দুইহাজার ষোল’র একুশে বইমেলায় “প্রতিকথা” থেকে প্রকাশিত হয়েছে বর্তমান প্রজন্মের কথাশিল্পী জাকিয়া শাপলার প্রথম গল্পগ্রন্থ “খুন”। বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন, আইয়ুব আল আমিন। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে পাঠকবৃন্দকে। সমাজ-সম্পর্ক এবং মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নিয়ে চমৎকার সব কথাগল্পের জন্ম দেন জাকিয়া শাপলা এবং শুধু গল্পই নয় বাংলা কবিতার ভূবনেও রয়েছে দীপ্ত বিচরন। নারায়নগঞ্জে জন্ম নেয়া এই কথাশিল্পী ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত রয়েছেন। দীর্ঘদিন যাবৎ লেখালেখির সাথে যুক্ত থাকলেও এটিই প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ।
গল্পগ্রন্থের প্রথম গল্পটির নাম “খুন”। নামকরণেই গল্পের মূল আভাস পাওয়া গেলেও এর ভেতরে আরও একটা গল্পের জন্ম দিয়েছেন এর রচয়িতা। বহুতল ভবনের বাসিন্দা রিনা ভাবির খুনকে কেন্দ্র করে দৃশ্যের অবতারনা। দৃশ্যকল্পে মূল চরিত্র চারতলার বাসিন্দা শম্পা। যার বয়ানে দেখতে পাই দশতলার রিনা ভাবি খুন হবার পর এর প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে যায় তার নিজের মাঝে। ভাবনালগ্নে একসময় নিজ স্বামীর অস্বাভাবিক আচরণে খুনী সন্দেহের তীরটি সেদিকেই যায়। গল্পের এক অংশে দেখা যায় মধ্যরাতে তেলাপোকা খাওয়ার বীভৎসতার দৃশ্য অঙ্কিত করে মানসিক ভারসাম্যহীন দ্বৈতসত্তার অধিকারী শম্পার স্বামী রাহুল।
ঠান্ডা মাথার মানুষ শম্পা আইনের আশ্রয় নেয় নিজের মেয়েকে বিপদমুক্ত রাখতে। গল্পে “খুন” এর সাথে সাংসারিক সম্পর্কের একটা সরল দৃশ্য বেশ দক্ষতার সাথে যুক্ত করেছেন লেখিকা। রাজনৈতিক বেড়াজালে অপরাধ ঢেকে রাখার প্রবণতা এবং অন্যায়কে চুপচাপ মেনে নেবার যে রুপকল্প চিত্রিত হয়েছে তা প্রশংসনীয়। গল্পের মধ্যভাগে প্রকাশিত হয়। শম্পার আইনি সহায়তা নেবার কথা, স্বামী রাহুল জেনে যায় এবং ভেতর থেকে বিপরীত পরিকল্পনার জন্য নিজেও তৈরি হয়। পেশায় রাহুল একজন মেধাবী চিকিৎসক। তার বিপরীত পরিকল্পনার জন্য এগিয়ে আসে তারই চতুর রাজনৈতিক ভাই। দেশত্যাগের পরিকল্পনা হয় কিন্তু গল্পের শেষ দৃশ্যে দেখা যায় শম্পা তার নিজ স্বামীকে কৌশলে বিষ খাইয়ে দেয়।
গল্পটি এখানেই শেষ হতে পারতো কিন্তু লেখিকা এর রেশটুকু নতুন দৃশ্যের অবতারনায় শেষ করেছেন যেখানে দেখা যায় নিজের একমাত্র মেয়েকে বাঁচাতে যে লড়াইটা চলছিলো এতদিন সেই মেয়েই বাবার অস্বাভাবিক আচরন গুলোর প্রারম্ভিকা শুরু করে দিয়েছে।
গ্রন্থের মধ্যভাগে রয়েছে যে গল্পটি নাম তার “এলিয়েন” গল্পের প্রথম অনুচ্ছেদ এ উঠে এসেছে একটি পরিবারের কথা। পরিবারের কর্তা মোফাজ্জল সাহেব একজন সরল প্রকৃতির মানুষ এবং ফিরোজা বেগম উনার স্ত্রী। দুই সন্তান মিতুল ও টুম্পা। গল্পের মূল চরিত্র “মিতুল”। উচ্চ মাধ্যমিকে পড়–য়া এই ছেলেটির বিজ্ঞানের প্রতি খুব ঝোঁক। হাস্যরস অবস্থায় শুরু হলেও গল্পটির দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ থেকে কল্পবিজ্ঞানের দৃশ্যপট শুরু হয়।
মিতুল গুগল সার্চের মাধ্যমে জানতে পারে বিজ্ঞানী যোসেফ স্টেফিং পৃথিবীতে ভীনগ্রহের প্রাণীর অস্তিত্বের শংকা প্রকাশ করেছেন। এই ভীনগ্রহের প্রাণী যে কোন রুপে যে কোন স্থানে মানুষের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। এই তথ্য জানার পর থেকেই ভাবনায় ভাসে মিতুল। যার প্রভাবে দেয়ালের টিকটিকি কেও মনে হয় ভীন গ্রহের প্রাণী। চলতিপথে দেখা কালোরঙের মানুষদেরও মনে হয় ভীনগ্রহের মানুষ। এভাবেই গল্পের ধারাবাহিকতায় একসময় ভীনগ্রহের মানুষটির অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। ল্যান্ডলাইনে কল করে বসে সেই প্রাণী কিন্তু বিষয়টা বিশ্বাসযোগ্য হয় না তার।
এরপর একদিন ভোর বেলায় খেলতে গিয়ে দেখা হয়ে যায় ভীনগ্রহের প্রাণীর সাথে। কথায়-কথায় জানতে পারে বর্তমান সভ্যতা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে না। ভাবগত উন্নতি না হবার জন্যই পৃথিবীতে মহামনীষিদের আর জন্ম হচ্ছেনা এবং এই পৃথিবীর মানুষগুলোও ঈশ্বরের সৃষ্টি নয় এইসব মানুষ ভীনগ্রহের এলিয়েনদের সৃষ্টি এমনকি মনুষ্যজাতীর হিংস্রতা দমন করতে বেশ কিছু ভীনগ্রহের এলিয়েন মানুষদের দলে মিশে আছে। পিশাচ মানুষদের দমন করে সুন্দর পৃথিবী প্রতিষ্ঠা করাই তাদের লক্ষ্য। গল্পের শেষ অংশে দেখা যায় ভীনগ্রহের প্রাণী দাবী করে বসে মিতুলও তাদের মতো একজন এলিয়েন।
গল্পের ভাঁজে-ভাঁজে বিস্ময়ের যে ঢেউ আছে তা বেশ রোমাঞ্চকর। লেখিকা নিজস্ব লেখনির বুননে গল্পটিকে চূড়ান্ত মুহুর্তে নিয়ে থমকে দিয়েছেন। গল্পের সর্বশেষে দেখা যায় ভাইরাস যজ্ঞে পৃথিবীর নষ্ট মানুষের বিদায় ও ভালো মানুষের জয় হয়।
গল্পগ্রন্থের তৃতীয় এবং সর্বশেষ গল্পটি হলো “একটি চেনা গল্প”। প্রেম-ওমের গল্প হলেও এর পরিনয় বিশাল বিরহের এক আকাশসম। অনেকটা শেষ হয়েও না শেষ হবার মতো। দুটো মূল চরিত্রই গল্পের শেষ রেশটুকু মায়াবিক ভাবে টেনে নিয়ে গেছে।
মৌমিতা নামের সরল এক বালিকার জীবনফরিঙের কথাকল্প দিয়ে শুরু হয়েছে গল্পটি। দাম্পত্য জীবনের সব কিছুতে মানিয়ে নেয়া এক মানুষের চরিত্রই মৌমিতা। জীবনের প্রারম্ভ থেকেই একটা অদৃশ্য যন্ত্রণার দৃশ্যকল্প চিত্রায়িত করেছেন লেখিকা। পিতৃহীন পরিবারে মামার সংসারে বড় হওয়া মেয়েটির মায়ের পছন্দের বরকে নিয়ে সংসার জীবন শুরু করে। এভাবেই একদিন পার্টিতে দেখা হয়ে যায় পূর্ব পরিচিত বড় ভাইয়ের বন্ধু রুপমের সাথে। বিস্ময়ের তরঙ্গ এই যে, তাকে একদিন সে ভালোবাসতো।
গল্পের পরবর্তী দৃশ্যপট ভাবনার পাখা মেলতে শুরু করে দেয়। যেখানে মৌমিতার প্রথম না বলা প্রেম রুপম ভাইকে নিয়ে হারিয়ে যাওয়া নানাবিধ কথামালা ও দৃশ্যকল্পের অবতারণা নদীর মতো ডাল-পালা মেলে দিয়েছে। লেখিকা আবছায়া ভাবে একটা চরিত্র নির্মাণ করেছেন মৌমিতার স্বামী রফিক কে নিয়ে। যার শুধু টাকার নেশা। সে নেশায় যোগান দিতে মৌমিতাও চাকরীতে যুক্ত। একদিন অফিসের কাজে ডুবে থাকার আঁধারে আলোর ঝলকানি হয়ে আসে রুপমের ফোন। শুরু হয় আবার পুরোনো রথের চাকায় ভালোবাসার হোলি খেলা। যদিও বিয়ের পর অন্য পুরুষের প্রেম পরকীয়া বলেই সমাজে প্রচলিত লেখিকা সেই সূত্রটা ফেলে দিতে পারেননি তথাকথিত ভাবে তাই বন্ধুত্বের সূত্র নিয়ে চলে দুজনার পথচলা।
লেখিকা গল্পবয়ানে এমন কিছু কথার ছল ও শব্দমন্ত্রের ব্যবহার করেছেন যে কারনে অতি সরল দৃশ্যকথনটি একটি অসাধারণ নদীর মতো আপন ছন্দে চলেছে। লেখনীর একটা স্বকীয়তা এভাবেই ফুটে উঠেছে গল্পমাঠে। তেমনি এক উদাহারণ, ষষ্ঠ পরিচ্ছদে এক জায়গায় লেখিকা লিখেছেন- “প্রতিটা মেয়েকে ধারালো ছবির মতো ক্ষমতা দিয়ে পৃথিবীতে পাঠায় প্রকৃতি, মেয়েরা সেটা বুঝতে পারেনা কারন সমাজ, পুরুষ বা ধর্ম সেটা বুঝতে দেয় না।”
পরিশেষে একদিন মৌমিতা জানতে পারে রুপমের সাথে অনেক মেয়ের সম্পর্ক আছে এবং অনেকের মতো তাকে নিয়েও ভালোবাসার খেলা খেলেছে। তবে সত্যিটা সেটা নয়, রুপমের ইচ্ছেতেই হয়েছিলো। যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতেই কারো কারো ভালো লাগে রুপম তাদের পথেই হেটে চলেছিলো।
প্রেম-অপ্রেম-ভালোবাসা-আশা-ভাষাহীন এই গল্পটির শেষ পরিনতি হয় ইচ্ছাকৃত ভুল দিয়ে। হয়তো এর সমাপ্তি ব্যতিক্রম ভাবনার দাবি রাখে তবুও সনাতন সমাপ্তির চেয়ে একটু ভিন্নতাই লিখেছেন লেখিকা যে কারনে গল্পটা গল্পের মাঝে থেকে গেছে।
___________________
No comments:
Post a Comment