চুয়ানির ঢেকুর উঠে মুখটা কেমন টক টক হয়ে গেল
বিল্লালের। ‘মালে নিশ্চিত ভেজাল দিছে সাত্তার হারামজাদা। ঠেকের লগে মাগিবাজি শুরু করায়
সাত্তাইরার ব্যবসায় ভ্যাজাল ঢুকছে।’ সাত্তারকে গালি গালাজ করতে করতে থেকে থেকে বমি
করে বিল্লাল। মনে হচ্ছে পেটের নাড়িভুঁড়ি উল্টে আসবে। বমির দমকে রাস্তায় বসে পড়ে ও।
একটা পুরি আর একটা সিঙাড়া পেটের ভেতর যেয়ে অতটা হয়ে গেছে ভাবতে অবাক লাগে ওর। মিনিট
পাঁচেক পর বিল্লাল স্থির হয়। মুখে খানিকটা পানি দিতে পারলে আরাম হতো।
কী ছাইপাশ খেলো! পয়সা ওঠাতো দূরের কথা পেট
মুচড়ে ব্যথাও শুরু হয়েছে। আর যাবে না সাত্তারের ঠেকে। ‘মদের ব্যবসায় দুই লম্বারি ঢুকায়
দিছে হালায়। হারাদিন ম্যায়া মানুষের গতর টিপার কাম করলে কি আর ব্যবসা করণ যায়?’ বমির
পর শরীরটা হালকা লাগছে বিল্লালের। বাড়ি এখনো দূর। মধ্য বাড্ডা থেকে হেঁটে দশ মিনিট,
তারপর দশ টাকা দিয়ে খেয়া পেরুতে হবে।
রাত ভালোই হয়েছে। রোজ ফিরতে ফিরতে রাত বারোটা
পার হয়। রিকশা গ্যারেজে রেখে ফিরতি পথে কড়াইল বস্তিতে সাত্তারের ঠেকের আধ প্যাকেট চুয়ানি
না পেলে আজকাল শরীরটা কেমন নিস্তেজ লাগে বিল্লালের। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে খুচরোগুলো
লুঙ্গির খুঁটে গুণে রাখার পর এই নেশাটুকুর জন্য অপেক্ষা করে সে। এই এতটুকুই সৌখিনতা
তার জীবনে। নেশা পায়ে টলতে টলতে ওপেনটি বায়াস্কোপ বলতে বলতে বাড়ির পথ ধরে। মাঝপথে নৌকার
সময়টুকু ঝিম মেরে বসে থাকে।মুখ থেকে গন্ধ আসে বলে সহযাত্রীর গাল খায় মুখ বুঁজে। এতো
আর শালা বউ নয় যে গুদুমগাদুম লাগাবে। তবু খানিকটা তরল পেটে পড়লে জীবনটাই আয়েসী হয়ে
যায়। সবকিছু ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। মাঝে মাঝে সবকিছু ভেঙে ফেলতেও।
দু-একদিন ফেরার পথে পুলিশী ঝামেলায় পড়ে না
যে তা না। দু একটা চড় থাপ্পর বা লাথি খেয়েও বিল্লাল গা করে না। কিন্তু সেসব অযাচিত
মারের শোধ তোলে বাড়ি যেয়ে। সব আদিমতা ভর করে যখন সে সালমার গায়ে হাত দেয়। সারাদিনে
প্রাপ্ত সবটুকু অপমানকে নিঃশেষ করে বউয়ের শরীরে। সেসব দিনের ব্যতিক্রম ছাড়া বিল্লাল
নেশার সুখ সময়টুকু উপভোগ করে তোলে।
নিজেকে রাজা বাদশা ভাবতে ভাবতে পরিচিত পথে
বাড়ি ফেরে, সালমাকে পাশ বালিশ বানিয়ে ঘুমায়। শরীরের জেগে ওঠা থেকে ঘুমিয়ে পড়াটা এত
দ্রুততা এবং ক্ষিপ্ততার সাথে করে যে বউয়ের গোঙানিকে শীৎকার বলে ভ্রম হয়। সালমার কাজল
লেপটানো চেহারাতে ভয় দেখে আপ্লুত হয়। ‘ক্ষেম না থাকলে পুরুষমানুষ কীয়ের!’
সব আজ ভেস্তে গেল। নাহ্ কাল যদি মাল ঠিকঠাক
মতো পেটে না পড়ে সাত্তারের খবর পুলিশের কাছে দিয়ে দেবে সে। রাসেলের মতো। রাসেল পুলিশের
সোর্স হয়ে ভালো আয় রোজগার করে। লোকজন কত সমীহ করে রাসেলকে। রাসেলের কাছে গিয়ে নাম লেখাবে।সাত্তারকে
শিক্ষা দেয়ার সাথে সাথে দুপয়সা আয়রুজিও হবে।
বিল্লালের শরীর অবসন্ন লাগে। পেট খালি। খাবার
যা ছিল বের হয়ে গেছে। বাড়ি ফিরে গরম গরম ভাত পেলে মন্দ হয় না। কিন্তু আজকাল সে রাতে
খায় না বলে সালমার কোনো আয়োজনও থাকে না। বললে অবশ্য করবে। সালমা মেয়ে হিসেবে বেশ কর্মী।
ঘর সংসারের দিকে খুব নজর। কিন্তু কেমন জানি দুঃখী দুঃখী চেহারার মানুষ। মুখের উপরে
দুঃখ ঝোলানো মেয়েমানুষগুলো দেখলে বিল্লালের রাগ লাগে।গেল সপ্তাহে সাত্তারের ওখানে একটা
মেয়ে দেখেছিল। আহা! কী হাসি! ঠোঁটের আড় ভেঙে কথায় কথায় খলবলিয়ে হাসছেই।আর বাদামী কালি
না কি দিয়ে ভ্রু এঁকেছিল, সেই ভ্রুর নাচন দেখে বিল্লাল বারবার উদাস হয়েছে।
বুক পকেট থেকে একটা বিড়ি বের করে বিল্লাল।
পেটের ভেতর নাড়া দিচ্ছে তবু বিড়ি ধরাতেই তামাকের ঘ্রাণে মনটা চনমন করে ওঠে ওর। জোরে
একটা টান দিয়ে গাল ফুলিয়ে আয়েস করে ধোঁয়া ছাড়ে। কাল একটু খানি পাতা গুঁজে নেবে বিড়ির
ভেতর। আহা সেইতো আবার সাত্তারের কাছেই হাত পাততে হবে।সাত্তারের গাঁজার দমও ফুরিয়ে গেছে।
পানসে। বিল্লালের চিন্তা লাগে নাকি ওর মুখই পানসে হয়ে যাচ্ছে। নেশা সহ্য হচ্ছে না যে
আজকাল!
“ওপেনটি
বায়াস্কোপ
নায়েন
টেয়েন টেস্কোপ
সুলতানা
বিবিয়ানা
সাহেব
বাবুর বৈঠকখানা
রাজবাড়িতে
যেতে
পান
সুপারি খেতে”।
একবার সুর তোলে। তারপর চুপ। নাহ্। আজ ওপেনটি
বায়াস্কোপে জুত হচ্ছে না।বিল্লাল ঘাটে নেমে দাঁড়াতেই তলপেটের চাপ টের পায়। লোকজনের
সামনে থেকে নিরাপদ দূরত্বে যেয়ে তলপেট হালকা করতে করতে বিল্লালের প্রফুল্ল লাগে।অদূরে
দাঁড়ানো দুটা কুকুর একে অপরের উপরে জোর খাটাচ্ছে। আশেপাশের কারো দিকে ভ্রুক্ষেপ নাই।নিজেদের
কামনাই দুনিয়াই একমাত্র সত্য। কুকুর দুটার যৌনাসন দেখে বিল্লালের হাসি পায়, শালার কুত্তার
বেলা-অবেলা নাই সোহাগের।
নাহ্ আজ সালমাকে সময় নিয়ে আদর-সোহাগ করবে।
বিছানায় যাবার আগে ভালো করে কুলকুচা করে নিবে। সালমার শরীরের ঢকপদ নেহায়েৎ মন্দ না।
শরীরে দলা দলা মাংস না থাকলে মেয়ে মানুষ ভালো লাগে না ওর। আজ সাত্তারের ওখানে একটা
বেশ্যা শরীর ঘেঁষে বসেছিল ওর। ড্যাঙা শরীর আর মুখে উৎকট মেকাপ। বলে কিনা হাজারের নিচে
না। ‘শইল নাই আবার মাগীর দাম কত!’ বিল্লাল ফিরেও তাকায়নি। আর যাই হোক মেয়েমানুষের নেশা
নাই ওর। পকেট কাটার ভয় তো আছেই তাছাড়া সে ভালো করেই জানে ঢাকার ওইসব মেয়ে মানুষরা নানান
অসুখ নিয়ে ঘোরে। ওর ভয় লাগে।
জলাভূমির পাশ বলে এই জায়গাটা খানিকটা কোলাহল বিহীন।
আকাশের দিকে তাকালে মনটা উদাস লাগে। আকাশে ঝক্ঝকে জোছনা। যদিও শহরের বৈচিত্র্যে জোছনা
উপভোগ্য না। আর বিল্লালের মতো দু'পয়সার মানুষ প্রকৃতি বিলাসিতায় নেই। তবু আকাশের দিকে
তাকিয়ে ওর ঘোর লাগে। সেই ঘোর লাগা থাকতে থাকতে সে রিকশায় ওঠে। সালমার মুখের দুঃখী ছাপ
আজ সে মুছিয়ে দিবে। ভালো করে শুনে নিবে অত কষ্ট কিসের মেয়ে? সালমার বেদনার্ত মুখটা
মনে করে বিল্লাল ক্ষণিকের জন্য দুঃখী বোধ করে। আহা! সারাদিন একলা থাকে! আজ সোহাগে আদরে
বউকে ভরিয়ে তুলবে আর বীজ দিবে। একটা ঢলোঢলো মুখের বাচ্চার জন্য বুকের ভেতরটা হঠাৎ ছটফট
করে ওর।
বাড়ির অদূরে কার ছায়া দেখা যায়। বিল্লালকে
নামতে দেখে ছায়াটা চতুষ্পদী জন্তুর আবেগে দৌড়ে আসে, ‘বিল্লাল তর বউ ভাগছে। সেলিমের
লগে। বড় একখান ব্যাগ লইয়া সেলিমের রিশকাত কইরা দুপুরে বাইর হইছে। সেলিমও ফিরে নাই,
তর বউও না।’
কেমন টক ঢেকুর উঠে বিল্লালের মুখটা আবার বিস্বাদ
হয়ে যায়। শ্রবণ শক্তিহীন বিল্লাল নোনতা থুতু ফেলতে ফেলতে বিড়বিড় করে, ‘হারামজাদা সাত্তাইরা
মালে লিশ্চিত ভ্যাজাল দিছে।’
_____________
No comments:
Post a Comment