28 December 2015

রাজীব চৌধুরী






মেয়েটাকে একবার সামনে থেকে দেখার জন্য মনটা আকুলি বিকুলি কেটে চলেছে পাঁজরের খাঁচায়। একবারের জন্যেও আমি তার মুখখানি দেখতে পাইনি। একটা শাড়ি একজন মানুষকে মানুষ থেকে পরীত্বে তুলে ধরতে পারে সেটা আজকেই প্রথম উপলব্ধি করছি। এত সুন্দর করে কেউ হাঁটতে পারে? হাঁটার দমকে পায়ের পাতা থেকে দুলুনি শুরু হয়ে নিতম্ব ছেড়ে চুলে দোলা দিয়ে চলেছে। বাসের হর্ন, রিকশার টুং টাং ছাপিয়ে আমার ভেতর শুধুই সে। কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছিনা আমি। একটা ফেরিওয়ালা এদিক থেকে ওদিক যাবার সময় আমার সাথে প্রায় ধাক্কাই খেলো। অথচ আমার বিকার নেই। আমি উদ্ভট নয়ন মেলে তাকিয়ে আছি। আর উদ্ভ্রান্তের মত হাঁটছি।
সে কি অপ্সরা?
ইন্দ্রসখি?
ইন্দ্রসভা ছেড়ে ভুল করে চলে এলো আমার সামনে?
ওর শাড়িটা সাদা। সাদা আমার প্রিয় রঙ। কাশফুল আমার ভালোলাগে। ভালোলাগে কাশফুলের সাগরে ভেসে বেড়াতে।কিন্তু সে তো শরতে। আজ ও শর নয়। আজ বরষা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি বয়ে যাচ্ছে আমার সামনে। আমি তুলোরঙা কন্যার তুলো মাখা শাড়ির দিকে তাকিয়ে আছি। মেয়েটার শাড়িতে সুক্ষ সাদা রঙের ফুল আছে। সুতোর ফুল। ফুলগুলোর মাঝে সাদাটে জরির কারুকাজ। আহা কি মাধুরীমা সেই জরির কারুকাজ। আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেল।
এর মাঝে সে দুবার রাস্তায় থেমেছে। একবার থেমে হাতে পড়া সাদা হাতঘড়ি দেখেছে। আরেকবার থেমে রাস্তায় চলন্ত বিলবোর্ড দেখেছে। আমি দুবারই তার সামনে যাবার চেষ্টা করেছি। পারিনি।
ওর ব্যাগটা ও সাদা।
সে কি আজ সাদা দিবস পালন করছে? সাদা কি কারো মনের রঙ হতে পারে?
পারে কি প্রিয় রঙ?
একজন নারী কতটা শুদ্ধ হলে সাদা পড়তে পারে?
সে এখন আমার ঠিক হাত পাঁচেক সামনে দাঁড়িয়ে একটা ম্যাগাজিন স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ম্যাগাজিন দেখছে। হায় কপাল আমার- তার কালো কুন্তলা চুলগুলো আমায় ওর মুখখানা দেখতে দিলোনা। আমি ওর চুলের মাঝে হারিয়ে গেলাম। মুখ ঢাকলো চুলে। আমি ঢেকে গেলাম ঘনকালো কালিমেঘে। ওর ছাতাটা ও সাদা। দুধেআলতা গায়ের রঙে সাদাটে কন্যাকে আমি এর মাঝে একবারের জন্যেও
আমি দেখতে পারলাম না।এ কি কপাল আমার?
আমি দুবার সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু আমি ওকে পেরিয়ে যেতে পারিনি। পেরোতে পারিনি রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা ভিখিরির জন্য। পেরোতে পারিনি ওপাশ থেকে আসা মানুষের জন্য। ওকে দেখে সব মানুষ ঠাই দাঁড়িয়ে গেছে কোথাও কোথাও। কোথাও ওর দিক থেকে মুখ ফেরাতে পারছেনা তরুন যুবা। এক বৃদ্ধকে দেখলাম শরীরের গোপনাঙ্গে বিচ্ছিরিভাবে চুলকে চুলকে ওর রুপসুধা গিলে চলেছে।
হতচ্ছারা!
ওর পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে মানুষের স্রোত।
এত মানুষ কেন আজকে। এত মানুষ কেন রাস্তায়? মানুষগুলো এই বৃষ্টিসকালে বেরোলো কেন? ওদের কি এত কাজ? ওদের জন্যেই আমি মেয়েটাকে একবার ও দেখতে পেলাম না। আমার মরনের পরেও আমি অতৃপ্ত থেকে যাবো মেয়েটাকে একবার দেখিনি বলে।
ওর হাঁটার পথে বন্ধুর অংশগুলো আমার চোখ রাঙ্গানি শুনছেনা।
ও থামছে না।

হাঁটার গতি আরো বেড়েছে। ওর দমক দমক চলাচল আমার হৃদপিন্ডে সাইক্লোন বইয়ে চলেছে।
বুকের ভেতরটা ধুকপুক করছে।
ঠোঁটগুলো কেমন ওর?
মোটা নাকি পাতলা?
সে কি টিপ পড়েছে?
কেমন টিপ?
সাদা?
কেমন ওর নাকফুলটা? কানের দুলগুলো ও তো চুলে ঢাকা। কেমন ওগুলো?
খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।ওর হাতের ব্যাগটা সাদা। ও কি সাদা কানের দুল পড়ে আছে? ওর নাকফুলের পাথরটা ও কি সাদা? ওর হাতের আংটিটা ও কি সাদা পাথুরে? ওর ঠোঁট দুটো নিশ্চিত সাদা নয়। গাঢ় লাল? টকটকে আগুনরাঙ্গা ঠোঁট দুখানি? নাকি গোলাপী মাসরুম? কোমল লাল গোলাপ?
ও কি আইশ্যাডো মেখেছে? চোখ দুখানি কেমন দেখতে? ওর চোখের ভেতর কি চোরাবালি আছে?
এভাবে পুরুষগুলো গিলছে কেন ওকে? সবাই হা করে তাকিয়ে তাকিয়ে ওকে চক্ষুধর্ষন করছে। আমি পেছন পেছন হাঁটছি।
দেখতে পাচ্ছিনা।
পাচ্ছিনা।
পাচ্ছিনা।
প্রতিটি পদক্ষেপে মনে হচ্ছে ও আমার চাইতে দূরে চলে যাচ্ছে। দূরে যাচ্ছে অযাচিত ট্রেন। সাদা ক্যানভাস। রুপের ডালি খেলা কন্যার দল। বাতাসী লেবুর ঘ্রাণ। ওর পারফিউম টা অসাধারণ। আমাকে এর মাঝেই মাতাল করে দিলো।

আরে আরেহ!
একটা দুষ্টু লোক ওর প্রায় হাত ছুঁয়ে চলে গেল তারপর আমার ও! লোকটা কি দেখেনা? নাকি ওকে একবার ছোঁয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে সবাই? ও কি আজকেই পৃথিবীতে এসেছে? ওর দিকে সবাই এভাবে তাকিয়ে আছে কেন? আরে হ...
ও হটাত করেই পেছন ফিরেছে।আর আমি দেখতে পেয়েছি ওকে।আমার চোখ দুটো আটকে আছে। আমি চোখ সরাতে পারছিনা। সময় থেমে গ্যাছে যেন। আমি স্টাচু হয়ে পড়েছি পথের বাঁকেই। একটা কাক উড়ে গেল। কা কা শব্দ কানে ঢুকছেনা। অনেক দূরে একটা বাস হর্ন চেপেছে তো চেপেছেই। আমি শুনছি তার ব্যর্থ ধীরলয়ের শব্দ। কয়েকটা লোক দৌড়ে যাচ্ছে বাসের দিকে। কিন্তু সেই দৌড় যেন ভয়াবহতম ভাবে ধীর। স্লো মোশনে কিছু পাখি উড়ে গেলো। একটা সুর্য আরো ধীরলয়ে ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে পশ্চিমের দিকে। আমি তবুও তাকিয়েই আছি। তো তাকিয়েই আছি। আমি তাকিয়েছি আর মনে হল আমি যেন লাল কেল্লার পৃথক স্তম্ভ। বয়সী বটের মত অচঞ্চল ফলধারী বৃক্ষ। জটাজুটধারী ঋষি। 

আমি ঠিক কতোক্ষন তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে? জানিনা। ওর মুখের একপাশ দেখেছি আমি। ঝলসানো সেই মুখের সবকিছুই আছে। শুধু কোনকিছুই ঠিকমতো নেই। কুকড়ানো চামড়ার মাঝে আমি একটা নষ্ট হয়ে যাওয়া চোখ দেখে স্তবির হয়ে গিয়েছিলাম অনেকক্ষণ! এর পরেই আমি হাঁটা শুরু করেছি অফিসের পথে। আজ অফিসে অনেক কাজ। এভাবে মেয়েদের পেছনে ঘুরলে চলবে? শুধু শুধু সময়টাই নষ্ট হয়...#


No comments:

Post a Comment