ শুনা যায়, তার কণ্ঠ ধ্বনিত হয়নি তখনও। হবিরন বিবি বড় ঘরের দরজা খুলে দেখে তিলক দাঁড়িয়ে । কি এক অদ্ভুত মুহে পড়ে আবার ফিরে এসেছে মেয়েটা। গাঁয়ে আমাদের ভিটেটা অযত্নে পড়ে আছে আজও। দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়া থাকে সেখানে। বছর পাঁচেক পর সেদিন গেছিলাম, আগাছা জন্মে পুরনো কবরগুলো নিশ্চিহ্ন প্রায় । আসার পথে দেখা হল বিরুর সাথে। আমাকে দেখেই অ্যাঁ অ্যাঁ করে এগিয়ে এল সে। তারপর টেনে নিয়ে ভেতরে বসাল যত্নে । ওর মুখে লালা ঝরে না আর। কথাগুলোও স্পষ্ট হচ্ছে দিনকে দিন। ঘরে নতুন মানুষ এসেছে । ওর বউ তিলক, কি এক অদ্ভুত মুহে পড়ে আজও এ অসম্পূর্ণ মানুষটির সাথে সংসার করে চলেছে। সম্পর্কের ভাষা হয়না কখনই। ওর অদ্ভুত ক্ষমতা থাকে কেবল। বিরুও হয়তো সম্পূর্ণ মানুষ হবে একদিন। কি কথা, কি বুদ্ধিতে। ওর পাশে তিলক আছে তো।   

No comments:

Post a Comment