রিকশাচালক ও তাঁর
দুই স্ত্রী
একবার
এক নারীকে দেখলাম সন্তান কোলে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে যাচ্ছে। খুব মায়া হলো। থামিয়ে
জানতে চাইলাম, ঘটনা কী? তিনি শোনালেন, কিন্তু কিছুই বুঝলাম না। তাই অনুরোধ করলাম,
দয়া করে কান্না থামিয়ে যদি একটু বলতেন! এবার বুঝলাম।
তাঁর
সঙ্গে গেলাম। গিয়ে দেখি, বৃষ্টি না থাকা সত্ত্বেও খাটের উপর বসে তাঁর স্বামী
দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে শিমের বিচি ভাজা খাইতেছে। প্রথম স্ত্রীর দুঃখ, তাকে ডাকা হয়
নাই। এমন আরো বহু ঘটনা ঘটেই চলেছে। প্রথম স্ত্রী তাই সমান অধিকার চান সংসারে। এই
লক্ষে তিনি ইতোমধ্যেই বহু জায়গায় গিয়েছেন, বহুজন তাঁর স্বামীকে বোঝালেও বুঝতেছে
না।
আমি
অনেক চিন্তা করে তাঁদের স্বামীকে বললাম,‘ভাই আপনার প্রথম স্ত্রী এভাবে রাস্তায়
রাস্তায় কান্দে। ব্যাপারটা খুবই বাজে। আপনি আমার একটা রিকুয়েস্ট রাখবেন?’
তিনি
খানিক চুপ থেকে মুখ খুললেন,‘বলেন শুনি। ’
‘আপনি
প্রতিদিন রিকশা চালানো শেষে বাসায় ফেরার আগে যে কোনো চাউলের আড়তের সামনে গিয়ে পনের
মিনিট করে বসবেন। প্রয়োজনে চাও খাবেন।’ বলেই আমি বিদায় নিলাম।
‘দুইডারেই
চাউলের আড়তে কামে লাগাই দিছে। চাউল টানে। ঝগড়া করার টাইম কম পায়। রাতে আপনার কথা
মতো আড়তের সামনে বইসা থাইকা একসাথে বাড়ি ফিরি।’
আমি
কোনো কথা না বলে চলে এলাম।
পরের
মাসে আবার গেলাম খোঁজ নিতে। জানতে চাইতেই রিকশাওয়ালা বললেন,‘আড়তে আমিও কাম নিছি।
চাউল মাপি। রিকশার চেয়ে পরিশ্রম কম।’
‘মাপতে
পারেন আপনি?’
‘পারমু
না ক্যান! দুই পাল্লা সমান রাখলেই হয়।’
এবার
আমি খুশি মনে ফিরলাম।এদের আর খোঁজ না নিলেও চলবে।
দেয়ালিকা
আমি
ভাবতাম, আমার একমাত্র কন্যার অন্তরঙ্গ এবং বহিরঙ্গ, অন্তর-বাহির আমি বুঝতে পারি।
এই বোঝাবুঝি তার ছোট্টটি থেকেই।
কন্যা
প্রথম যে বার আঁকতে শিখলো, একটি সাদা কাগজে মিকিমাউস দেখতে পেলাম। ওটা সে তার ঘরের
দেয়ালে পড়ার টেবিলের উপরে লাগিয়ে দিলো। আরেকটু বড় হওয়ার পর মিকিমাউসের পাশে আমি
মুগলী দেখতে পেলাম। এভাবে বয়স বাড়ে আর চরিত্রও বাড়ে। একে একে সিন্ড্রেলা, রুপাঞ্জল
এসবও দেখলাম। ষোল বছরের সময় শচীন টেন্ডুলকারকে ব্যাটিং করতে দেখলাম।
তারপর
ঊনিশে পা। এবার যথারীতি শাহরুখ খান। এমন কী সেসব ছবির এক ফাঁকে চে গুয়েভারা, জন
লেনন, বব মার্লেও তাদের নিজেদের পরিচয়ে উপস্থিত।
অনেকদিন
তার দেয়ালে নতুন কোন চরিত্র দেখি না। চিন্তায় পড়লাম! দেখি না তো, দেখি না-ই!
ভাবলাম, কন্যা ভার্সিটির পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত।
হঠাৎ
একদিন! আমাদের বাসার ড্রয়িংরুমে আমার ডাক পড়লো। কন্যা খোঁচা খোঁচা দাড়ির পাঞ্জাবী
পরা এক যুবককে দেখিয়ে আমাকে বললো, ‘বাবা, পরিচিত হও। তোমার জামাই। ’
দেয়ালে
এর ছবি কখনো দেখতে চেয়েছিলাম কি?
সাধারণের স্বরূপ
একবার
এক গ্রামে এক সাধু বাবার আগমন ঘটলো। গ্রামে ঢুকতেই যে বটগাছটা পড়ে তিনি সেটার নিচে
আসন নিলেন। এমন সময় সেখানে হাজির হলো ওই গ্রামেরই তিন সাধারণ মানুষ। সাধু বাবার
সামনে যেয়ে বসলো তারা। প্রথম জন জিজ্ঞেস করল,‘বাবা, আপনি কোত্থেকে এসেছেন?’ শুনে
সাধু বললেন,‘ওরে পাপি’, পুরো দেশটাই আমার।’ এবার দ্বিতীয়জন জানতে চাইল,‘এই বটের
নিচে কদ্দিন থাকবেন বাবা? ’ শুনে সাধু জবাব দিলেন,‘আমি এখানে আসবো, তার জন্যই তো
এই বটবৃক্ষের জন্ম। আর তুই কিনা জানতে চাস, কয়দিন থাকবো, ওরে মূর্খ।’ এবার তৃতীয়
সাধারণ জানতে চাইলো, ‘বাবা, আপনার ক্ষমতার একটা নমুনা আমাদের দেখাবেন দয়া করে।’
এবার তথাস্তু বলে ডান হাতে ইশারা করলেন আর ওমনি গাছের একটা পাতা উড়ে এসে তাঁর হাতে
পড়লো। তিনি বললেন, ‘এই যে দেখছিস পাতা আপনি চলে এলো, এটাতেই খোদিত আছে তোর
ভবিষ্যৎ। যা বলবো, দেখবি মিলে যাবে পরবর্তীকালে। এমন সাধু জীবনে আর একটাও দেখার
ভাগ্য হয়েছে তোদের? ‘এবার তিন সাধারণ ব্যক্তি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। একি! সাধু
হকচকিয়ে গেল। চোখের পলকে তিন ব্যক্তি গেঞ্জি-লুঙ্গি ছেড়ে হুবহু সাধুর চেহারা ও বেশ
নিয়েছে। এরা হাঁটা শুরু করলে সাধুও ভয়ে পিছ পিছ আসতে থাকলো।
অনেকক্ষণ
হাঁটার পর সাধু দেখলেন, বিশ-ত্রিশ কদম পর পরই একটা করে বটগাছ আর প্রতিটির নিচে
একজন করে সাধু। এভাবে চল্লিশটা গাছ। প্রথম বটগাছের নিচে যে বসে আছে সে দেখতে ঠিক
সাধু যুবক বয়সে যেমন ছিলেন তেমন।চল্লিশ সাধুর সবাই ক্ষমতা প্রদর্শন করে চলেছে।
একজনের মাথা গাছের ডালে, নিচের অংশ নিচে, আরেকজন যে গাছের নিচে বসেছে সেটির শিকড়
উপরের দিকে, পাতা নাই। এভাবে নানা রকম শক্তি। সাধু দেখছেন আর চোখ কপালে তুলছেন।
সবশেষ বটগাছের নিচে গিয়ে থামল তিন ব্যক্তি। প্রথম জন সাধুকে বলল,‘বাবা, এই সাধু যে
বেশে আছে এটি হচ্ছে আপনার মৃত্যুর কমাস আগের বেশ।’ এবার দ্বিতীয় জন বলল,‘বাবা, এরা
প্রকৃত অর্থে কেউই আপনার মতো পার্মানেন্ট সাধু নয়। সাধারণ চাষা, মজুর, দোকানী,
বদলা, কামার, কুমার, চুতার, জেলে। তবে সাধনা করে বিশেষ ক্ষমতা অর্জন করেছে সত্য।
আপনার মতো কেউ এলেই কেবল এরা আসে।’ বলতে না বলতেই এতক্ষণের সাধুরা সাধারণ স্বরূপে
ফিরলো। এবার তৃতীয়জন বলল,‘বাবা, আপনি এসে যে গাছটির নিচে বসেছিলেন সেটি খালিই
থাকে। আপনার মতো সাধুরা এলে বসে। তারপর সাধুত্ব ত্যাগ করতে চায়!’
মূল্যবোধ
জরিনার চিপস খাইবার সেই বয়স আর নাই, যে অর্থে
বাচ্চাকাচ্চা খায়। তবুও যে বাসায় কাজ করে সেই বাসার ছোট্ট শিশুটিকে চিপস খেতে
দেখলেই তার খেতে মন চায়। কিন্তু কে বোঝে তার মন!
বাসার শিশুটি মাঝেমধ্যে পয়সা নিয়ে খেলে।
খেলতে খেলতে দুই একটা পয়সা কোনো কোনো দিন খাটের নিচে হারায়, তখন সেটা নিজের মনে
করে জমায় জরিনা। এক প্যাকেট চিপস কেনার পয়সা যেদিন জমলো, হিসাব করে দেখা গেল, তার
জন্য শিশুটিকে প্রায় ছয়মাস পয়সা নিয়ে খেলতে হয়েছে। প্রতিদিন কেউ ঠকে না, তা সে
শিশু হলেও।
গত ছমাসে জরিনা যে কয়বার বাসার নিচে দোকানে
গেছে ততবারই গলির মুখের বিপরীতের ছোট চা দোকানে চিপসের দাম জিজ্ঞেস করে কথা দিয়েছে
পরে নেবে। ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে দাম জিজ্ঞেস করতে ভয় লাগে তার, শিশুটির মায়ের
ফরমায়েশি স্লিপ ছাড়া ঢুকেনি কখনো।
যেদিন সে চিপস কেনার জন্য পয়সা নিয়ে চা
দোকানে গেল দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর সেদিনই দোকানটি খুলল। গিয়ে চিপস কিনতে চেয়ে
দোকানীকে আগে পয়সা দিল। দোকানী চিপসের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে জরিনার দিকে এমনভাবে
চাইল যেন সে এর কাছে বেচবে না। জরিনা বলল, ‘দ্যান তাড়াতাড়ি।’ দোকানি দেয়। জরিনা
প্যাকেট নিয়ে দ্রুত ফেরে। দোকানী তাকে একবারও বলে না, ‘পয়সা ফেরত নাও, এই চিপসের
মেয়াদ শেষ।’
শিশুটি এরমধ্যে কথা বলতে শিখে গেছে। তারচেয়ে
বড়কথা, সে খাটের নিচে লুকায়, জরিনা তাকে খুঁজে বের করে! ফলে, এক প্যাকেট চিপস এখন
জরিনার আছে, এটাই তার জন্য যথেষ্ট, সে প্যাকেটটি ছিঁড়ে না।
সর্পগন্ধা
জেবুন্নেসার মৃত্যুর পর চাঁদ বড় হতে থাকে, সেই সঙ্গে বানের পানিও
বাড়ির ভিটার সীমার উপর দিয়ে যেতে থাকে। পানি কিংবা চাঁদে লোকের আগ্রহ নাই, তাহারা
উৎপীড়িত সর্পদংশনে, এরই মধ্যে দংশিতের সংখ্যা ২৬। পানিতে ঝাঁকে ঝাঁকে সাপের যথেষ্ট
কারণ আছে। তবে নিশ্চিত, গ্রামের কোনো মানুষের সাহস নাই বাঁশপাতা ছিঁড়ে!
তারপর পূন্নিমা গ্রামের লোকেরা গলা সমান জলে ভিজতে ভিজতে আশপাশের
পঞ্চগ্রামের ভিতরকার সবচেয়ে বড় বাঁশমুড়াটার কাছে উপনীত হল। সমবেত সকলের প্রচেষ্টায়
আধঘণ্টার মধ্যে বাঁশঝাড়কে কেন্দ্র করে,পানির ফুট দুই উপরেও কাভার করে এমন কারেন্ট
জাল পাতা হল।
এরপর প্রায় খসে পড়বে এমন পঁচে যাওয়া পাতাগুলো দেখতে দেখতে
পূর্ণিমার তরে লোকেদের সন্ধ্যা নেমে এলো। লোকেরা জলাক্রান্ত ভিটায় ফিরতেছে,তাদের
নাকে জলমগ্ন বাঁশপাতা ছোঁয়া বাতাসের গন্ধ।
জনশ্রুতি আছে, বাঁশমুড়াটি মনসার, কোনো এককালে বেহুলা লখিন্দরকে
নিয়ে ভেলায় ভাসতে ভাসতে এপথ দিয়ে পাতালপুরীতে যাওয়ার পথে ভেলার লগিটি হাত ফসকে
ছুটে যায়। আর সেখান থেকেই জন্ম এই বাঁশমুড়ার।
কথিত আছে, যে বা যাহারা বাঁশপাতা ছিঁড়বে তা সাপ হয়ে যাবে।
No comments:
Post a Comment