বাংলা বর্ষপঞ্জির যে দুটি তারিখ বাঙালির চেতনার রঙে পান্নার মত সবুজ তার একটি হল ২২
শে শ্রাবণ। বাঙালির বিশ্বজোড়া গৌরবের মূর্ত বিগ্রহের মহাপ্রস্থানের দিন।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে দেহান্ত হবার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর ১৯৪১ সালের এই দিনটিতে
কলকাতা ভীষণভাবে আলোড়িত হয়েছিল তার সাহিত্যিক বিবরণ আছে বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাসে।
পরপদানত সেদিনকার অবিভক্ত বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষীয় এক বিশাল যুবসমাজ রবীন্দ্রনাথের
বাণী ও রচনার মধ্যে তাদের যথার্থ মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছিল। তখনও এদেশে আপামর জনসাধারণের
মধ্যে মূল্যবোধ আজকের মত এমন করে ক্ষয়ে যায়নি। ফলে রবীন্দ্রনাথ তাদের জীবনে দূরের
নক্ষত্র ছিলেন না ছিলেন ধ্রুবতারা।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর মাত্র ছ'বছর পরে দেশ স্বাধীন হল। ইতিমধ্যে দ্বিতীয়
মহাযুদ্ধ, কৃত্রিম
অন্নাভাবজনিত মন্বন্তর এবং সবশেষে ধর্মের ভিত্তিতে দেশবিভাগ-এই তিনের প্রবল
অভিঘাতে সমগ্র দেশের শুধু যে স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়ে গেল তা নয়, যাবতীয় শুভচেতনা ও মূল্যবোধের অবসান ঘটে গেল।
স্বাধীন ভারতবর্ষে, বিশেষ করে
খণ্ডিত পশ্চিম বাংলায় ২২ শে শ্রাবণ ভেসে গেল ছিন্নমূল মানুষের দিনানুদৈনিক
জীবনসংগ্রামের স্রোতে। যে দুঃসময়ে রবীন্দ্রনাথকে সাথে করে চলা আমাদের সবচেয়ে বেশি
প্রয়োজন ছিল তখনই তাঁকে মনে করার অবসর হল না আমাদের। ফলে একটু একটু করে
রবীন্দ্রনাথ সরে গেলেন বাঙালির জীবন থেকে। রাষ্ট্রীয় বিপর্যয়ের দু:সময় একদিক কেটে
গেল, ছিন্নমূল পরিবারেরা
এপার বাংলায় খুঁজে পেলেন তাদের মাটি, নতুন প্রজন্মের কাছে রবীন্দ্রনাথ হয়ে গেলেন বিলীয়মান
স্মৃতিকথা।
এই শোকাহত বিস্মৃতি বাঙালির রাজনীতিতে, সংস্কৃতি চিন্তায়, শিল্প সাহিত্যে গানে প্রবল প্রভাব বিস্তার করে।
ভাষার দূষণ, সংগীতে পচন, সামাজিকতায় রাজনীতির বন্ধন। যাক সে কথা, আজ আমরা দুই বাংলার মানুষ নতুন ভাবে
রবীন্দ্রচর্চা রবীন্দ্রোত্তর পথে চলেছি এক স্রোতে। এবং এই ভাবে এগিয়ে চলে আমাদের
বিবেক ও শুভবুদ্ধির কাছে মাথা উঁচু করে রাখি। এই কাব্যপুত্রকে নিয়ে আমার দুটি
কবিতা রয়েছে-
রবীন্দ্রনাথ
-১
রবীন্দ্রনাথ, তোমাকে বুঝিনা আমি,
তোমাকে ছুঁতে
পারিনি কখনো
অথচ কোন কোন
মুহূর্তে
তোমাকে শ্বাস
প্রশ্বাসের মতো
অনিবার্য, খুব আপন মনে হয়।
জীবনে প্রথম
বেদনা কাদম্বরী,
তারপর সমস্ত
জীবন
ছিন্নপত্রাবলী
লেখা হয় খুব, ছিন্ন নয়,
এক অন্তর্লীন
স্বভাবে সব একাকার-
শোক, গোপন প্রণয়, দুঃখ, এমন কি
আলখাল্লায়
ঢাকা ঐ রহস্যময় শরীর
সবই ছিল
শিল্পের উপাদান,
কবিতার সারাৎসার,
প্রচ্ছদের
আড়ালে শুধু ছিলে তুমি
যাকে কোনো
দিনও
স্পর্শ করতে
পারেনি কেউ।
রবীন্দ্রনাথ
-২
প্রতিদিন কত
মৃত্যু দেখি, অদৃশ্য গোপন
কীট
শরীরের রক্ত
শুষে নেয়,
নিজের বুকের
ভিতর ভেঙে ভেঙে যাই,
অভিশাপ দিই
কাকে তাও জানি না।
জীবনের প্রথম
শোক কাদম্বরী
সেদিন সমস্ত
আকাশ ভরেছিল অন্ধকারে
তবু তুমি
বিহ্বল হওনি, বিহ্বলতা সাজে
না তোমাকে,
তুমি আমৃত্যু
মগ্ন হলে শব্দের মারাত্মক প্রেমে
চতুর্দিকে
দুঃখের বলয়ের ভিতর
ফুটে উঠল, কবিতা, গান, গল্প, শোকের প্রতিমা।
---------------------------------------------
No comments:
Post a Comment