সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই দৈনিক পত্রিকার শিরোনাম দেখা প্রতিদিনের
রুটিন কাজল সাহেবের। কিন্তু আজকের দিনটা প্রতিদিনের চেয়ে একটু আলাদা। কারণ
আগামীকাল তার বিয়ে। এই তার মানে স্বয়ং কাজল সাহেবের। আর তাই হিসেব মতো আজ তার গায়ে
হলুদ। তবে গায়ে হলুদের কোন আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজন নেই। বাড়িতে লোকজনের আনাগোনাও তেমন
নেই। তবুও আজ সারাটা রাত ঘুম হয়নি। যতসব আবোল-তাবোল ভাবনা তার মাথায় ঘুরপাক
খাচ্ছে।
কাজল
সাহেব একটা সরকারি কলেজের বাংলার অধ্যাপক। এম এ ক্লাশে তার পড়ানোর বিষয়
রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস “যোগাযোগ”। আগামীকাল
ক্লাস নিতে হবে। তাই খবরের কাগজ না দেখে যোগাযোগে চোখ বোলাচ্ছেন। চোখ যোগাযোগের
পাতায় হলেও মনটা তার ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে ওখানে। নানা ভাবনায় মাথাটা ভরা। কিন্তু
কাল তো উনার বিয়ে। এখন পর্যন্ত কাউকে বলা হয়নি। এমন কী ছুটিও নেয়া হয়নি। বিয়ে নিয়ে
উনার কোন মাথা ব্যথা নেই। এমন ভাব উনার বিয়ে উনিই জানেন না। মনের ভেতর কেমন যেন
অজানা একটি ভয় তাকে তাড়া করে ফিরছে। সব সময় মনের মধ্যে অন্যরকম একটা চিন্তা তাকে
তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। সেই চিন্তাটাই সব সময় মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। বিয়ে হবে,
কার সাথে বিয়ে হবে, বিয়ের পর কি হবে, তার জীবনটা কেমন চলবে, বিশেষত যার সঙ্গে বিয়ে হবে সে কেমন হবে, এইসব নানা ভাবনা তাকে গ্রাস করছে।
এইতো সকাল
বেলাতেও তিনি যখন যোগাযোগ উপন্যাসটি পড়ছিলেন তখনও কুমুদিনীকে কেমন বেশ শান্ত নরম
মনের মনে হয়েছিলো। কুমুদিনীর দুঃখে মনটা ভার হয়ে উঠেছিল আর ঘৃণা জন্মেছিল
মধুসূদনের উপর। শুধু তাই নয় মেয়েদের তিনি বেশ ভালোই মনে করেন। কলিগ থেকে শুরু করে
পাড়াতো ভাবী আর পরিবারের মা-বোনেরাতো আছেনই সবার সাথেই কাজল সাহেবের বেশ সখ্যতা।
অথচ এখন কেন যে সেই বিশেষ একটি নারীর প্রতি তার এতো ভয়। এই সব আবোল-তাবোল ভাবতে
ভাবতে বিছানাটাকে আপন করে নেন...।
কলিং
বেলের শব্দ বিছানা ছাড়তে বাধ্য করে, উঠে গিয়ে দরজা খুলেন। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে খাবার দিয়ে যাওয়া কিশোরী মেয়েটি।
অথচ তিনি দেখতে পান সেই বিশেষ রমনীকে...। যার সাথে তার বিয়ের হওয়ার কথা। টেবিলের
উপর খাবারের টিফিন বাটিটা রেখে আবার যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় মেয়েটি। আকস্মিক কাজল
সাহেব বলেন- অনেকক্ষণ হলো এসেছো, এতক্ষণ লাগে দরজা খুলতে
-না ভাইজান। বলেই মেয়েটি চলে যায়।
এবার যেন
জ্ঞান ফিরে পান কাজল সাহেব। মাথায় আলতো করে বাড়ি দেয় আর মনে মনে বলে কি যা তা
ভাবছি। বলেই টিফিন বাটিটা খুলতে যায় কিন্তু এ এক আজব ঘটনা। তিনি দেখেন খাবারগুলো
সুন্দর করে টেবিলের উপর পরিবেশন করা। এবং কে যেন বারবার তাড়া দিচ্ছে খেতে বসার জন্য। সব কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। তাগাদা শুনে
তিনি বাধ্য হয়ে খেতে বসলেন। পাশে বসতে না বসতে একটি সুললিত মেয়ে কন্ঠ বলল-
খেতে এত
দেরী করো কেন? শরীর খারাপ করবে
না, তখন কে দেখবে?
আর এখন থেকে গরম গরম খাবার খেয়ে নেবে। কোন অনিয়ম চলবে না।
আবার যেন
সব গুলিয়ে ফেলছে। কে কথা বলছে তার সাথে! পুরো ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজে কারো দেখা
পেলেন না। এবার মনের ভেতর ভয় ঢুকে গেল। গা ছমছমে একটা ভাব তার উপর ভর করে।
আবোল-তাবোল ভাবতে ভাবতে ফ্রেস হওয়ার জন্য বাথরুমে ঢুকলেন। সেখানেও শুনতে পেলেন কেউ
যেন বলছে-
কি খেলে
না যে?
বেশিক্ষণ
বাথরুমের ভেতরে থাকতে পারলেন না। কোন রকম শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে একেবারে বাইরে বের
হওয়ার জন্য পা বাড়ালেন। দরজা খুলতেই স্পষ্ট শুনতে পেলেন কেউ যেন বলছে- কি খেলে না
যে। খাবারগুলো কি নষ্ট হবে? আর বেশিক্ষণ দাঁড়ালেন না, মানে দাঁড়াতে পারলেন না। বড় বড় পা ফেলে বের হয়ে গেলেন।
গিয়ে
বসলেন মোড়ের চায়ের দোকানে। বসে চায়ের জন্য অপেক্ষা করছেন কাজল সাহেব। দোকানি চায়ের
কাপটা হাতে দিতেই চায়ে চুমুক দিলেন। চুমুক দিতেই শুনলেন-
দুপুরের
খাবার না খেয়ে এই অবেলায় চা খাচ্ছো যে?
কথাটা
কানে আসতেই হকচকিয়ে গেলেন তিনি। চায়ের কাপটা প্রায় পড়ে যাওয়ার জোগাড়। তবুও কয়েক
চুমুক দিয়ে চায়ের দোকান ছাড়লেন। রাস্তা ধরে হাঁটছে তো হাঁটছে,
শরীরটা খুব ক্লান্ত লাগছে। দুপুরে খাওয়া হয়নি। তাই বাধ্য
হয়ে বাসায় ফিরলেন। এসেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন। শুতে না শুতেই ঘুমিয়ে পড়লেন...।
কেউ একজন
তাকে বলছে কেন আমাকে এত খারাপ করে তৈরী করলে, আমি তো এভাবে তৈরি হতে চাইনি। কুমুদিনী আমার কাছে মনটা
তৈরীর জন্য একটু সময় চাইলো বলে কেন বলালে-
সময় দিলে কী সুবিধে হবে! তোমার দাদার সঙ্গে পরামর্শ করে স্বামীর ঘর করতে
চাও। তোমার দাদা তোমার গুরু... এমন হাজারো প্রশ্নে জর্জরিত করছে তাকে। প্রশ্ন শুনে
কাজল সাহেব বুঝলেন এ মধুসূদন। তিনি বারবার তাকে বোঝাতে চাচ্ছেন তিনি তাকে তৈরি
করেননি, তিনি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নয়। এ কথা শুনে সে আরও ক্ষেপে যাচ্ছে। বলে কি না আমাকে কেন এমন
বাজে করে তৈরি করলে? আমি তো এভাবে
তৈরি হতে চাইনি। কেন এমন করে তৈরি করলে... তারপরও আমি বলিনি কি আমাকে মাপ করো আমি
দোষ করেছি... তুমি কেন আমাকে বাজে ভাবে উপস্থাপন করো। আর সব সময় কেন কুমুদিনীকে
ভালো ভাবে উপস্থাপন করো। সত্যিই কি কুমুদিনীর কোন দোষ ছিল না। তুমি একজন পুরুষ হয়ে
নারীর পক্ষ নিলে...
এমন
বাকবিতণ্ডার মাঝে কলিং বেলের শব্দে ঘুম ভাঙলো। তড়িঘড়ি করে বিছানাতে উঠে বসলেন।
আবার কলিং বেলের শব্দ শুনে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখে সেই কিশোরী মেয়েটি রাতের খাবার
নিয়ে হাজির। ঘড়ির দিকে না তাকিয়েই বুঝলেন আটটা বেজে গেছে। এখন আনা খাবারের টিফিন
বাটিটা টেবিলের ওপর রেখে দুপুরের টিফিন বাটিটা নিয়ে বেরিয়ে গেল মেয়েটি।
ফ্রেস
হওয়ার জন্য বাথরুমে ঢুকলেন, বেরিয়ে দেখেন খাবার গুলো দুটো প্লেটে সুন্দর করে পরিবেশন করা। মাথার ভেতর আবার
মধুসূদনের ভূত ঘোরাফেরা করছে। ভাবছে মধুসূদন কি তবে তার জীবনে কুমুদিনী রূপে
এসেছে। তবে কি মধুসূদন বোঝাতে চাইছে সত্যি তার কোন দোষ ছিল না। এই সব সাত পাঁচ
ভাবতে ভাবতে এক সময় খেয়াল করলেন তিনি খাবারের প্লেটের সামনে বসে আছে। খেতে খেতেই
কেউ একজন বলছে খাওয়া শুরু করো। খাবার সামনে নিয়ে বসে আছো কেন। বলেছি না খাবার
সবসময় গরম গরম খাবে। তার পাশের প্লেটের খাবার গুলো আস্তে আস্তে সাবাড় হয়ে যাচ্ছে।
এ দৃশ্য দেখে তিনি তো পুরোদস্তুর হতভম্ব। এমন সময় আবারো কলিং বেলের শব্দ। এখন আবার
কে এলো? দরজা খুলতেই
হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকলো কাজল সাহেবের দুই বন্ধু। তারা কোথা থেকে শুনেছে তার বিয়ে। তাই
এসেই ইর্য়াকি ফাজলামিতে মেতেছে বন্ধুদ্বয়। কিন্তু কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছেন না
তিনি। ভাবছেন যে এখানে বসে খাচ্ছিল মুর্হূতেই সে কোথায় গেল। এমন কী প্লেটটা
পর্যন্ত নেই। তবে এটা ভেবে একটু আশ্বস্ত হলো যে তবুও তো ঐ ভূতের হাত থেকে রেহাই
পাওয়া গেল। তাই বন্ধুদের সাথে তিনিও আড্ডায় মাতলেন।
কেমন করে
যে সময়টা কেটে গেল বুঝতেই পারলেন না। এক সময় বন্ধুদের চলে যাওয়ার সময় হয়ে গেল।
তারা ঘরের দরজা পার হয়েছে কি হয়নি, ওমনি সেই নারী চরিত্র হাজির।
এসেই শুরু করলো জেরা-
-কি! এতো
রাত পর্যন্ত আড্ডা দেয়া। আজকেই শেষ, ইচ্ছে হলে আরও কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে নিতে পারো। বিয়ের পর আড্ডা দেয়ার কথা মুখেও
আনবে না। সে যাই হোক, খাবারগুলো
ঠান্ডা হয়ে গেল না। এসো খেয়ে নাও। কই এসো।
কাজল
সাহেবের চোখ দুটো পুরো ছানাবড়া। কি হচ্ছে এ সব? বিয়ে করতে চেয়ে সে তো মহাবিপদে পড়ে গেছে। এমন সময় সে টের
পেল কেউ একজন তার হাতটা ধরে হেঁচকা টান দিয়ে তাকে বিছানায় ফেলে দিল। পাশে বসে আছে
সেই রমনী। পুরো অগ্নিমূর্তি চেহারা। একেবারে কালী চন্ডীকেও হার মানায়। তাড়াতাড়ি
করে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলেন। ভাল করে চোখ রগড়ে দেখেন বাড়ি ভরা মানুষ,
হলুদের আয়োজন চলছে। সেই অগ্নিমূর্তি রমনী বোনের মেয়ে লাবণ্য
পাশে বসে ডাকছে-
ছোটমামা
চলো, সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। ও
ছোটমামা চলো, ওঠো,
ওঠো বলছি। এতো ঘুমালে চলবে...।