বিপ্লব, বিক্ষোভ, বিদ্রোহ আর চে’একটি আদর্শ ছবি। যে কোন শিল্পী বা স্থপতির কাছে চমৎকার ভাস্কর্য হয়ে উঠতে পারে এই চিত্র কর্মটি। কিন্তু এই ছবি ছাড়াও চে’র অন্য একটি ছবিও আছে। আকণ্ঠ কবিতা নিমগ্ন চে। পাবলো নেরুদার কবিতা ছিল তার খুব প্রিয়। চে’কে হত্যার সময় তার কাছে নেরুদার কবিতার বই পাওয়া গেছে। কবিতা ছিল চে’র খুব প্রিয় বিষয়। কবিতা ছিল চে’র অন্যরকম এল প্রেমিকা। কবিতা চে’কে দিয়েছে বিপ্লবের পথে অমরত্বের শক্তি।
যুদ্ধ সংকুল অস্থির সময়ের সামান্য অবসরে ‘চে’ কবিতা পড়ত। কিম্বা প্রাণের বন্ধু ফিদেলের জন্যে লিখে যেত উদ্দীপনার গান। তাতে থাকত মানুষের জন্যে এক আশ্চর্য সবুজ ভালবাসা। দ্বিতীয় স্ত্রী আল্যাইদার জন্যেও চে’ কবিতা লিখেছে। সেই কবিতার ছত্রে ছত্রে রয়েছে জীবন জয়ের গান।
কবিতা লেখার সময় চে’র মুখ থেকে বিপ্লব, বিক্ষোভ আর বিদ্রোহ মুছে গিয়ে হয়ত ফুটে উঠেছে আশ্চর্য নরম কোমল কোন আলো। সে আলোয় এই বুড়ি পৃথিবীর জন্যে ঝরে পড়েছে অফুরন্ত মায়াবী ভালোবাসা। বিপ্লবের সাথে প্রেম আর কবিতা মিলেমিশে ‘চে’ হয়ে উঠেছে এক অশান্ত আগুনপাখি। পাখায়-পাখায় বিপ্লবের আগুন নিয়ে উড়ে গেছে কিউবা থেকে আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া সমগ্র ল্যাটিন আমেরিকা। চে’র মৃত্যুর পরে লক্ষ লক্ষ তরুণদের সমাবেশে ক্যাস্ট্রো তাই বলেছিলেন আমরা ভবিষ্যতের মানুষদের চে’র মত করে দেখতে চাই। আবেগী, দরদী ভালবাসা প্রীতিতে ভরপুর। সাম্রাজ্যবাদী শোষকের বিরুদ্ধে অবিচল সংগ্রামে চির উন্নত শির।
কেউ কি কবরের গান শুনতে পায়? চে’র গান? পৃথিবীর বাতাসে ভাসছে তার বিপ্লবীর গান। আহত ক্ষোভ, প্রতিবাদ, জাগরণ আর মানবতার জয়গান গেয়ে চলেছে চে। সে গানের অন্তে থাকে অসমাপ্ত বিপ্লবের জন্যে হাহাকার আর আকুতি। থাকে মানুষের জন্য মানবতার পথে আসার আহবান। অসমাপ্ত বিপ্লবকে সম্পূর্ণ করার জাগ্রত চেতনার জয়ধ্বনি। এই গান কত প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে গেছে। পৃথিবীর সব গোলার্ধে এখনে সসম্মানে বেঁচে আছে ‘চে’। তার স্মৃতির কোন ক্ষয় নেই লয় নেই। পৃথিবীর বয়েস যত বেড়ে যাচ্ছে চে’র গান ততবেশি ছড়িয়ে পড়ছে কবর থেকে কারখানায়, ফসলের মাঠ থেকে ছাত্রদের কণ্ঠে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। আফ্রিকা থেকে বাংলাদেশ ছুঁয়ে সাম্রাজ্যবাদের ঘাঁটি মার্কিন মুলুকে। হয়ত একদিন অবরুদ্ধ আফগানিস্তান থেকে সিরিয়া মিশর লিবিয়া হয়ে আরব ভূমিতে। যে গাইছে তাকেও চিনে নিচ্ছে এই পৃথিবীর নতুন মানুষেরা। তাই বাংলাদেশের কিশোর কিশোরী তরুণ যুবা প্রৌঢ় বৃদ্ধদের মত অন্য দেশের কিশোর কিশোরী যুবা তরুন প্রৌঢ় বৃদ্ধদের কাছে চে’ এক আলোকস্তম্ভ। চে’র টুপি থাকে মাথায়, চে’র গেঞ্জি ঢাকা বুক আর কাঁধে থাকে চে’র দৃপ্ত মুখের ছবি। মানুষকে ভালবেসে জীবন দিয়েছে যে চে’।
বিপ্লবের মানসপুত্র আর্নেস্ত চে গুয়েভারা জন্মেছিলেন আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সের উত্তর-পূর্বে রোসারি গ্রামে ১৯২৮ সালের ১৪ জুন। চে’র বাবা মা দুজনেই যাপিত জীবনে নিত্য আচরন এবং মননে ছিলেন প্রগতিপন্থী। প্রচলিত সামাজিক প্রথার সব কিছুই তারা অন্ধভাবে বিশ্বাস করতে হবে এই ধারণার অন্ধ বিশ্বাসী ছিলেন না। তারা তাদের সন্তানদের স্বাধীন মুক্তমনা করে গড়ে তোলার জন্য উদার পারিবারিক পরিবেশ গড়ে তোলেন। হাই ইশকুল পাশ করে ডাক্তারি পড়ার সময় চে জড়িয়ে পড়ে রাজনীতিতে । যে সে রাজনীতি নয় । মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সাম্যবাদী রাজনীতিতে নিজেকে সঁপে দেয় । সাচ্চা কম্যুনিস্ট ছিলেন চে’। সমস্ত ভয় ভাবনা বাঁধা মায়া এমনকি অর্জিত ক্ষমতাকে আঙ্গুলের তুড়িতে উড়িয়ে দিয়ে বিপ্লবের পথে মৃত্যুকে উপেক্ষা করেছিল চে গুয়েভারা।
মৃত্যুর পরেও পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের মন ও মস্তিষ্কের পর্দা জুড়ে সাদাকালো একটি সত্য ঘটনা লাল হয়ে জেগে থাকে। বলিভিয়ার জঙ্গলাকীর্ণ ইশকুল ঘর, আহত ও বন্দী চে গুয়েভারা। তাকে হত্যা করতে অসাহসী ভীরু তোষামোদে ভাড়াটে বলিভিয়ান সেনাদের সদরদপ্তর। তারা মার্কিন মুলুকের কাছে সাহস ভিক্ষা চেয়ে পাঠায়। নড়ে উঠে পুঁজিবাদের লেজ। চে’কে খুন করার এমন মোক্ষম সুযোগ কিছুতেই হাত ছাড়া করে না মার্কিন প্রশাসন। দুপুর একটা দশ, অক্টোবর ৯, ১৯৬৭। নির্জন জঙ্গলের নৈঃশব্দ কে খান খান করে শোনা যায় তিনটি গুলির শব্দ। চে’সহ তার দুই সহযোগীকে হত্যা করে সাম্রাজ্যবাদের দোসর বলিভিয়ান সৈন্যরা। পৃথিবী থেকে মুছে দিতে তারপর সেখানেই তারা কবর দেয় চে’ এবং তার সঙ্গীদের। কবর দেওয়ার আগে চে’র দুটি হাত কবজি থেকে বিচ্ছিন্ন করে কেটে নেয় সৈনিকরা। পৃথিবী থেকে ‘চে’কে মুছে ফেলতে চাইলেও তারা পারেনি। বেঁচে থাকতেও বিপ্লবের অমৃত পুত্র‘চে’কখনো একা ছিল না। অন্তিম সময়েও প্রিয় কমরেডদের সাথে নিয়েই তিনি মৃত্যু বরণ করে। উদ্যত রাইফেলের সামনে মৃত্যু সুনিশ্চিত জেনে ‘চে’ হেসেছিল সেই ভুবনজয়ী নির্মল হাসি। পৃথিবীর মানুষের প্রতি অনির্বাণ আস্থা রেখে তার হাসি যেন বলেছিল, মৃত্যু আমার দেহকে স্তব্দ করে দেবে সত্যি কিন্তু এই বিশ্বের যেখানে যখনই কোন অন্যায়ের প্রতিরোধ গড়ে উঠবে সেখানে অন্যায়ের মুখে ঝামা ঘষে দিতে বারবার হাজারবার লক্ষ কোটিবার জীবন্ত হয়ে উঠব আমি, আর্নেস্ত চে’ গুয়েভারা, বিপ্লবের পরিযায়ী পাখি।
অশান্ত বাংলাদেশের বিষণ্ণ বিকেলে আমি চে র কবিতা শুনতে পাই। স্পর্ধিত সাহসে ম্যাড়মেড়ে স্বপ্নহীন হেমন্তের বিকেলে অনিরাপত্তার ডুবোজালে বাঙ্গালী যখন পথ খুঁজছে অন্তরের গভীরে তখন বেজে উঠে চে’র কবিতা। মৃতেরা কফিনবন্দী হয়ে চলে যায় মাটির দেশে। যারা বেঁচে থাকে তাদের কেউ সাহসের গল্প বলে না। জানায় না মানুষকে ভালবেসে যীশুর মত অনেকেই জীবন দিয়েছে। এই বীরেরা আসলে কেউ মরেনি। তাদের আত্মা প্রতি মূহূর্তে ডেকে যাচ্ছে, জাগো মানুষ। কেবল আমাদের অন্ধ বদ্ধ ভীরুতার জন্যে তাদের আমরা দেখতে পাচ্ছি না, শুনতে পাচ্ছি না। অথচ প্রতিদিন সাহসী মানুষের আত্মারা ডেকে যাচ্ছে , বলে যাচ্ছে , জেগে উঠো। অনেকেই শুনতে পায়, বলিভিয়ার মাটির গভীর থেকে চে’গেয়ে যাচ্ছে বিপ্লবের গান, মানুষকে ভালবাসার জয়গান।
No comments:
Post a Comment