-আপু,মেয়েটির নাম স্বপ্না কেন?
-ওর মা ওকে স্বপ্নে পেয়েছিল তো, তাই ওর নাম স্বপ্না!
আজ থেকে প্রায় ষোল বছর আগে আমার খালাত বোনের সাথে আমার কথোপকথন। বয়স আমার ছয় কি সাত। স্বপ্নারও একই বয়স। আপুদের পারিবারিক বন্ধু স্বপ্নারা। একসাথে একটা বিয়েতে যাওয়ার সময় স্বপ্নার সাথে আমার প্রথম দেখা। সবমিলিয়ে তিন ঘণ্টা ব্যাপ্তির সেই দেখাটিই ছিল স্বপ্নার সাথে আমার শেষ দেখা।
বাচ্চাদের পরী সাজানোর জন্য এখন যেরকম সাদা ফ্রক পরানো হয়, সেরকমই একটা সাদা ফ্রক পরেছিল স্বপ্না। সত্যিই তাকে পরী পরী লাগছিল। আমাদের দলে ছোট ছিলাম শুধু আমি আর স্বপ্না। বিয়েবাড়িটা ছিল পাহাড়ের উপর। ওখানে পৌঁছেই বড়রা যখন সামাজিকতা রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে গেলেন, আমি আর স্বপ্না হাত ধরে পাহাড়ের নিচে নেমে এসেছিলাম অন্যান্য ছেলেপিলেদের খেলা দেখব বলে। দুটি শিশুর স্বতঃস্ফূর্ত কাছে আসা, হাত ধরা-ধরিতে কোন জড়তা ছিল না। আধাঘণ্টার মত সময় পেয়েছিলাম একসাথে থাকার জন্য। তারপর খাওয়াদাওয়া করে যথারীতি যার যার বাড়িতে ফিরে যাওয়া। ততক্ষণে স্বপ্নার সাথে আমার গভীর বন্ধুত্ব হয়ে গেছে, এমন নয়। সে কারণেই সম্ভবতঃ তখন বিশেষ কিছুই অনুভব করি নি।
হ্যাঁ, স্বপ্নাকে আমিও পেয়েছিলাম স্বপ্নেই। সে রাতেই স্বপ্নে নিজেকে আবিষ্কার করেছি স্বপ্নার সাথে এক মধুর আলিঙ্গনে। আজ এতদিন পর এসে স্বপ্নের কথা শুধু এটুকুই মনে আছে। সেদিন সেই স্বপ্নের মানে বেশিকিছু বুঝতে পারি নি। শুধু মনে আছে, সেদিন সকালটাকে একটু বেশিই মিষ্টি মনে হয়েছিল। ভোরের সূর্যের সোনালি কিরণমালাকে মনে হয়েছিল যেন উৎফুল্ল হয়ে আমাকে দেখছে। সকালের মিষ্টি হাওয়া আমার শরীর-মনে অন্যরকম এক পুলকের সৃষ্টি করছিল। পাখির কিচিরমিচিরকে মনে হচ্ছিল কোন এক সুরে বাঁধা গান। সত্যিই কোন সকাল এত মধুর হতে পারে সেদিনের আগে আমার জানা ছিল না।
এরপর ধীরে ধীরে পড়াশুনা, এটা-ওটা। সবমিলিয়ে নিজেকে সঁপে দিয়েছি রোবটিক জীবনে। নিজেকে টানতে টানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের থার্ড ইয়ার পর্যন্ত এসে পৌঁছেছি। মাঝখানে ষোলটি বছর। স্রেফ ষোলটি বছর স্বপ্না একেবারে নেই হয়ে গিয়েছিল।
সেদিন ঝুম বৃষ্টি, ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমেছে আমার জানালায়। ঝিঁঝিঁ পোকারা ডাকাডাকি শুরু করেছে। মনটা বিক্ষিপ্ত। আমি তন্ময় হয়ে বৃষ্টি দেখছিলাম। নিজের ভেতরে কোথায় যেন একটু নড়াচড়া অনুভব করলাম। স্বপ্না! আজ ষোলটি বছর পর এমন এক মন খারাপ করা সন্ধ্যায় কেন তোমার আবির্ভাব! এক লাফে ফিরে গেলাম ষোল বছর আগের সেই সময়টাতে। সেই হাত ধরা দুপুর, সেই স্বপ্নের রাত কিংবা মিষ্টি ভোর।
স্বপ্না এখন নিশ্চয় আর ছোট্ট পরীটি নেই। সে এখন বড় পরী। ষোল বছর আগে আধা ঘণ্টার জন্য যে ছেলেটির হাত ধরেছিল তার কথাও এতদিন মনে নেই হয়ত। কিন্তু আমার মনে আছে। আমার প্রতিটি নিঃসঙ্গ মুহূর্তে, আমার মন খারাপ করা বিকেলে কিংবা নিশুতি রাতে আমার তারা দেখার সঙ্গী স্বপ্না। আমি অস্ফুটে তার সাথে কথা বলি, হাসি, তার হাত ধরি। সে এক মায়াবী আবেশ, সে এক মধুর অনুভূতি। তারপরও এটা নিঃসঙ্গ মানুষের নিজেকে ফাঁকি দেওয়ার এক বৃথা প্রচেষ্টা। দিনের আলোতে চোখ বন্ধ করে স্বপ্নের আবেশে জড়িয়ে থাকার মিথ্যা আকুতি। জানিনা স্বপ্না এখন কোথায়, কি করছে।
যখন অনেক বৃষ্টি হয় আর আমি কালো পিচের উপর ছাতা মাথায় ধীর সিক্ত পায়ে হেঁটে যাই, যখন ঝড়ো হাওয়ায় দুলতে থাকা বৃক্ষ শাখাগুলো আমাকে ছোঁয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে, শুধু একটি ছোঁয়া পাওয়ার জন্যই আমি ব্যাকুল হয়ে থাকি। এই সময়ে যদি রক্ত-মাংসের স্বপ্না আমার পাশে থাকত! যদি পরম নির্ভরতায় আমার হাতটা ধরে পাশে পাশে হাঁটত! সেই সুখ, সেই উষ্ণতা, সেই অনুভূতি জানি না কখনও পাবো কিনা।
আর একটিবার যদি ফিরে যেতে পারতাম ষোল বছর আগের সেই দিনটিতে, আর একটিবার যদি ধরতে পারতাম সেই শুভ্র ছোট্ট পরীটির হাত! তার কানে কানে ছোট্ট একটি কথা বলতে আমি মোটেই ভুলে যেতাম না!
No comments:
Post a Comment