কৃষ্ণানন্দ
নাজমা আলী
প্রকাশক: চৈতন্য
প্রকাশনী
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ১৭
খ্রি.
প্রচ্ছদ: কাজী যুবাইর
মাহমুদ
পৃষ্ঠা: ৮০
মুদ্রিত মূল্য: ১৫০ টাকা।
'হঠাৎ করেই রাত বেড়ে যায়। কখন যে
সন্ধ্যা ঘনিয়েছিল রাতকে স্বাগত জানানোর জন্যে আর এখন রাত কত হবে--ভেবেই পাচ্ছে
না।' কে ভেবে পাচ্ছে না? 'কে এই মেয়ে? এতো শান্ত, এতো শুভ্র, এতো পুণ্যে
পরিপূর্ণ!'— মেয়েটি হচ্ছে রামী। রামীরা সুলতানা'।
নাজমা আলীর কৃষ্ণানন্দ'র কেন্দ্রীয় চরিত্র সে। ঘনায়মান রাতের আঁধারে আধাপাকা
'রাস্তা দিয়ে হাঁটছে রামী। রাস্তায় ছোটো ছোটো গর্তের মাঝে জমে আছে বৈশাখের বৃষ্টির
জল। ওর রাঙা চরণ দুটো গর্তের মাঝে ডুবে যায় মাঝেমধ্যে, আর তখনি গর্তে জমে থাকা জল
পায়ের আঘাতে ছিটকে পড়ে ওর শরীরের হাতে, মুখে, নীল শাড়িতেও।' মানে নীল শাড়ি পরেছে
রামী। রাধা বেশে হয়তো কৃষ্ণের অভিসারে গিয়েছিল। কিন্তু সত্যিই গিয়েছিল কি না, তা
আমরা জানতে পারি না। শুধু জানতে পারি: 'রামীর মস্তিষ্কটা সভ্য জগতে ফিরে আসে, ও
ভদ্র ছিলো কিনা!'
অনেকটা এভাবেই কৃষ্ণানন্দ'র কাহিনীটা
শুরু করেছেন নাজমা আলী। পাঠকের মধ্যে কৌতূহল সঞ্চার করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ— কৌতূহলের অবসান ঘটান নি। এ-ঘটনার পর ঘটতে থাকে একেকটি ঘটনা।
এগোতে থাকে কাহিনী। তবে কোন দিকে এগোচ্ছে, তা পাঠক টের পায় না। যাহোক, আমরা বরং কাহিনীর দিকেই ফিরি। সে-রাতটি পোহালে রামী হাঁটতে হাঁটতে পূজার বাসায় যায়। সে
'পূজার জন্মদিন উপলক্ষে একঝাঁক পাখির মধুর সুর উপহার দিতে চেয়েছিলো আর একটা
ঘাসফুল। ওগুলো সম্ভব হয় নি নিয়ে আসার...।' তবে রামীকে দেখামাত্র 'পূজা আবেগজড়িত
কণ্ঠে বলে--তুমি এসেছো তাহলে?' উত্তরে রামী বলে, 'তার মানে তুমি ভোর ও ভোরের
সূর্যকে দেখতে পাও? ভোরের শিশির ছুঁতে পারো সবুজ ঘাসের মতো? পাখির কলধ্বনি শোনো?
নাকি তোমার জন্মদিনের জন্য জেগে আছো সারারাত! নাকি তুমি জানতে, কেউ আসবে ভোরের
পাখির মতো, সূর্যের মতো, কিংবা শীতল হাওয়ার মতো! জানতে তো?'
এভাবেই দুজনের আড্ডা জমতে থাকে। আড্ডা
বাঁক নিতে থাকে সমাজতন্ত্র, নারীমুক্তির দিকেও। তবে সেসব অনেকটা শব্দ সর্বস্বই থেকে
যায়। যেমন: 'রামী ওকে (পূজাকে) একটা খোঁচা দিয়ে বলে--তুমি না সমাজতান্ত্রিক?...।
রামী নিজেই জানে না যে, ও
সমাজতন্ত্রকে সাপোর্ট করে। ও সর্বদাই সমাজতন্ত্রের কথা বলে, তবে ওর কোনো পার্টি
নেই। পূজা খুব ধীরভাবে শুঁকনো রক্ত বের করছে ওর নখের ভেতর থেকে, যে মশাটা ঘাড়ে বসে
রক্ত চুষছিল। ওর কাছে মশা যেনো পুঁজিবাদী সমাজগোষ্ঠী যার কারণে শুঁকনো রক্তটা
পুঁজিবাদীদের মুনাফা আর এইভাবে বের করতে হবে খেটে খাওয়া মানুষের মূলধন। পূজা পথ
খুঁজে পেয়েছে। কিভাবে সকলের অধিকার সমানে—সমান
হবে।'
কিন্তু পথটা কী, সে— পথে কারা এগোল, আদৌ কেউ এগোল কি না--শেষ পর্যন্ত এসবের কিছুই
আমরা জানতে পারি না। কেননা কাহিনী এখানেই মোড় নেয় অন্যদিকে। মায়ের প্রসঙ্গ আসে, আহ্লাদের প্রসঙ্গ আসে। আর এভাবেই আসে নারীমুক্তির কথা। 'রামী দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দেয়— দলটল বুঝি না, আমি চাই নারীমুক্তি।' আর এ নারীমুক্তির উপায়
হিসেবে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাই কামনা করেছে তারা। এসব কামনা নিয়ে ছাড়া-ছাড়া ভাবে কাহানি এগোতে থাকে। পরবর্তীতে সাতচল্লিশের দেশভাগ, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের আভাসও
ফুটে ওঠে আখ্যানে। আর যেখানে আবেগাপ্লুত জাতীয়তাবাদী ঢেউ দোলা দেয় রামীর মন যমুনায়:
'৭১-এর কুত্তা ছিলো ইয়াহিয়া খান এবং হিংস্র জানোয়ার। আমরা ইয়াহিয়ার মুখে লাথি মেরে
দেশ ছাড়া করেছি, আর ওর সঙ্গে অস্ত্রধারী যারা ছিলো সব পিঁপড়ার দল। আর পিঁপড়ার দল
এমনি মরে পায়ে পায়ে।'
কৃষ্ণানন্দ-এ আমরা লেখকের শব্দচয়ন, শব্দ বুননের উৎকর্ষতা লক্ষ করি। যা নিঃসন্দেহে একটি সার্থক রচনার সদ গুণ। তবে,
'অলঙ্কারের লাগামহীন প্রয়োগ রচনার বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নসাপেক্ষ করে
তোলে'--লঙ্গিনাসের এ-কথাটিও এখানে উল্লেখ করার মতো। প্রসঙ্গক্রমে এরিস্টটলের
কথাটিও বলা যায়। তিনি তাঁর পোয়েটিকস-এ বলেছেন: 'অপরিহার্যভাবেই তাই সুপরিকল্পিত
কাহিনীতে থাকবে মাত্র একক আকর্ষণ, দুইটি নয়।' অথচ আমরা কৃষ্ণানন্দ'র আখ্যানে অনেক
খণ্ড-খণ্ডাংশ কাহিনীর বিচরণ দেখি। যে-কারণে মূল কাহিনি আড়াল হয়ে যায়। এ যেন লেখক
ধুমধাম করে একটি বিয়ের আয়োজন করলেন, অলঙ্কারও আনলেন ঢের; কিন্তু কনে সাজানোর আগেই
বিয়েটা ভেঙে গেল! যে-কারণে কনের মনলোভা রূপ আমাদের মনশ্চক্ষুতে ধরা দিল না। এর মূল
কারণ হতে পারে একেক-পর-এর সঙ্গতিহীন ঘটনার অবতারণা। লঙ্গিনাস-এঁর ভাষায় যা
'কোনোরকমে পিন দিয়ে সেঁটে দেয়া হয়েছে বলে মনে হয়।' সম্ভবত এসব কারণেই আমাদের মর্ম চোখে সুস্পষ্ট কোনো আখ্যানের স্বরূপ উন্মোচিত হয় নি। বলা যায়, একটি সার্থক
জীবনোপাখ্যান সৃষ্টি করতে লেখক এখানে অনেকাংশে ব্যর্থ হয়েছেন।
তবে হ্যাঁ, আমরা 'naturalistic
fallacy বা প্রাকৃত আভাস' সম্পর্কে জানি। বলা হয় যে, 'শৈল্পিক আনন্দ-বিষাদ নিয়ে
শিল্পানন্দ আস্বাদনের কোনো সার্থক মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা করা চলে না। করলে সে
ব্যাখ্যা অপব্যাখ্যা হবে। এক ধরনের অনাপত্তি ঘটবে।' তাই কোনো রকমের ব্যাখ্যা দেয়া
থেকে দূরে থাকাই ভালো মনে করছি। আসলে অতো ব্যাখ্যা দেয়ার মতো বিদ্যাবুদ্ধি আমার
নেই। আমার দৌড় ঐ পাঠপ্রতিক্রিয়াটুকু পর্যন্তই।
কৃষ্ণানন্দ'র কোনো চরিত্রই ব্যক্তি
হিসেবে গড়ে ওঠে নি। যদিও যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল। হয়তো আমাদের সামাজিক পারিপার্শ্বিকতাও এর জন্য দায়ী হতে পারে। তার পরও, রামীকে আমরা একটু অন্যভাবে
আবিষ্কার করি। রামী এক বিত্তশালী ও বিপথগামী চেয়ারম্যানের মেয়ে। তবে তার বাবা-মা'র
মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে গেলে সে তার মায়ের সঙ্গে চলে আসে। ক'বছর মা-মেয়ে একসঙ্গে থাকে।
এবং পরে তার মা নতুন কারও সঙ্গে ঘর বাঁধলে রামী একা হয়ে যায়। তার এ একাকিত্বই তাকে
মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। সে প্রকৃতির মাঝে লীন হতে চায়। খুঁজে ফেরে তার
স্বপ্নঘোর কৃষ্ণকে। এ প্রসঙ্গে বইটির এ-অংশটুকু উদ্ধৃত করা যেতে পারে—
'ও দেখে ধানের রঙিন মুখে লক্ষ-কোটি
তারার চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে আর কী যেন বলছে ওই চোখগুলো!....। ও চোখ বন্ধ করে আর
আপনমনে প্রার্থনা স্বরূপ বলে, পৃথিবী তুমি বদলে যাও তোমার আপন মনের মন পিয়াসে, আর
তুমি বদলাও একটু একটু করে। আমি চাই না আমার যন্ত্রনা গুলোর অবসান ঘটুক। তোমার যতো
ইচ্ছে আমায় পোড়াতে পারো, তোমার দাহনে আর এতেই আমার বড়ো আনন্দ! পৃথিবী! তোমার সকল
স্বার্থগুলো আদায় করে নাও, আর আমি নিঃস্ব, নিঃসঙ্গ হয়ে থাকবো শুধু গোধূলির ধূসর
আলোর রঙ ছটার দিকে মুখ রেখে...। তুমি যদি চাও, আমার চোখ দুটো নিয়ে যেতে পারো,
তোমার পথ আলোকিত করার জন্যে। আমি কালো ঘোর কালো, সেখানে তোমার চোখ পড়বে না, কারণ
কৃষ্ণ তো কৃষ্ণই রাতের অন্ধকারের মতো। আমি একটি রাতের কালো মায়ার জালের ফাঁদে এঁটে
গিয়েছি। কিন্তু সেখানে তোমার চোখ পড়ার কথা না, কারণ তুমি এখন পরিপূর্ণ যন্ত্র, আর
আমি একটা পাথর, যার কোনো রস নেই, গন্ধ নেই!' (৭২ পৃষ্ঠা, কৃষ্ণানন্দ)। আর এর
কিছুক্ষণ পরে, উপন্যাসের শেষ অনুচ্ছেদে, আমরা দেখি: 'রামীর বস্ত্রগুলো খসে পড়ে
যমুনার তীরে আর উলঙ্গ রামী ঝাঁপিয়ে পড়ে যমুনার জলে!' (৮০ পৃষ্ঠা, কৃষ্ণানন্দ)
ক্রোচের মতে, 'যদি অসুন্দরে সুন্দরের কোনো উপকরণ না থাকত এবং তা হতো
পরিপূর্ণ, তাহলে ঠিক এ-কারণেই সে আর অসুন্দর থাকতো না।' আগেই বলা হয়েছে যে,
কৃষ্ণানন্দ-এ লেখকের শব্দচয়ন, শব্দবুনন বেশ প্রশংসনীয়। যেন মেঘলা আকাশ থেকে ঝরে
পড়েছে ঝিরিঝিরি বৃষ্টিফোঁটা। উর্বর করেছে কৃষ্ণানন্দের জমিন। আর সে-জমিনে গজিয়ে
উঠেছে একটি চারাগাছ। 'শিল্পী একটি গাছকে যেভাবে দেখতে চান, সেভাবে দেখান'— নন্দনতত্ত্বের এ-কথাটিও ফলেছে এখানে। ঝোপঝাড়ের মধ্যে গজিয়ে-ওঠা
গাছের শাখা-প্রশাখায় কুঁড়িও দেখা দিয়েছে। কিন্তু ফুল ফোটে নি। তবে এই যে কুঁড়ি দেখা
দিয়েছে, এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে রাশি রাশি ফুল ফোটার সম্ভাবনা। সে-সম্ভাবনায় লীন হয়ে
আছে একজন সম্ভাবনাময়ী লেখকের উত্থানও। যিনি বেশ সাবলীল ভাষায়, কোলাহলের মধ্যেও
কলতান তুলেন—
১.
তুমি কখনো মানুষের কাছে প্রার্থনা এবং আশীর্বাদ চেও না, কারণ মানুষই প্রার্থনা ও
আশীর্বাদ স্বরূপ।
(৩৬ পৃষ্ঠা)
২.
মানুষ স্বর্গ কামনা করে, আর আমি মানুষের মঙ্গল কামনা করি। আমি স্বর্গের আশায় পুণ্য
করি না,
আমি মানুষের মঙ্গলের জন্য পুণ্য করি। (৩৮ পৃষ্ঠা)
৩.
অন্ধকার একটা মদন, আর রামীর মস্তিষ্ক মদ, অন্ধকার আর মস্তিষ্ক যখন রতিক্রিয়া করে,
তখন মস্তিষ্কের যোনিতে অন্ধকার তার লিঙ্গ থেকে বীর্য উপহার দেয়, সেটা হচ্ছে ঘুম। (৪১ পৃষ্ঠা)
বইপাড়া যখন অখাদ্য-কুখাদ্যে সয়লাব,
তখন ভিন্ন ধাঁচের গন্ধ ছড়াতে চেয়েছেন নাজমা আলী। সে-গন্ধ ফুটন্ত ফুলের সুবাসিত
গন্ধ না হলেও অন্তত কটু গন্ধ নয়। তাই বলা যায়: উপন্যাস হিসেবে কৃষ্ণানন্দ পূর্ণতা
পাক-না-পাক; অন্তত উচ্ছন্নে যায় নি। বরং তা আমাদের সামনে এক সম্ভাবনার দ্বার
উন্মোচন করেছে। আমরা আমাদের সাহিত্যাকাশে একটি তরুণ তারার দ্যুতি দেখতে পাচ্ছি।
যদি খসে না পড়ে, তবে সে-তারার আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠবে আমাদের সাহিত্যাকাশ। প্রসঙ্গত
হোরেসের কথাটি স্মরণ না-করলেই নয়। তিনি তাঁর আর্স পোয়েটিকা'য় বলেছেন: 'মন এবং হাত
যে রকম চায়, বীনার তারে সব সময় সেই সুর বাজে না। 'কোমল' বাজাতে অনেক সময় 'কড়ি'
বেজে ওঠে। তীর অনেক সময় লক্ষ্যভেদ করতে ব্যর্থ হয়।' নাজমা আলী তাঁর প্রথম প্রয়াস,
কৃষ্ণানন্দ-এ সপ্রতিভ স্বাক্ষর রেখেছেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই আমরা আশাবাদী। আসুন,
কৃষ্ণানন্দ'র শেষ কথাগুলো পড়তে পড়তে কথার কচকচি শেষ করি—
'ও হাতড়ে হাতড়ে কৃষ্ণকে খোঁজে। কৃষ্ণ
ওকে কোলে নিয়ে ভেসে যায় মহা আকাশের শূন্য তলে! রামী আরক্তিম চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে,
কৃষ্ণের সোনার বদন! ও আলতো পরশে কৃষ্ণের সোনার বদন ছুঁয়ে দেয়। সে অনুভবে বোঝে
কৃষ্ণ অস্তিত্ববান...। ও চোখ বুঁজে কৃষ্ণের অস্তিত্বে চুমু খায় এবং শিশুর মতো
ক্লান্ত, শ্রান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে কৃষ্ণের শীতল কোলে। রামী কতোকাল ঘুমোয়নি! হয়তো সে
দৃঢ় প্রত্যয়ে এমন একটা শীতল কোলে ঘুমানোর প্রতীক্ষায় ছিলো।'
উৎসর্গ:
প্রিয় বন্ধু 'শ্রাবণী'কে
আমার কাঁচা লেখার পাকা সমালোচক।