কমলের বউয়ের নাম পারমিতা।ফুলসজ্জার রাতে কমলের বড় বৌদি বলল, “বউয়ের নাম কমলিনী হলে কেমন হত, কমল ঠাকুরপো? কমল-কমলিনী, আমরা দেখ না মৃণাল –মৃণালিনী!” কমলের বড়বৌদি মৃণালিনী বাংলায় এম.এ.। কলেজের বাংলার শিক্ষয়িত্রী হওয়ার জন্য শত চেষ্টা করেও আজও মৃণালিনীর ভাগ্যে বাংলার মাস্টারনী হয়ে ওঠা হয় নি। কমলের ছোট বোন সৌদামিনী বড় বৌদির কথায় অস্বস্তি প্রকাশ করলে মৃণালিনী বলল- “তোর পথ চেয়ে সৌদাম বসে আছে! তাকে আমিই খুঁজে এনে তোর গলায় গেঁথে দেব।” বৌদির কথায় সৌদামিনী মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে উঠে।
সে সময় পারমিতার মনে তার অন্তরঙ্গ বান্ধবী কঙ্কনা কথাগুলো মনে পড়ে। তার বান্ধবীদের মধ্যে একমাত্র কঙ্কণাই বিবাহিতা। বিয়ে সম্পর্কে সে তার বাস্তব অভিজ্ঞতা পারমিতার সঙ্গে শেয়ার করতে দ্বিধা করেনি। ট্রেন লেট থাকায় বর ও বরযাত্রীরা ঠিক সময় আসতে না পরায় রাত তিনটার লগ্নে পারমিতার বিয়ে শুরু হওয়ায় কঙ্কনা সবচেয়ে অস্বস্তি বোধ করে বিয়ে শেষ হতে না হতে ভোর হয়ে যাওয়ায়। এতে পারমিতার মনে একটুও মাথা ব্যথা না থাকলেও কঙ্কনার আফসোসের অন্ত নেই। সে বাসর ঘরে ঢুকে পারমিতার কানে কানে বলল, “বাসররাতের আনন্দটা মাটি হয়ে গেল বলে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে রে, পারমিতা। ফুলসজ্জার রাতকে মাটি করে দিস-নে কিন্তু। ননদ, বৌদিদের পাল্লায় পড়ে ওটাও মাটি না হয়ে যায় সেটাই আমরা ভাবনা!” কঙ্কনা কথা থামিয়ে পারমিতার মুখের দিকে তাকায়।
পারমিতা ভেবে পায় না সে কী বলবে। কঙ্কনা আবার কথা শুরু করে, “ননদ, বৌদিরা তোকে মজা করে রাত কাবার করে দিতে চাইলে তুই কিন্তু ঘুমের ভান করে থাকবি।” পারমিতা তার কথা শুনে ভাবে, কঙ্কনা জীবন সম্বন্ধে একটু বেশিই ভাবে। সে শুধুমাত্র বলল, “ তোর কথা মাথায় রাখব।”
ফুলসজ্জার রাতে তার নাম নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করায় পারমিতা অস্বস্তি বোধ করে। কঙ্কনার কথা মত তাকে ঘুমের ভান করতে হল না। রাত একটু গভীর হতেই সবাই তাদের রুম থেকে কেটে পড়ল। রুমটাতে নীরবতা নেমে এল। এক সময় কমলই মুখ খুলল, “ফুলসজ্জার রাতে এমন গোমরা মুখে থাকে নাকি নতুন বউ। তুমি হয়ত বড় বৌদির কথায় মাইন্ড করেছ। তার কথা রাখ। আমি তোমার নামটাকে বদলে কমলিকা করতে চাইনে, তবে তোমার নামটাকে একটু ছেঁটে দেব। আমি তোমাকে ডাকব মিতা বলে। স্বামীটির মিষ্টি কথাটা পারমিতার ভালই লাগে। পারমিতার বড় ভয় ছিল না জানি গোঁফওয়ালা লোকটি কেমন হয়।
নীলাভ ডিম লাইটের আলোয় রজনীগন্ধা ও গোলাপ ফুলে ফুলে সাজানো রুমে স্বামীর সাথে ফুলসজ্জার রাতের কাটানোর অভিজ্ঞতার কথা পারমিতা পনেরটা বছর পরেও ভুলতে পারে না। সে রাতে কমল হয়তো ভেবেছিল পারমিতা তাকে আগে কাছে টেনে নেবে। কিন্তু সে কমলকে আগেভাগে কাছে টেনে না নেওয়ায় ও উসখুস করছিল। সে সময় কেন যেন পারমিতার মনে পড়েছিল তার ঠাকুমার কথা। ঠাকুমা বলতেন পদ্মিনী শ্রেণির নারীরা কখনোই আগেভাগে পুরুষকে তা সে তার নিজের স্বামী হোক না কেন যৌন উত্তেজনায় উদ্দীপ্ত করে না। পর পুরুষের সান্নিধ্য তারা কখনোই কামনা করে না। একমাত্র স্বামীই তাকে উদ্দীপ্ত করে তোলে। কমলই প্রথম বেহুশের মত তাকে কাছে টেনে নেয়। সে তার চিবুকে চুমু দিতে থাকে একের পর এক। স্তন দুটোয় কমলের হাতের প্রথম আলতো ছোঁয়ায় পারমিতা লাজে রাঙা হয়ে উঠে। সে ভাবে, আজ রাতে স্বামী সহবাসের আগ পর্য্ন্ত সে ছিল অনাঘ্রাতা কুমারী মেয়ে। সে নিজেকে এতদিন অনাঘ্রাতা প্রস্ফুটিত পুষ্প বলেই মনে করে এসেছে! লাজে রাঙা হয়ে যাওয়াটা পারমিতার জন্য অস্বাভাবিক ছিল না। তারপর তার স্বামী কমল যা যা করে তাতে পারমিতার সারা শরীরে শিহরণ জাগে। সে এক সময় অনাস্বাদিত এক আনন্দের সাগরে ডুবে যায়।পরদিন পারমিতার মনে হয়, তার স্বামী বৃষ শ্রেণির পুরুষ, অন্যদিকে, সেও হয়তো পদ্মিনী শ্রেণির নারী নয়।
বিয়ের আগে স্বামীকে মানিয়ে নেবার কথা পারমিতা সবচেয়ে বেশি ভেবেছিল। বিয়ের পর স্বামীর ঘরে গিয়ে এক সময় তার বেশি মনে পড়েছিল তার ঠাকুমার কথা। ঠাকুমা বলতেন, “তোর নাম পদ্মিনী রাখা উচিত ছিল। প্রথম প্রথম সে ঠাকুমার কথা বুঝে উঠতে পারতো না। তিনি মিষ্টি কণ্ঠে লালনগীতি গাইতেন। ঠাকুমার বাবা অভিবক্ত বাংলার নদীয়া জেলার কুষ্টিয়া মহকুমার এসডিও অফিসের হেডক্লার্ক্ ছিলেন। মোহিনী মিলের কাছেই তাদের বাসা। একটু দূরে ছেউড়িয়ায় লালনের আখড়া। ঠাকুমার বাবা লালনের ভক্ত। মেয়েকে নিয়ে তিনি ছুটির দিনে আখড়ায় যেতেন আর সেই থেকেই ঠাকুমার লালনগীতি শেখা। একদিন সন্ধ্যায় ঠাকুমা লালনের এই গানটা গেয়ে নারী পুরুষের শ্রেণির ব্যাখ্যা করেছিলেন। “চিন্তামণি ,পদ্মিনী নারী এরাই পতি সেবার অধিকারী। হস্তিনী, শঙ্খিনী নারী তারা ককর্শ্ ভাষায় কয় বচন। শশক পুরুষ সত্যবাদী, মৃগ পুরুষ উর্ধভেদী।
অশ্ব, বৃষ নিরবধি তাদের কুকর্মে সদাই মন।” তিনি গান থামিয়ে একটু ভেবে আবার বললেন, “বিদ্যা, জ্ঞান, চলনবলন, স্বভাব চরিত্রের লক্ষ্মণ অনুযায়ীই তুই পদ্মিনী শ্রেণির নারী। আমি বেঁচে থাকলে তোর বিয়ে শশক শ্রেণির পুরুষের সঙ্গে দেব।” দু:খের বিষয় পারমিতার বিয়ের আগেই ঠাকুমা মারা যাওয়ায় তিনি তার ইচ্ছে পূরণ করে যেতে পারেননি।
পারমিতারা দু’বোন এক ভাই। বোন দু’জনের মধ্যে পারমিতা ছোট, দিদি জয়িতার বিয়ে হয় স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর পরপরই। তখন বাড়ির কাছাকাছি কলেজ না থাকায় ইচ্ছে থাকলেও জয়িতাদির আর পড়াশোনা করা সম্ভব হয়নি। জয়িতাদির বিয়ের আগে পরমিতা ক্লাস এইটে পড়ত। ঠাকুরদা অকালে গত হবার পর ঠাকুমা সংসারের হাল ধরেন।তখন বাবা,কাকা,আর পিসিকে মানুষ করার দায়িত্ব ঠাকুমা নিজ হাতে তুলে নেন।
ঠাকুমার সাথে পারমিতার গলায়গলায় ভাব। তার লেখাপড়া,ভাল চাকরীর মূলে ঠাকুমার অবদানকে পারমিতা সব সময়ই বড় করে দেখে। এসএসসি পাশ করার পর মা জয়িতাদির মত পারমিতাকেও বিয়ে দিতে চাইলেন। কিন্তু বাদ সাধলেন ঠাকুমা। “ বৌমা, জয়িতা দিদিভাইয়ের মত পারুকে জলে ফেলে দিতে আমি দেব না।”
ঠাকুমা লেখাপড়া জানতেন ভালই। রামায়ণ , মহাভারত থেকে আরম্ভ করে রবীন্দ্রনাথ,শরৎ,বঙ্কিম এর গল্প উপন্যাস পড়ে পড়ে তিনি প্রায় কণ্ঠস্থ করে ফেলেছিলেন ।উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার রায়ের গল্প ও ছড়া তাদের ভাইবোনদের শোনাতেন। বিয়ের আগে পারমিতার ইচ্ছে ছিল এম.এ.টা পাশ করার, ঠাকুমা বেঁচে থাকলে এম.এ পাশ করার আগে কোন মতেই তার অনুমতি দিতেন না। অনার্সে সে ভাল রেজাল্ট করেছিল, এম.এ.তেও সে ভাল করবে এ আশা তার মনে দৃঢ়ভাবে গাঁথা ছিল। কিন্তু পারমিতার বাবা মা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে ভাল চাকুরে ছেলে কমলকে হাত ছাড়া করতে চায়নি।
বিয়ের পর পরই কমল একটা প্রমোশন পেয়ে ফরিদপুর জোনাল অফিসে থেকে ঢাকার হেড অফিসে বদলি হওয়ায় পারমিতার আশা পূরণ হওয়ায় বাঁধা থাকে না। পারমিতা প্রীতিলতা হলে থেকে অনার্স করেছিল।
সে সময় পারমিতা বাবার বাড়িতে, জামাইষষ্ঠীতে এসে কমল পারমিতাকে সুখবরটা দিল।“ ভার্সিটির কাছাকাছি কলাবাগানের প্লে গ্রাউন্ডের সামনের বাসাটা হয়তো পেয়ে যাব, ওই বাসাটা পেলে তোমার এম.এ.টা শেষ করা সহজ হবে।” স্বামীর কথা শুনে পারমিতার ভাল লাগে।
সত্যি সত্যি পারমিতা আশা পূর্ণ হয়, সে মাস্টারে ভাল রেজাল্ট করে, আর ভাল রেজাল্টের সুবাদে সে বিদেশী প্রাইভেট ব্যাংকে সরাসরি এক্সিকিউটিভ অফিসার হওয়ার সুযোগ পায়। পারমিতার ঘাড়ে একরাশ দায়িত্ব চেপে বসে। তারপর একে একে বছরের পর বছর গড়িয়ে যায়।তাদের একমাত্র ছেলে কুনাল এখন ক্লাস সিক্সে পড়ে। পারমিতার কাজের পরিধি আরো বেড়েছে। অফিসের কাজের সাথে সাথে স্বামী ও সন্তানের দেখভাল করতে গিয়ে সব সময়ই ব্যস্ত থাকত হয়।
কুনালের দু’জন প্রাইভেট টিউটর থাকলেও পারমিতা অফিস থেকে ফিরে একটু ফ্রেশ হয়ে সন্ধ্যায় কুনালকে নিয়ে বসে। এ দিকে একটা প্রমোশন পেয়ে উচ্চপদে আসীন হওয়ায় কমলের কাজের পরিধি কমে যায়। সে অফিসার ক্লাবের উদ্দেশ্যে সন্ধ্যার পর পরই বের হয়ে যায়। ফিরে আসে ডিনারের আগে রাত নয়টার দিকে। কাজের মেয়েটি রান্নাবান্না করে বাড়ি ফিরে যায়। ফলে ডিনারের আয়োজন পরিমিতাকেই করতে হয়। প্রতিরাতেই ক্লান্ত হয়ে বিছানায় যায় পারমিতা।
পনের বছরের দাম্পত্য জীবনে পারমিতা স্বামী কমলের কাছে পরাস্ত হয়নি কোন দিনই। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে যেন তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। এখনো তার স্বামী তাকে আগের মত পেতে চায়। কিন্তু পারমিতা অফিস থেকে ফিরে খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়ে, ফলে তার পক্ষে স্বামীর ইচ্ছাকে পূরণ করা প্রায়ই সম্ভব হয় না। কমল জোরাজুরি করতে কম করে না। এক এক রাতে পারমিতা অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিজেকে স্বামীর কাছে সঁপে দেয়। সে বুঝতে পারে কমল তাকে ভোগ করে আগে মত পরিতৃপ্ত হতে পারে না। পারমিতার মনে আগের মত শিহরণ জাগে না।
দিনের দিন এ অবস্থা চলতে থাকে। কমল পারমিতাকে বুঝতে চায় না। এক সময় পারমিতা মনে হয় তার স্বামী অন্য নারীর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। সব কিছু বুঝেও সে কীভাবে তার স্বামী কমলকে বেঁধে রাখবে? তার মনে পড়ে ঠাকুমার কথা-সে সত্যি সত্যি পদ্মিনী শ্রেণির নারী, আর তার স্বামী কমল অশ্ব কিংবা বৃষ শ্রেণি পুরুষ ।পারমিতা ভাবে সে পদ্মিনী- আর সে পদ্মিনীই থাকবে।
-------------------------------------------------------------------------------------------------------
No comments:
Post a Comment