।। চুরি-ডাকাতির অণুগল্প ।।
এর পর কী হবে
—ডাকাতি করতে
এসে ধরা পড়লে কী হয় জানিস? ঠাশ-ঠাশ-ঠাশ-ঠাশ...ডিসুম-ডিসুম-ডিসুম-ডিসুম...
—জানবো না কেন?
যা যা জানতাম সে-সবই যে হয়ে চলে আমার সঙ্গে।
—এরপর কী হবে
জানিস? চটাস-চটাস-চটাস...ডিসুম-ডিসুম-ডিসুম-ডিসুম...
—জানবো না কেন? জানি
বলেই তো ঘেন্নায় মরে যাচ্ছি। ডাকাতেরও অধম যে থানার ওই...
—তাহলে বল এরপর
কী কি ঘটতে পারে তোর কপালে? ঠাশ-ঠাশ-ঠাশ...ডিসুম-ডিসুম...
—আর মেরো না গো
বাবুরা। বলছি বলছি। সব বলছি আপনাদের।
—বল–বল। না বলা
ইস্তক...ঠাশ-ঠাশ-ঠাশ...ডিসুম-ডিসুম...
—এগুলোই আবার রিপিট
হবে থানায় গিয়ে জমা হবার পর। তার সঙ্গে...
—তার সঙ্গে কী? ডিসুম-ডিসুম...ঠাশ-ঠাশ...
—ও বাবুরা গো-ও-ও, দারোগাবাবু যে সব ডিম...আমি আর বলতে পারবো না
বাবুরা। জানতে পারলে দারোগাবাবু যে আমাকেও হজম করে দেবেন গো-ও-ও-ও....
যাইহোক
ডাকাতটাকে ধরে বেঁধে নিয়ে গিয়ে থানায় জমা দেওয়ার পর দারোগাবাবু চোখ নাচাতে নাচাতে
বললেন–আগে ডাকাতির মালগুলো জমা দিন আমার কাছে।
বস্তুগুলো জমা দিলাম তাঁর কাছে।
দারোগাবাবু সেসব বস্তুর ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে সুখের হাসি হেসে বললেন–আপনারা এবার
আসুন। কী কী বস্তু জমা দিয়ে গেলেন সেসব আমি নিজেই লিখে নেবো ডায়েরীতে। এই কে আছিস,
ডাকাতটাকে গরাদে পুরে দে ।
।। আজগুবী অণুগল্প ।।
।। হ্যাঁচকা টানে ।।
আর হাঁটতে
পারছি না। কী মনে হতে এক হ্যাঁচকা টান দিয়ে রাস্তাটাকে লম্বায়
অনেকটা ছোট করে নিলাম। যে-বাড়িঘরগুলো
বিন্দুর মত দেখাচ্ছিলো সেগুলোর কাঠের
দরজায় ফুটিয়ে তোলা সূক্ষ্ম কাজগুলো পর্যন্ত স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। তবু শান্তি
পাচ্ছি না দেখে বসে পড়লাম রাস্তার ধারে। বসে পা দুটোকে টেনে ইচ্ছেমতো লম্বা করে
নিলাম। তারপর সেই পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দেখি বাড়িগুলো যেন
খেলনা বাড়ি হয়ে গিয়েছে! এই মরেছে। এখনকার বাহারি বাড়িগুলো প্রায় একই রকম দেখতে। কিন্তু কোন বাড়ি থেকে
সানাইয়ের শব্দ ভেসে আসছে বুঝতে পারছি না। ওই বাড়িতেই যে যাবার কথা
আমার। এখন কী করি?
অনেক ভেবে অতোগুলো থেকে একটা বাড়ি টেনে বড় করে
নিলাম। বাড়ির
ভিতর থেকে চাপা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে মনে
হলো। হয়তো বাপের বাড়ি ছেড়ে যেতে
হচ্ছে বলে মেয়ে খুব কান্নাকাটি জুড়েছে
। জানি সানাই
বাজানো হচ্ছে ওই কান্না চাপা দেবার জন্য। মন বলছে এই বাড়িটাই হবে। দরজার কড়া নাড়লাম।
খুট করে শব্দ তুলে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো একটা অচেনা মুখ– কাকে চাই?
-
আজ্ঞে, বরিশাল থেকে আসছি। অমিয়বাবুকে একবার ডেকে দেবেন?
-
কোন অমিয়? কোথায় থাকেন? কিছু বলতে পারবেন?
-
আজ্ঞে, এটা নিশ্চয়ই কোলকাতার চিত্তরঞ্জন এভিনিউ। বিয়ের নিমন্ত্রণ
পত্রে যে তেমনটাই লেখা আছে পড়েছি।
- ধুস্ মশাই। কোলকাতা কথায়? আপনি মশাই দিল্লিতে চলে এসেছেন। আর হ্যাঁ, এই জায়গার নাম চিত্তরঞ্জন পার্ক। চিত্তরঞ্জন
এভিনিউ নয়। এতোটা পথ নিশ্চয়ই প্লেনে চেপে এসেছেন? যদি তাই হবে তাহলে তো এমন ভুল হবার কথা নয়!
-
আজ্ঞে, হেঁটেই চলে এলাম।
- অ্যাঁ! হেঁটে এলেন! এতোটা পথ! পাগল নাকি?
- আজ্ঞে, রাস্তাটা অসম্ভব লম্বা লাগছিলো কিনা তাই এক হ্যাঁচকায় ছোট করে নিয়েছি।
তাই তো হাঁটতে কষ্ট হয়নি।
- তাহলে আর কী? আবার একটা হ্যাঁচকা টান মারুন। রাস্তাটা আবার ছোট হয়ে যাবে। পৌঁছে যাবেন কোলকাতায়। আমি মরছি অসুস্থ মেয়ের জ্বালায় আর উনি এসেছেন
বিয়ের নেমন্তন্ন রক্ষা করতে! যত্তসব পাগল ছাগলের কারবার।
অপরিচিত মুখটা
ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো মুখের ওপর ।
।। প্রেমের অণুগল্প।।
।। মাধুরী ।।
পশ্চিম আকাশ অনেকটা লাল হয়ে গিয়েছে শেষ বিকেলে। মাঠের ভিতর কিছু মানুষ শরীর চর্চায় মগ্ন। এক
ঝাঁক পাখি কলরব করতে করতে উড়ে গেল নীড়ে ফেরার তাগিদে। ক্লান্তির স্পষ্ট ছাপ লেগে আছে ওদের ডানায় । কে যেন পাশ দিয়ে
যেতে যেতে প্রায় ফিসফিস করে বলে গেল, ‘দু-চার কদম তো হাঁটা হলো। এবার বাড়ি ফিরে
যান। এই ঠাণ্ডায় বেশিক্ষণ বাইরে থাকবেন না।’
ফিরে যাবো কিনা ভাবছি তখনই দেখি এক
দল ছেলেমেয়ে হুল্লোড় করতে করতে এসে ঢুকলো মাঠে। এসে হাত-পা ছড়িয়ে
বসে পড়লো ঘাসের ওপর। জানি একটু পরই ওদের খিল খিল, হো হো রবে আন্দোলিত হবে এই বিশাল
মাঠের বুকে ঝুঁকে থাকা বিকেলের রক্তিম আকাশ, মাঠের ওপর দিয়ে ঝিরঝির করে বয়ে চলা বাতাস । ওরা খুব আনন্দ করবে, হুল্লোড় করবে সকলে
মিলে। কতক্ষণ হুল্লোড় করবে তাও মোটামুটি আন্দাজ করতে পারছি।
লম্বা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললাম। এই
বয়সটা একদিন আমারও ছিলো। আমিও রোজ
বিকেলে এমনই সময়ে এসে বন্ধুদের সঙ্গে প্রবলভাবে মেতে উঠতাম এই
মাঠের বুকে। বন্ধুদের পর আমার জীবনে এলো মাধুরী। বন্ধুরা দূরে
সরে গেল এক এক করে। রয়ে গেল শুধু মাধুরী। মাধুরীও একদিন...
এক ঠায়ে দাঁড়িয়ে ডুবে ছিলাম অতীতের
দিনগুলোয়। সহসা গুটিকতক রাতচরা পাখি উড়ে গেল মাথার ওপর দিয়ে। তাতেই নজরে এলো ধীরে ধীরে
একটা একটা করে তারা ফুটে উঠেছে সন্ধ্যের আকাশে। এই সেদিনও মাধুরী বলেছিলো, ‘বেশী
ঠাণ্ডা লাগিও না। ভুলে যাচ্ছো কেন তোমার এখন বয়স হয়েছে।’
আমাকে খুব ভালোবাসতো কিনা। সহসা মনে হলো মাধুরী যেন এসে আঁচল উপুড় করে রাতটা
নামিয়ে দিয়ে গেল মাঠের বুকে। যেন আরও একটা নিঃসঙ্গ রাত
নামিয়ে দিলো আমার এই একলা জীবনে।
কালো আকাশের বুকে ফুটে
উঠেছে অসংখ্য তারা। মিটমিট করে জ্বলতে থাকা তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলাম বিষণ্ণ
দৃষ্টিতে। ওই তারাদের ভিড়ে লুকিয়ে থেকে মাধুরী নিশ্চয়ই আমাকে
দেখতে পাচ্ছে।
।। রহস্য অণুগল্প ।।
।। দুষ্টুমি ।।
লোকটা বসে ছিলো মেলপুকুরে ছিপ ফেলে।
ছিপ দিয়ে মাছ ধরতে আমারও ভালো লাগে। কাউকে ছিপ নিয়ে মাছ ধরতে বসতে দেখলে আমার হাত
নিশপিশ করে। লোভ সামলাতে না পেরে লোকটার দিকে এগিয়ে গেলাম সন্তর্পণে। যেই তার পিঠে
হাত রেখে শুধোতে যাচ্ছি ‘কি ভায়া, মাছ টোপ গিলছে?’ অমনি কে যেন পেছন থেকে খিক্খিক্
করে হেসে উঠলো।
ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখি শুঁটকো মতো একটা
লোক কুঁতকুঁতে চোখে দাঁত বার করে হাসছে। কিছু বলার আগেই লোকটা অদ্ভুত একটা কান্ড
ঘটিয়ে বসলো। আমাকে এক ঝটকায় ফেলে দিয়ে হাতে ধরে থাকা বিশাল একটা ধারালো ছুরি সজোরে
চালিয়ে দিলো মাছ ধরতে বসা লোকটার পিঠে। লোকটার পিঠ নিমেষে এফোঁড়ওফোঁড়।
আতঙ্কে বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে দেখি
মানুষটাকে খুন করেই শুঁটকো লোকটা ঝাঁপিয়ে পড়লো পুকুরের জলে। ছুরিকাহত
রক্তাক্ত মানুষটা খুব ছটফট করছে পুকুরের
ধারে পড়ে থেকে। দ্রুত ছুটে গিয়ে ধরে করে উঠে বসালাম তাকে।
লোকটা উঠে বসে মুচকি হেসে বললো–যাকে
জলে ঝাঁপ দিতে দেখলেন সে হলো আমার ছোটভাই। খুব দুষ্টু ছেলে। জানেন আমিও খুব দুষ্টু।
আমাকে মাছ ধরতে বসতে দেখলেই ছুটে এসে ঠিক এভাবেই ছুরি মেরে জলে ঝাঁপ দিয়ে পালায়।
আজও ধরতে পারলাম না ওকে। যেদিন ধরবো সেদিন শাবল দিয়ে এমন কোপাবো যে জীবনে আর কখনো
ছুরি হাতে তুলবে না। ওই দেখুন শাবল। লুকিয়ে রেখেছি ঝোপের আড়ালে। একবার সুযোগ পাই
তারপর দেখিয়ে দেবো। হি-হি-হি ...
।। ঢপবাজির অণুগল্প ।।
।। চম্পক ।।
চম্পক। পাশের পাড়ায় থাকে। এই পাড়ায়
আসে আড্ডা মারতে বন্ধুদের সঙ্গে। নিজের পাড়ায় নাকি ওর কোনো বন্ধু নেই। অবাক কাণ্ড।
হয়তো ছিলো কোনো এক কালে। এখন কেউ আর ওর বন্ধু নয়। এই পাড়ার ছেলেদের তাতে তেমন
মাথাব্যথাও নেই। তবে ওরাও জেনে গিয়েছে এতদিনে। জেনে গিয়েছে চম্পক হলো ডাহা ঢপবাজ
একটা ছেলে। ও যেন ঢপ মারাটাকে একটা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। তাই এই পাড়ার
বন্ধুরা আড়ালে খুব হাসাহাসি করে ওকে নিয়ে। অবশ্য সামনে কিছু বলেনি কখনো।
চম্পক কিছুদিন এলো না ঢপ মারতে। আজ
এলো একেবারে কাছায় মোড়া হয়ে। এসে উদাস গলায় বললো–চারদিন হলো আমার বাবা মারা
গিয়েছেন। আগামী চব্বিশে মে বাবার শ্রাদ্ধশান্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। তোরা অবশ্যই
যাবি।
এই পাড়ার বন্ধুরা আর থাকতে পারলো না।
এই প্রথমবার ওকে মুখের ওপর বলতে বাধ্য হলো। বন্ধুরা ওর মুখের ওপর বলে বসলো –ঢপ
মারার আর কিছু পেলি না চম্পক? একেবারে বাবাকেই মেরে ফেললি ঢপ মারার চাপে পড়ে?
No comments:
Post a Comment