25 January 2017

ফারহানা সুমী




চিঠি

আজকাল আমার রুমের কথা কথা খুব মনে পড়ে।
মা, আগের মত আছে তো সব ? দেয়ালের রং কি পালটে দিয়েছো? সবুজ রঙের ওয়াল পকেট, দু'একটা ফুলের টব ছিল দরজার দু'পাশে ফেলে দিয়েছো মা?
বুক শেলফটা কি আগের জায়গায় আছে এখনো? জানালার পর্দাটা?
রাত হলে যখন তোমরা ঘুমিয়ে যেতে আমার চোখের অর্ধেক রাত সেখানেই ফুরিয়ে যেত।পাশে দু'একটা বিল্ডিংয়ের কথা আমার খুব মনে পড়ে। মাঝে রাস্তা, শুয়ে থাকা শরীরে ছাঁয়া হয়ে হেঁটে যেত রিক্সা চালক। কিছু বড় গাড়ি ওয়ালা ভদ্রমানুষ। আমি জানালার পাশে দাড়িয়ে দেখতাম রাস্তার লাইট গুলোর অসুখ।


বাবা অবশ্য দেখলে বকে যেতেন, তুমিও বকতে অনেক, সাথে সাথে জানালাটা বন্ধ করে দিতে। আমি শুয়ে শুয়ে তখন সারারাত ডিম লাইটকে চাঁদ ভেবে পুষিয়ে নিতাম চাঁদ দেখার স্বাদ, ইনডিকেটরের আগুন মতো লাল আভাকে ভাবতাম আকাশের তারার জমজ ছায়া, উপরে সিলিং ফ্যান মধ্যবিত্তের গতি ধরে ঘুরত।
দেয়ালে আমার করা কিছু প্যাস্টেল, ক্রেয়নের পেন্টিং ঝুলানো ছিল উত্তর আর পূর্ব ওয়ালটিতে ,সেগুলো কি এখনো আছে মা নাকি দিয়ে দিয়েছো কাউকে?
আশপাশে মেয়েদের দেখতাম যে সময়টা বেড়াতে যেত, ছাদে আড্ডা দিত। আমি রঙের ক্যানভাসে পুরো পৃথিবী চষে নিতাম রঙের চরিত্রের সাথে আড্ডা হত আমার; আমি বেঁচে উঠতাম কাল্পনিক অরণ্যকে চোখের সামনে ঝুলিয়ে,তুমি ভ্রুক্ষেপ করতে।
বাবারও পছন্দ ছিল না এসব,বলত - খালি সময় নষ্ট করছি, একদিন ছবি আঁকার সরঞ্জাম সব ফেলে দিয়েছিলাম, এখন আমি আর কোনো রঙ ছূঁয়ে দেখিনা, ভেতরের রঙটাও উধাও হয়ে গেছে যুক্তরাজ্যের মানচিত্রে এসে আমি সবুজকে হারিয়েছি, ইচ্ছে করলে ছবি আঁকতে পারি।
সকাল থেকে সন্ধ্যা অবসরে থাকি এখানে মাঝে মাঝে ক্যাফে থেকে ঘুরে আসি, আসিফও ফ্রি হলে নিয়ে যায়। বোস্টনে ঘুরতে নিয়ে গিয়েছিল সেবার। তারও আগে ক্যালিফোর্নিয়া, মেক্সিকো ও ঘুরিয়েছিল, ব্যস্ততারার হাস্যোজ্জল রশিকতাকে এড়িয়ে মানুষটি ভালই সময় দেয় আমায়।
আমাকে মাঝে মাঝে টেক্সাসে নিয়ে যায়, বেশ কাটে সব,সন্ধ্যা হলে লংড্রাইভে, রাতের খাবারটা অধিকাংশ সময় চারমিনাস রেস্টুরেন্টে  খাওয়া হয় আমাদের। আসাগানা, ফেগপ্লান্ট ,চিকেন, হোয়াইট বিন স্যুপ আরো কতো রকম বিদেশি খাবার। খেতে বসলে মনে পড়ে তোমার হাতের পুঁইশাক তরকারি, পাটশাক ভাজির সাথে শুকনো মরিচ ভাজা, সুটকির ভর্তা, বেগুন ভাজির আরো, ডাল, কাঁচা কলা বাবার জন্য তো রোজ রান্না করতে।এখনো কি তাই করো ?

বাবা তো ডাল ছাড়া খেতে পারেন না, মনে পড়ে- যে দিন ডাল রান্না না হত সে কি কান্ড! বাসা মাথায় তুলে নিতেন, তোমাকে বকাবকি এর সাথে, ওর সাথে, অবশ্য কিছু উসিলা পেলেই বাবা তো এমনই করতেন সবার সাথে বাক তর্ক, সকাল থেকে সেই রাত অব্দি এত খিটখিটে।
তুমিও তো সেই বাবার মতই এটা সেটা নিয়ে... রোজ এই হয়নি রে, সে হয়নি রে, রান্না করতে গেলে না হয় ভাত একটু নরমই হয়ে যেত ,তাতে কি মা একটুও কি মানিয়ে নেয়া যেত না?আমি খুব আতংকে থাকতাম যে দিন তরকারি গরম করতে গিয়ে ঝোল শুকিয়ে যেত, কি ভয়! শাসনের হাকে রবিন , নিশুও হাঁপিয়ে যেত, রবিন অনেক সময় রাত করে বাসায় ফিরত, একটু আড্ডাবাজ হলেও ভাইটা আমার খারাপ না মা।
ওকে একটু স্বাধীনতা দিও, নিশুকে বারান্দায় যেতে বারন করো না,বুঝ জ্ঞান ভাল আছে মেয়েটার,মাঝে মাঝে ওকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে ঘুরে এসো সবুজে সবুজ দেখে একটু নিঃশ্বাস নিতে শিখুক মেয়েটা , পুকুরে পা ছেড়ে বসুক, ধান ক্ষেতের সরু রাস্তায় হেঁটে পায়ের কদর বুঝুক,ঘাসের স্পর্শ পাক মাঠির কাছাকাছি পা রেখে ।বৃষ্টি দিনে বৃষ্টিতে ভিজতে তাকে নিষেধ করো না মা, আমি জানি বৃষ্টির ক্লোরিন কেমন লাগে ।
এক সময় মান্নান চাচার বাগানে তোমার অগোচরে অনেক ভিজতাম, ধরাও পরে যেতাম তুমি বকতে ,কেমন যেন সীমারেখার জীবনে এঁকে দিয়েছিলে আমার, এটা করা যাবে না সেটা করা যাবেনা, কারো সাথে আড্ডা দেয়া যাবেনা, পুকুর পাড়ে বসে পানিতে পা খেলা যাবেনা। আচ্ছা মা পুকুরটা কেমন আছে ভাল তো? পাড়ের আম গাছটার কি অনেক বয়স বেড়েছে? কত উঠেছি ঐ আম গাছের মাথায়, বেশ বড় ধরনের তবুও ওঠতে ভয় হত না, কখনো খুব একা লাগলে বা তুমি বোকলে সে একদম উপরের ডালে বসে থাকতাম আমি, কাঁদতাম দুরের আকাশে, সামনে যে গ্রামগুলো দেখা যেত ছোট ছোট কত রকম অভিমানী প্রশ্ন ছুঁড়তাম। এক সময় নেমে পুকুর পাড়ে নৌকা গাছের পাতাগুলোকে পানিতে ছেড়ে দিতাম, কিছু মাছ দেখা যেত। সকাল হলে মাছ গুলো কি এখনও আগের মত ভেসে ওঠে? নিশু কে বলো গ্রামে গেলে আবুল হোসেন স্যারের খবরটা নিয়ে আসতে,স্যারকে কতদিন দেখি না, স্যার কি জীবিত আছেন? থাকলে কি সুস্থ আছেন জানিনা মা, ওনাকে অনেক মনে পড়ে আমার। আমি হাই স্কুলে পড়ি তখন স্যারের বয়স সেই সময়েই পঞ্চাশ ছাড়িয়ে , মাঝে মাঝে মনে হয় এত বছরে স্যার বুঝি আর বেঁচে নেই.....

অদেখাতে কতজনই তো মরে যায়, দাদু মারা গেল, পাশের বাড়ির হারুন দাদার বউটাও মারা গেল, এখানে কাকের প্লাটুন মৃত্যর সংবাদে কা কা করেছিল অনেকবার,দাদু মারা যাওয়ার রাতে পর্দার আড়ালে একটা ছায়া দেখেছিলাম ব্ল্যাকআউটের অন্ধকারে ঠিক বুঝা যায়নি, সারা রাত কমব্যাট ড্রেস পরে ঘুর ঘুর করেছিল শূন্যতারা। দরোজার দুরে কেমন এক ভুতের বায়স্কোপ খেলা, এখন মাঝে মাঝে আমার এমনিতেও এমন অনুভব হয়, আগের থেকেও নির্ঘুমে সন্ত্রাসী রাতটা আরো চওড়া হয়েছে, আসিফ ঘুমতে বলে তবে খুব একটা জোর করে না, মানুষটা কোন কিছুতে জোর করে না আমায় দিব্যি আমার সব কথা মেনে নেয়, মাঝারি প্লেট আমার পছন্দ ঠিক তেমনি একটা প্লেট নিয়েছে, ব্যালকোনিতে দুটো, ফুলের জমজমাট বাহাদুরিতে কবিতা লেখা যায়,সব মিলে চাওয়ার থেকেও বেশিকিছু পেয়েছি, তোমরা তো তাই ভেবে বিয়ে দিয়েছিলে, বাড়ি, গাড়ি যদিও আসিফের বয়সটা অনেকটা বেশি, পুরুষ মানুষ তো একটু বয়স হলে কি বা আসে যায়, তবুও সবই ঠিক আছে, মানুষটার মনও ভাল,আমাকে অনেক ভালোবাসেন, তবুও কি মা, মন তো....

সব ভালোকে ইচ্ছে করতেই ভালোবাসা যায় না মনেরও তো একটা নিজস্বতা থাকে,তোমরা ভাবতে বিয়ে হলে এমনি এমনি ভালোবাসা হয়ে যায়, হ্যাঁ মা হয় কারো কারো,আবার কারো কারো কাঁঠাল পাতার খেলায় থাকতে থাকতে পাশাপাশি দুজন বড়জোর ভালোর প্রতি একটা সহানুভূতি কাজ করে ভেতরে,কিন্ত ভালোবাসা? সহানুভূতি আর ভালোবাসা তো এক জিনিস নয় মা...
ভয় পেও না মা আমি এখন পাক্কা অভিনয় করতে জানি, কেউ টেরও পায় না, ঘড়ির কাঁটায় পুতুলবউ হয়ে আছি, অভিনয়ের নির্মাণ হাসি অলীক এ চার দেয়ালে...
ভালো আছি মা বেশ ভালো, কাগজের বড় বড় অংকে শুয়ে থাকি, মধ্যবিত্ত ভাবনাগুলোকে উচ্চবিত্তের শাড়ি দিয়ে ঢেকে রাখি,দামি কার্পেটে পা পাক খায়. মাটিতে...? পা রাখিনা মা।বাংলার মাটিতে আগের মতই কি সুখ সুখ ঘ্রাণ বের হয় মাটিতে নাক ঠেকলে?কবিতার ছন্দ টের পাওয়া যায়? রবীন্দ্রনাথ, নজরুল জীবনানন্দ, কত কি লিখে গেলেন দেশের মাটিকে নিয়ে,সে মাটির ঘ্রাণ আমার টেবিলেও এসে পরতো একসময়, টেবিলটা আধবুড়ো ছিল দু"এক তেলাপোকা দেখা যেত টেবিলের পেছনে বইগুলোকে ঘুরে ঘুরে দেখত হয়ত, William makepeace Thackeray, salman rushdie, wilkie Collins, জীবনানন্দ বইগুলোতে আমার আঙুলের ছাপ লেগে আছে,কতদিন পড়িনা ওদের, আমি এখন আর বইয়ে সময় নষ্ট করি না মা বই গুলোকে কাউকে দিয়ে দিও তোমার ঘর পরিষ্কার হবে , বইগুলোও কোন এক সঙ্গী পাবে , কতদিন ওরাও কারো হাতের ঘ্রাণ খুঁজে পায়না....

No comments:

Post a Comment