কয়েকদিন থেকে প্রীতম কারো
সাথেই যোগাযোগ রাখছে না। তার বন্ধুবান্ধবরা প্রীতমকে না পেয়ে কেমন যেন একটা শূন্যতার
মাঝে আছে। মৌ বুঝে উঠতে পারে না প্রীতমের নিরুদ্দেশের বিষয়টা। কলেজে আসছে না কয়েকদিন,
ফোনেও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। ফোনটা বন্ধ রাখার কারণ কী হতে পারে! মৌ ভেবে পায় না। মৌ বেশ কদিন থেকেই প্রীতমের উড়নচণ্ডী ভাব লক্ষ করে চিন্তায় আছে। সে ভাবে, প্রীতম কি তার
জীবন থেকে হারিয়ে যাবে? কিন্তু সে তার নিজের মনের প্রশ্নের জবাব খুঁজে পায় না।
মৌ এর মনে একটা সন্দেহের কালো মেঘ ধাওয়া করে
ফিরছে। ভ্যালেনটাইন ডে’র বিকেলের কথা মনে পড়লে তার মনটা উদাসী হয়ে উঠে। ওই দিনের অনুষ্ঠানের
আয়োজনে তোড়জোড় কয়েকদিন আগ থেকেই চলছিল। অনুষ্ঠানটা কলেজ অডিটোরিয়ামে করার প্রস্তাব
দিয়েছিল প্রীতম, আর অন্যদিকে কলেজের ছাত্র সংসদের সহ সভাপতি মামুনের ইচ্ছে কলেজের মাঠে
প্যান্ডেল তৈরি করে অনুষ্ঠান করার। ঢাকা শহরের নাম করা ডেকোরেটরের দিয়ে তাদের ফরমায়েশ
অনুযায়ী ভালবাসা দিবসের অনুষ্ঠানের জন্য কলেজ মাঠে প্যান্ডেল তৈরির কথা মামুন ব্যক্ত
করলে প্রীতম বলল,‘ এতে আমার সায় নেই। খোলামাঠে লোক সামলানো দায় হয়ে যাবে।
প্রীতম ছাত্র সংসদের কালচারাল সেক্রেটারি
হলেও তার কথায় কোন ঘাস জল খায় না। তার প্রস্তার কেউই সমর্থন করে না। নামেমাত্রই সে
কালচার সেক্রেটারি, এ কথা ভেবে প্রীতম কষ্ট পায়। তার ইচ্ছে হয় না কালচারাল অনুষ্ঠানে
যোগদান করতে, কিন্তু সে কালচারাল সেক্রেটারি তাই অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকা সম্ভব না। তার ঘনিষ্ঠ ছেলেমেয়েরা কেন তাকে পাত্তা দেয় না প্রীতম ভেবে পায় না।
প্রীতম এ কলেজে পড়ছে ইন্টারে দু’বছর, আর অনার্সে
প্রায় দেড় বছর। আরো দেড় বছর পর সে এ কলেজ ছেড়ে যাবে, এটাই তার মনের ইচ্ছে। কলেজের অনুষ্ঠানের
পর থেকেই প্রীতমের মনে উথালিপাথালি শুরু। সে ভাবে, অনেক কিছুই গোপন করে রাখা যায় না।
এস.এস.সিতে ভাল রেজাল্ট করে ঢাকার নামডাকওয়ালা কলেজে ভর্তি হয়ে প্রীতম নিজেকে বেশি
মাত্রায় দামী ভাবতে শুরু করে। বয়:সন্ধিক্ষণ পেরোনো এক তরুণের পক্ষে এমনটা ভাবা অযৌতুক
নয়।
প্রীতমের মত সুদর্শন মেধাবী ছাত্রের প্রতি
যে কোন মেয়ের আকর্ষণ থাকাটাও ছিল স্বাভাবিক। সাধারণ ঘরের ছেলে প্রীতম মফস্বল শহরের
একটা অখ্যাত স্কুল থেকে সেকেন্ড স্ট্যান্ড করায় সবাই তাকে উচ্চ প্রশংসা করতে পিছিয়ে
থাকেনি। খবরের কাগজে তার রেজাল্টের প্রকাশ পাওয়ায় কলেজের প্রায় সবাই তাকে চেনে। ঢাকাতে
ভর্তি হওয়ার আগে প্রীতমের মনে ঘোরপ্যাচ তেমনটা ছিল না। সে বয়েজ স্কুলের ছাত্র হওয়ায়
স্কুল জীবনে মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ ছিল না প্রীতমের। কলেজের ভ্যালেনটাইন ডে’
পালনের পর থেকে প্রীতম নিজেকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করে। সে নিজেকে গুটিয়ে নিতে পেছনে
ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনের কোণে ফিরিয়ে এনে আত্ম সমীক্ষা করতে থাকে প্রীতম। প্রীতম
ভাবে, এক জীবনে একজনকেই ভালবাসা যায়। অথচ সে তা করতে পারেনি। সে একজনের বেশি মেয়েকে
ভালবাসার চেষ্টা করেছে।
প্রথম দর্শনে প্রীতম যাকে ভালবেসেছিল তার
নাম মৌ। মৌ তার সহপাঠী। প্রথম দিন থেকেই মৌকে তার ভাল লাগে। মৌ এর সঙ্গে প্রথম আলাপের
দিনটির কথা আজও প্রীতমের মানস পটে ভেসে উঠে। মফস্বল থেকে আসা প্রীতম সে সময় বেশটাই
লাজুক প্রকৃতির ছিল।, তা না হলে সে মৌ’র সঙ্গে প্রথম আলাপে লাজুক ভাব দেখাতো না।
ক্লাস শেষ হওয়ার পর প্রীতম ধীর পায়ে কমনরুমের
দিকে যাচ্ছিল। আর কয়ে পা এগোলে বকুল গাছ ছাড়িয়ে সে কমনরুমে পৌঁঁছে যাবে। ছেলেদের কমনরুম
থেকে মেয়েদের কমনরুমের দূরত্ব বেশি নয়। তবে মাঝ খানে সারি দেওয়া তিনটে বকুলফুলের গাছ।
গাছ তিনটে তখনো মাথা ঝাড়া দিয়ে ওপরের দিকে ওঠেনি। ঘন ডালপালা মেলা সবুজ পাতাগুলো এমন
ঝাকড়া , তা যেন দুই কমনরুমের মাঝে একটা প্রাচীর
তৈরি করে রেখেছে। তাদের কমনরুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে মেয়েদের কমনরুমের দিকে তাকিয়ে থাকতে
দেখে প্রীতম অনেককেই। প্রীতম ভাবে , মেয়েদের কমনরুমের দিকে তাকিয়ে থাকার কোন অর্থ হয়
না। কোন মেয়ের সঙ্গে ভাব করতে হলে ওদের কাছে
গেলেই হয়।
সেদিন কমনরুমে পৌঁছার আগে পেছন ফিরে মৌকে
দেখতে প্রীতম থমকে দাঁড়ায়।তাদের ক্লাসের মেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী, তার সহপাঠীরা
বলাবলি করে। সে নিজেও এটাই ভাবে। প্রীতম একান্তে ভেবে দেখেছে মৌ’র মুখের গড়ন আর আটেসাটো
দেহের গড়ন আর পাঁচটা মেয়ের চেয়ে আলাদা। একদিন মৌ নামের সুন্দরী মেয়েটির সঙ্গে আলাপ
জমাতে হবে , তা প্রীতম কখনো কল্পনাও করেনি।
অল্প দিনের মধ্যে প্রীতমের ভাব জমে ওঠে। সে
লক্ষ করে কথা বলার সময় মৌ’র বা’গালে টোল পড়ে। প্রীতমের ইচ্ছে হয় মৌ নিভৃতে অনর্গল তার
সঙ্গে কথা বলে চলুক। সে তার হাস্যোজ্জ্বল টোল পড়া মুখের কথামালায় বিমোহিত হয়।
প্রীতমের সঙ্গে মৌ’র প্রেম ভালবাসায় জড়িয়ে
পড়ার খবর জানতে বাকী থাকে না তাদের ক্লাসের কারোই।প্রীতমের সহপাঠীদের মধ্যে হাতে গোণা
কয়েকজন বাদে সবাই প্রীতম ও মৌ’র প্রেম ভালবাসা নিয়ে মাথা ঘামায় না বলে মনে হয় প্রীতমের।
তবে ক্লাসের তিনটে ছেলে এ নিয়ে প্রায় প্রায়
ফিসফিস করে। তার মনে হয় নিলয়, সুজান ও বিতান প্রীতমকে সহ্য করতে পারে না। তিন জনই ঢাকার
অভিজাত এলাকার ছেলে। মৌ’র বাসাও ঢাকার অভিজাত এলাকায়। সুজানের এক কথা,‘ মৌ’র সঙ্গে
প্রেম করার অধিকার প্রীতমকে কে দিয়েছে!’
নিলয় সুজানকে রাগানোর জন্য বলে,‘ গ্রামের ছেলে প্রীতম তোকে টেক্কা-’ নিলয়ের
কথা থামিয়ে দিয়ে রাগত সুরে সুজান বলে , প্রীতম আমাকে ঢেক্কা দেওয়ার সাহস রাখে?’
‘তাতো দেখতেই পাচ্ছি!’ বিতান বলে উঠে। সুজান,
তুই অযর্থাই মৌকে নিয়ে স্বপ্নজাল বুনেছিস। পাখি নীড় ছেড়ে অন্য নীড়ে বাসা বাঁধছে , তা টের পাসনি।’ বিতানের
কথা শুনে সুজান রেগে গিয়ে বলে উঠে,‘ আমি কোন দিনই কোন মেয়ের পেছন পেছন ঘুর ঘুর করি
না। তুই কিন্তু ওইটাই করে থাকিস্।’
নিলয়
সুদর্শন, মেধাবী ও সভ্যভব্য ছেলে। ধনী পিতা মাতার একমাত্র সন্তান সে। তার বাবা মা চায়
তাদের ছেলে যেন সোজা পথে চলে মানুষের মত মানুষ হোক। নিলয়ের মা মিসেস চৌধুরী তাদের ছেলে
নিলয় যেন সুজান, প্রীতম ও বিতানদের সঙ্গে না মেলামেশা না করে। ওরা জানে নিলয়ে মা তাকে
তাদের সঙ্গে মিশতে দিতে চায় না। সেদিন নিলয় সুজানের কথায় সায় না দেওয়ায় নিলয়ে প্রতি
সুজানের রাগ হয়। সুজান কর্কশ কন্ঠে বলে উঠে,‘ আমাকেই তাহলে তীরন্দাজের ভূমিকায় নামতে
হবে। পাখিটাকে আমার খাঁচায় পুরতেই হবে, কী বলিস, বিতান?’ বিতান সুজানের কথায় সায় দেয়।
এদিকে, মৌ’র বাবা মা প্রীতমকে পাড়ার এক অনুষ্ঠানে গান গাইতে
দেখেছিল। মিসেস চৌধুরী প্রীতমের গলায় তার প্রিয় রবীন্দ্র সঙ্গীতগুলো শুনে ছেলেটির প্রতি
মুগ্ধ হয়। সে প্রীতমকে কাছে ডেকে বলে, ‘ তোমার গানের গলা তো সুরেলা। তবে তোমাকে আরো
তালিম নিতে হবে।’ মৌ তার মায়ের পাশের দাঁড়িয়ে ছিল। সে প্রীতমকে মায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে
দিয়ে বলে, ‘ ও তো আমাদের সঙ্গেই পড়ে।’ মৌ’র মা প্রীতমকে তাদের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়ে
বলে, ‘ আমাদের মৌও রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখে আমার কাছেই। মৌ রবীন্দ্র সঙ্গীত ভালই গায়, তবে
আমি আজও ওকে কোন স্টেজে গান গাইতে দেইনি।’ সেই থেকেই প্রীতমের যাওয়া আসা শুরু হয় মৌদের
বাড়িতে। প্রীতম কোনদিনই ভাবেনি মৌ’র মায়ের কাছে গান শেখার সুযোগ পাবে।
প্রীতম মৌ’র বাড়িতে গান শিখতে যাওয়ার জানাজানি
হতে দেরি হয় না। এ খবরে সুজান মনে মনে প্রীতমের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠে। সে ভাবে
, গ্রামের ছেলে প্রীতম মৌ’র সান্নিধ্যে আসবে তা কোন মতেই মেনে নেওয়া যায় না।
সুজান মনে মনে ফন্দি আঁটে। সে ঠিক করে প্রীতমের
সঙ্গে বিবাদ করে মৌদের বাড়িতে প্রীতমের যাওয়া বন্ধ করা যাবে না। মৌ’র বাবা শহরের গন্যিমান্যি
লোক, ক্ষমতাও আছে যথেষ্ট। মৌদের বাড়িতে প্রীতমকে না যাওয়ার কথা বললে হিতেবিপরীত হতে
পারে। শেষমেশ মৌ’র বাবা মি.চৌধুরী তাকে এমন পেদানি খাওয়াবে যাতে নিজের বাপের নামটা
ভুলে যেতে হতে পারে। কৌশলে প্রীতমকে মৌদের ওখান থেকে সরিয়ে আনতে হবে।
সুজান তার ভাবনাকে কাজে পরিণত করার জন্য প্রীতমের
সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে দেয়। সে ঠিক করে প্রীতমকে মৌ’র সান্নিধ্য থেকে সরিয়ে আনার জন্য
নিজের দুই বোনকে কাজে লাগাবে। গ্রামের ছেলে প্রীতমকে তার নিজের বোনরাই বসে আনতে পারবে।
নীল রঙের কাচপোকা যেমন তেলাপোকাকে সম্মোহনের সাহায্যে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে যায় ঠিক
তেমনি ভাবেই তার ছোট বোন দিবা প্রীতমকে বসে আনতে পারবে। সুজান ভাবে। সুজানরা পিঠেপিঠে
দু’বোন আর এক ভাই। দুই আড়াই বছরের বড় বোন ফারা এবার অনার্স শেষ করবে। আর সুজানের চেয়ে
এক বছরের বড় ছোট দিবা এবার অনার্সে ভর্তি হয়েছে। সুজান ভাবে, বড় আপু ফারা চাপা স্¦ভাবের।
ভাল রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়। ইতিমধ্যে টেলিভিশনেও গান গাওয়ার সুযোগ ঘটেছে। তাদের উপরের
ফ্লাটের স্কুলে পড়া দুটো মেয়েকে সে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখায়। বড় আপা কখনোই প্রীতমকে গান
শেখাতে রাজি হবে না। ছোট বোন দিবাকে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে দেখে সুজানের চিন্তায় ছেদ
পড়ে।
বড় আপু ফারার গায়ের রঙ চাপা, কিন্তু ছোট বোন
দিবা গায়ের রঙটা দুধে আলতায় মেশানো। দেহের গড়ন, চোখের চাহনি,চলনবলনে সে মৌ’র চেয়ে কোন
অংশে কম নয়। মৌ আর তার ছোট বোন দিবাকে এক জায়গায়
দাঁড় করালে লোকে ভাববে ওরা দুইবোন। সুজান মৌকে আন্ডার এস্টিমেট করতে চায় না। কথা বলার
সময় মৌয়ের গালে টোল পড়াটাকে সুজান খুবই উপভোগ করে। সুজান কোন মতেই মেনে নিতে পাওে না
মৌ প্রীতমের প্রেমে পড়ুক। মৌকে আমার চাইই চাই।
একমাত্র তার ছোটবোন দিবাই পারে প্রীতমকে মৌ’র
কাছ থেকে দূরে সরিয়ে আনতে। সুজান একদিন ছোটবোন দিবা’র সঙ্গে বাজি ধরে বসে। তারা ভাইবোন
। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা প্রেম ভালবাসা সম্পর্কে খোলামেলা আলাপ আলোচনা করতে দ্বিধা
কিংবা লজ্জাবোধ করে না। সুজানের ছেটবোন দিবা জানে তার ভাই সুজান একতরফা ভাবে মৌ’র প্রেমে
দেওয়ানা। ‘মৌকে তোর কোর্টে এনে দিতে পারলে ভাইয়া তুই আমাকে কী প্রেজেন্ট করবি, প্রেমিজ
করে বলতো দেখি।’ দীবা সুজানকে বলে। সুজান অতশত না ভেবে বলে ওঠে, ‘ তোকে দুটো প্রেজেন্টেশন
দেবো, কিন্তু তা আমি তোকে আগেভাগে বলবো না। তুই কিন্তু ভুলেও জিজ্ঞাসা করবিনে। কাজ
হাসিলের পর দেখবি প্রেজেন্টেশন আপসে আপ তোর
কাছে পৌঁছে গেছে।’
দিবা তার ভাইয়ের কথা শুনে খিলখিল করে হেসে
ওঠে। কথায় কথায় খিলখিল করে হাসা ওর স্বভাব। ওর মুখে সব সময়ই হাসি লেগে থাকে। মা বলে,
ওটা নাকি দাদি’র কাছ থেকে পেয়েছে।
‘তুই ভাবিস না ভাইয়া , আমি সব ম্যানেজ করে
দেব, তুই তোর বন্ধুটিকে নিয়ে আয় তো দেখি।’ দিবা মিষ্টি হেসে সুজানকে বলে।
কয়েকদিন পর এক সন্ধ্যায় সত্যি সত্যি প্রীতম
সুজানদের বাড়িতে হাজির হয় একাই। সুজানের সঙ্গে ওর আসবার কথা ছিল। এদিকে হাঁটতে হাঁটতে সে ভবলো, সুজান হয়তো বাড়িতেই
আছে। ফোনটোন না করেই সুজানের বাড়িতে হাজির হলে ওকে সারপ্রাইজ দেওয়া হবে।
আসলে সে সময় সুজান বাড়িতে ছিল না। শুধুমাত্র
ছিল বাসায় একা দিবা। সুজানের আপা ও মা নিউমার্কেটে সপিং এ। মি. চৌধুরী তখনো অফিস থেকে
ফেরেননি। দিবা নিরালা গানের রেওয়াজ করছিল। ডোরবেল বেজে উঠলে সে ভাবল, আপরা হয়তো ফিরে
এসেছে। সে দরজার আইহোল দিয়ে বাইরে না তাকিয়েই দরজা খুলে এক অপরিচিত সুদর্শন তরুণকে
দেখতে পেয়ে তার চোখের দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকাল। আগন্তুকের কন্ঠ ভেসে এল, ‘ নাইস টু
মিট ইউ, পারহ্যাবস, ইউ আর দিবা, ইয়োঙ্গার সিস্টার অফ সুজান, অ্যাম আই রাইট?’ দিবাকে
জবাব দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে আগন্তুক এক নাগাড়ে কথা বলে চলার এক ফাঁকে দিবা বলল,‘ ওয়েল
কাম টু ইউ।’ দিবা এর মাঝেই বুঝতে পেরেছে এ ভাইয়ার বন্ধু প্রীতম না হয়েই পারে না।
প্রীতম ভেতরে গিয়ে সোফায় বসে ধীওে সুস্থে
তার পরিচয় দিল। সুজান বাড়িতে নেই শুনে সে উঠতে যাচ্ছিল।‘ আপনার তাড়া আছে নাকি। তাড়া
না থাকলে বসুন, ভাইয়া নেই তাতে কী, আমি তো আছি! এর মাঝে ভাইয়া এসে পড়বে।’ দিবা’র কথা
শুনে প্রীতম আমতাআমতা করে বলল, ‘আপনাকে ডিসটার্ব করলাম। বাইরে থেকে গান-’
‘ হ্যাঁ, আমিই গাইছিলাম। মাঝে মাঝে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রাকটিশ করি।’ প্রীতমকে
জবাব দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে দিবা বলে উঠল,‘ আপনিও তো রবীন্দ্রসঙ্গীত গান, তাই না?’
‘তা আবার কোথা থেকে শুনলেন। নিশ্চয়ই সুজান
বলেছে? সুজান আমার গানের কথা’
দিবা প্রীতম প্রীতমকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘আপনার
গানের কথা কেউ জানুক এটা কি আপনি চান না?’ ‘তা নয়,
তা নয়।’ প্রীতম আমতা আমতা করে বলল। তবে আমি
চাই না আমাকে নিয়ে কেউ ব্যস্ত হোক।’ একটু পরেই মা ও ফারা আপা বাসায় ফিরল। ফারাদের কলেজের একটা অনুষ্ঠানে প্রীতমকে
রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে দেখেছিল। তাই ফারা আপা প্রীতমকে চিনতে পারে।
ওইদিন থেকেই দিবাদের বাড়িতে প্রীতমের আসা
যাওয়া শুরু। মৌদের বাড়িতে আজ পর্যন্ত যাওয়া
সুযোগ ঘটেনি তার। মৌ তাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে সাহস দেখায়নি। আগে একটু একটু সংকোচ বোধ করলেও এখন আর দিবাদের বাড়িতে যেতে সংকোচ
বোধ করে না, তা প্রীতম নিজেই বুঝতে পারে। সে কখন থেকে যে দিবাকে ভালবাসতে শুরু করেছে
তা হিসাব কওে পায় না।
প্রীতম এক সময় ভাবে, সে কি মৌ’র কাছ থেকে
সরে আসছে। অথচ এক সময় মৌকে ছাড়া বাঁচার কথা ভাতেই পারতো না প্রীতম। প্রীতমের
মনে হল, সে দিবাকে ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারবে না।
সুজান এমনটাই চাচ্ছিল। প্রীতম ছেলে হিসাবে
ভাল। তার বোন দিবা প্রীতমের প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে এক সময় যদি ওর গলায় মালা দিতে পারে
তবে পোয়াবার। তখন মৌ তার হাতের মুঠোয় না এসে কোথায় !, সুজান মনে মনে ভাবে।
প্রীতম সত্যিই নিজেকে মৌ’র কাছ থেকে নিজেকে
গুটিয়ে নেয়। সেদিন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে দিবা ও প্রীতমের একটা প্রোগ্রাম
ছিল। প্রীতম দিবাকে বলল,‘ রাত অনেক হয়েছে, তোমাকে বাড়ির গেটে পৌঁছে দিয়ে আমি হোস্টেলে
ফিরে যাব। ’
‘কেন, তুমি আমাদের বাড়িতে যাবে না?’ ‘এত রাতে
তোমাদের বাড়িতে- ‘সে কী কথা! ঢাকা শহরে দিন আর রাত বলে কথা আছে নাকি! আমার সঙ্গে তুমি
যদি এখন আমাদের বাড়িতে না যাও তবে এখান থেকেই ফিরে যাও হোস্টেলে, আমি একাই বাড়ি ফিরে যেতে পারবো।’
দিবা কর্কশ কন্ঠে কথাগুলো বলে। প্রীতম কী করবে ভেবে না পেয়ে এক সময় দিবার মুখের দিকে
তাকায়। টিএসসি চত্বরের নিয়নবাতির ঝলমলে আলোতে প্রীতম দিবার চোখেমুখে উদ্বেগের চিহ্ন
দেখতে পায়। প্রীতম ভাবে, দিবার সামনে বৃষ্টি’র
সঙ্গে অমন করে আলাপ জমানো উচিত হয়নি। বৃষ্টি’র কাজল কালো চোখের দিকে তাকিয়ে সত্যি সত্যি
প্রীতম সে সম্মোহিত হয়ে পড়েছিল। ওর গানের গলা এতটা মিষ্টি হতে পারে সে ভাবতেও পারেনি।
আগামী পরশু বৃষ্টি’র একক একটা প্রোগ্রাম আছে
শিল্পকলা একাডেমিতে। সে প্রীতমকে হাজির থাকার জন্য পই পই করে বলেছে। ওখানে যাওয়ার জন্য
বৃষ্টি দিবাকে না বলায় প্রীতম বৃষ্টি’র অনুষ্ঠানে
যাবে না বলে ম:নস্থির করে।
পরদিন হাঁটতে হাঁটতে নিউমার্কেট পেরিয়ে নীলক্ষতের
বইপাড়ায় গিয়ে প্রীতম বৃষ্টিকে দেখতে পায়। ফুটপাতের
একটা বইয়ের দোকানে বৃষ্টিকে একটা ম্যাগাজিনের পাতা উলটাইতেছে। বৃষ্টি পেছন ফিরে প্রীতমকে
দেখতে পেয়ে তাকে বলল, ‘ আপনি এখানে একা! আপনি তো একা কখনো বের হন না!’ প্রীতম কী জবাব দেবে ভেবে পেল না।
বৃষ্টি তার চেয়ে দু’ক্লাস নিচে পড়ে। অল্পদিন
হল বৃষ্টির সঙ্গে প্রীতমের পরিচয়। বৃষ্টিা’র চেহারায় এক ধরনের মাদকতা আছে। বৃষ্টি’র
অনুরোধে সে তার সঙ্গে একটা নিরিবিলি রেস্টুরেন্টে বসে। বৃষ্টি তাকে বারবার অনুরোধ করে
পরদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার জন্য।
প্রীতমের যাওয়ার ইচ্ছে না থাকলেও বৃষ্টি’র
অনুরোধে সে শিল্পকলা একাডেমিতে যায়। বৃষ্টি’র একক সঙ্গীত প্রীতমকে বিমুগ্ধ করে। অনুষ্ঠানের শেষে বৃষ্টি প্রীতমকে
কাছে পেয়ে খুব খুশি হয়। বৃষ্টির সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে এক সময় প্রীতম তাকে আপনি থেকে
তুমি বলে ফেলে।
প্রীতমের মনটা ছন্নছাড়া ধরনের। তার মনটা এক
জায়গায় স্থির থাকে না। এখন মৌ ও দিবার কথা তার মনের কোণে ঘুণাক্ষরেও ভেসে ওঠে না। প্রীতমের বন্ধুবান্ধবদের অনেকেই তার
মনের বহুগামিতা লক্ষ করে উদ্বিগ্ন হয়।
মন্দিরা বলে, সুদীপ- তোর বন্ধু প্রীতমকে সাবধান
করে দিস, ও যেন আর কোন মেয়ের দিকে হাত না বাড়ায়।’ মন্দিরার কথা সমর্থন করে জাহানারা
বলে উঠে,‘ ঠিক বলেছিস্ মন্দিরা , আমি বলি কী আমাদের চেনাজানা সুন্দরী মেয়েদেরকে সাবধান
করে দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের । কী বলিস্ সৌরভ?’
সবাই তার কথায় একমত হয়।
দু’দিন
যেতে না যেতেই এ সব কথা প্রীতমের কানে যায়। ক্লাসের শেষে প্রীতম দেখতে পায় মন্দিরা,
সুদীপ, জাহানারা ও সৌরভদের তার পাশ কাটিয়ে চলে যেতে। সে মন্দিরাকে ডাক দেয়। কিন্তু
সে প্রীতমের দিকে ফিরেও চায় না।
প্রীতম তার রুমে এসে বিছানায় শুয়ে আকাশ পাতাল
ভাবতে থাকে। সে এতদিন ধরে তিনটি মেয়ের সান্নিধ্যে এসে যা যা করেছে ,তার দৃশ্যপট একটার
পর একটা মনে পড়তে থাকে। প্রীতম তার মনের জানালা খুলে দেয়।কয়েকটা সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে
তার অন্তরঙ্গ মুহূর্ত ----মৌ, দিবা, বৃষ্টি’র চেহারা তার মানস লোকে ভেসে উঠে। সে যেন
তাদেও কাউকেই পৃথক করে দেখতে পারে না। তিনজনের চেহারা যেন একাকার হয়ে মিশে যায়।
এক সময় তার মনে হয়, তার মন যেন উল্টাপাল্টা
হাঁটে। সে ভাবে, এতদিন তার মনের জানালা উন্মক্ত ছিল। এখন থেকে তার মন আর উল্টপাল্টা
চলবে না। সে তার মেধাকে এভাবে নষ্ট হতে দিতে পার!
No comments:
Post a Comment