বাংলা কবিতায় বর্ষাঋতুর
সৌন্দর্যবোধ
প্রকৃতির রূপের যে
বিচিত্র অভিক্ষেপ তার মূলে শুধু যে আবহাওয়াগত কারণই বিদ্যমান এমন নয়,ঋতুগত প্রভাবও তার ওপর কম নয়; বরং বলা যায় যে, প্রকৃতির
স্বভাব-চরিত্রকে বিচিত্রগামী করেছে এই ঋতু পার্থক্য। বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। ষড়ঋতুর
প্রকৃতি তার বিচিত্র স্বভাবের অভিব্যক্তি ঘটিয়ে শিল্পরসিক মানুষকে অভিভূত করে। ঋতু
পরিবর্তিত চিরায়ত ধারায় আষাঢ়-শ্রাবণ এই দুই মাসকে ঘিরে আমাদের বর্ষাকাল। বর্ষাকালে
আকাশ থাকে গুরুগম্ভীর কালো মেঘের ভারে নিরন্তর অবনত। সগর্জন, মেঘ বর্ষণের বিপুল দাপট চলে এই দুই মাসে। বাংলা সাহিত্যে
ষড়ঋতুর প্রভাব ও প্রতিপত্তি বহুদূর-সঞ্চারী। বলাবাহুল্য, বাংলা কবিতায় এই বর্ষাঋতুর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। বর্ষার
চরিত্র বা সৌন্দর্যের যে বহুগামী বৈচিত্রতা তা অন্য পাঁচটি ঋতু থেকে স্বতন্ত্র। এই
স্বতন্ত্র বর্ষাঋতুকে নিয়ে কবিদের কবিতায় বর্ষার রূপ বা সৌন্দর্য ধরা দিয়েছে নানান
অভিপ্রায়ে। নিম্মোক্ত আলোচনায় বর্ষার রূপবৈচিত্রতা বা সৌন্দর্যবোধ কিভাবে কবিরা
তাদের কবিতায় তুলে ধরার প্রয়াস ঘটিয়েছেন তা আলোকপাত করার চেষ্টা করবো আলোচ্য অংশে।
আমাদের বাংলা কাব্যসাহিত্যে মধ্যযুগের অনেক কবির কবিতায় বর্ষার বর্ণনার উল্লেখ
পাওয়া যায়। এদের মধ্যে কবি কালীদাস, জয়দেব এর কবিতায় বর্ষার সন্ধান মেলে। তাছাড়া কবি বড়– চন্ডিদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে, কবি বিদ্যাপতি, গোবিন্দ দাস, রায়শেখর, মনোহর দাস, বাসুদেব ঘোষ এদের প্রত্যেকের বৈষ্ণব পদাবলীতেও বর্ষার
বর্ণনা রয়েছে। যেখানে দেখা যায় যে, তারা প্রত্যেকেই রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের যে অনুরাগ সেই অনুরাগের গভীরতাকে প্রকাশ
করেছেন বর্ষার বিভিন্ন রুপবৈচিত্রের বর্ণনার মধ্যে দিয়ে। এছাড়াও মুকুন্দরাম
চক্রবর্তী, খনার বচন, ঈশ^রচন্দ্র গুপ্ত, স্বর্ণকুমারী দেবী, অক্ষয়কুমার বড়াল, প্রমথনাথ
রায়চৌধুরী প্রমুখের কবিতায় বর্ষার সন্ধান পাওয়া গেছে। এদের হাত ধরেই বাংলা কবিতায়
বর্ষার বিচিত্র রূপ বা সৌন্দর্য ওঠে এসেছিলো। এ প্রসঙ্গে, কবি কালীদাস বর্ষাকে কীভাবে অনুভব করেছেন তা দেখা যেতে
পারে। কালীদাস বর্ষাকে অনুভব করেছেন অনুরাগের গভীরতায়। কালীদাসের দৃষ্টিতে বর্ষার
সৌন্দর্য-সখা যে মেঘ, সেই মেঘকে কবি
লোভনীয় সম্ভোগের আভাস দিয়ে যক্ষের সহচর রূপে যক্ষপ্রেমিকার কাছে পাঠান। সেখানে মেঘ
সঙ্গত কারণেই প্রেমের বার্তাবহ দূত রূপে চিহ্নিত হয়। মেঘের সঙ্গে প্রেম আর বিরহের
একটা অনড় সম্বন্ধ পাতিয়ে কালীদাস তাঁর কবিতায় এক অনবদ্য চিত্রকল্প তৈরি করেছেন।
কালীদাসের কবিতার অনুবাদের কিছু অংশ বিশেষ তুলে ধরা হলো-
“কেমনে প্রিয়তমা রাখবে প্রাণ তার
অদূরে উদ্যত শ্রাবণে/ যদি- না জলধরে বাহন করে আমি পাঠাই মঙ্গলবার্তা?/ যক্ষ অতএব কুড়চি ফুল দিয়ে সাজিয়ে প্রণয়ের অর্ঘ্য/
স্বাগত-স্বভাষ জানালে মেঘবরে মোহন, প্রীতিময় বচনে। বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা ঔপন্যাসিক স্বর্ণকুমারী দেবী।
তিনিও বর্ষা নিয়ে কবিতা লিখেছেন। বর্ষার চরিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে শ্রাবণ মাসকে
দেখেছেন ঘনঘোর বর্ষণের মাস হিসেবে। তাঁর দৃষ্টিতে বর্ষা-চরিত্রের ভাবটি তিনি তুলে
ধরেছেন এভাবে- সখি, নব শ্রাবণ মাস/
জলদ-ঘনঘটা, দিবসে সাঁঝছটা/ ঝুপ ঝুপ ঝরিছে
আকাশ!/ ঝিমকি ঝম ঝম, নিনাদ মনোরম,/ মুহুমুহু দামিনী-আভাস! পবনে বহে মাতি, তুহিন-কণাভাতি/ দিকে দিকে রজত উচ্ছ্বাস। বর্ষার আরেকটি
কবিতা কবি অক্ষয়কুমার বড়ালের। তিনি কবিতায় বর্ষায় গ্রামবাংলার প্রকৃতির বর্ণনা
তুলে ধরেছেন। যেখানে কবি স্বভাবের সৌন্দর্য প্রকৃতির মতোই সহজ ও স্বতঃস্ফুর্ত।
কবিতাটির কয়েকটি লাইন- দীঘিটি গিয়াছে ভরে, সিঁড়িটি গিয়াছে ডুবে,/ কানায় কানায়
কাঁপে জল;/
বৃষ্টি-ভরে বায়ু-ভরে নুয়ে পড়ে বারে বারে/আধফোটা কুমুদ কমল।/
তীরে নারিকেল-মূলে থল-থল করে জল,/ডাহুক ডাহুকী
কূলে ডাকে;/ সারি দিয়ে মরালীরা ভাসিছে তুলিয়া
গ্রীবা,/
লুকাইছে কভু দাম-ঝাঁকে। ক্বচিত অশ্বথ-তলে ভিজিছে একটি গাভী,/ টোকা মাথে যায় কোন চাষী;/ ক্বচিত মেঘের কোলে, মুমুর্ষুর হাসি
সম,/
চমকিছে বিজলীর হাসি”।
অক্ষয়কুমার
বড়ালের বর্ষার এই কবিতাটি এক অর্থে বর্ষায় পল্লীবাংলার এক অপরূপ রূপের বর্ণনা যা
অসাধারণ। এতো গেলো মধ্যযুগের কবিতায় কবিদের বর্ষা নিয়ে ভাবনার বহিঃপ্রকাশ এর
অংশবিশেষ। এরপর বিশ^কবি
রবীন্দ্রনাথের আধুনিক সময়ের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথের
কবিতায়ও বর্ষার বিচিত্র রূপ পরিগ্রহ হতে দেখা যায়। কেননা রবীন্দ্রনাথের কাছে বর্ষা
ছিলো ষড়ঋতুর মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় ঋতু। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ মূলত বর্ষাকে নিবিড়ভাবে
উপলব্ধি করেছেন পূর্র্ববঙ্গে এসে ১৮৯১ থেকে ১৯০১ সালে পূর্ববঙ্গে জামিদারী
দেখাশোনা করার সময়। হয়তো বর্ষার মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ মানবজীবনের চিরন্তন বিরহ
-বেদনার ফল্গু অনুভব করেছেন। তাই দেখা যায় যায়, রবীন্দ্রনাথ এর কাছে বর্ষা কখনো নবযৌবনের প্রতীক, কখনো বিরহকাতর হৃদয়ের দহন-জ্বালার প্রকাশ হিসেবে ধরা
দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বর্ষাকে বিশেষ শিল্পদৃষ্টিতে উপলব্ধি করেছেন যা তাঁর ‘বর্ষামঙ্গল’ কবিতায় সেই কাব্যভাবনার প্রকাশ ওঠে এসেছে দেখা যায়। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের
হৃদয়জুড়ে বর্ষা যে একটি আসন প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছে একথা বলা যেতে পারে। কবি বর্ষার
আগমনকে পুলকিত হয়ে আনন্দের নির্যাসটুক প্রকৃতির মধ্যে ঢেলে দিয়ে বর্ষাকে অভিবাদন
করেছেন-
“এসেছে বরষা, এসেছে নবীনা বরষা,/ গগন ভরিয়া এসেছে ভুবন-ভরসা-/ দুলিছে পবন সনসন বনবীথিকা,/গীতময় তরুলতিকা”।
এছাড়াও রবীন্দ্রনাথের
মানসী কাব্যগ্রন্থে ‘বর্ষার দিনে’ শিরোনমের বর্ষা নিয়ে একটি কবিতা রয়েছে। দ্রোহ আর প্রেমের
কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রকৃতির নানান মুখি ব্যঞ্জনায় নিজেকে সন্ধান করেছেন।
কবিত্বের শিল্পসুন্দর মাধুর্য কবির কাব্যানুভূতি উৎসারিত হয়েছে। তাছাড়া নজরুল অন্যান্য কবিদের মতো তার
শিল্পচৈতন্যেও বর্ষাঋতুর প্রভাব কে উপস্থাপন করেছেন। নজরুল যে,অনন্ত বিরহের কবি, তা তাঁর বর্ষার বর্ণনার মধ্যে দিয়ে পরিস্ফূটিত হয়ে ওঠেছে। বর্ষার সম্মোহন
রূপের প্রভাবে মানব-হৃদয়ে প্রিয় সঙ্গহীনতার বেদনা ঘনীভূত হয়, সেই দিকটি তিনি তাঁর কবিতায় উপস্থাপন করেছেন। কবিতার কয়েকটি
লাইন-
“অঝোর ধারায় বর্ষা ঝরে সঘন তিমির
রাতে।/ নিদ্রা নাহি তোমার চাহি’ আমার
নয়ন-পাতে।।/ ভেজা মাটির গন্ধ সনে/ তোমার
স্মৃতি আনে মনে,/ বাদলী হাওয়ায় লুটিয়ে কাঁদে আঁধার
আঙিনাতে”।
নজরুলে
কবিতায় বুঝা যায় যে, প্রকৃত পক্ষে
বর্ষা ঋতু হচ্ছে বিরহের ঋতু। আমাদের কবিতার ভুবনে পল্লীকবি হিসেবে খ্যাত হয়ে আছেন
যিনি তিনি হলেন কবি জসিমউদ্দীন। তিনিও বর্ষা নিয়ে অনবদ্য কবিতা সৃষ্টি করেছেন।
তাঁর অনবদ্য কবিতাটি হলো ‘পল্লী-বর্ষা’। পল্লী-বর্ষা কবিতায় কবি বর্ষার অবিশ্রান্ত বর্ষণে মুখর
গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে যে আড্ডার আসার বসে, ফাঁকে ফাঁকে পল্লীবাংলার শ্রমজীবি মানুষের অসমাপ্ত কাজগুলোও যে আড্ডার ছলে
সারা হয়ে যায় এবং সাথে সাথে কিচ্ছা-কাহিনী শোনার যে লোকায়ত চিত্র তা নিয়ে তুলে
ধরেছেন উক্তে কবিতায়। কবিতাটির কিছু অংশ-
“গাঁয়ের চাষীরা মিলিয়াছে আসি
মোড়লের দলিজায়,-/ গল্পে গানে কি জাগাইতে চাহে
আজিকার দিনটায়!/ কেউ বসে বসে কাখারী চাঁচিছে, কেউ পাকাইছে রসি; কেউবা নতুন
দোয়াড়ীর গায়ে চাঁকা বাঁধে কসি কসি।/ মাঝখানে বসে গাঁয়ের বৃদ্ধ, করুণ ভাটীর সুরে/ আমির সাধুর কাহিনী কহিছে সারাটি দলিজা
জুড়ে।/ বাহিরে নাচিছে ঝর ঝর জল, গুরু গুরু মেঘ
ডাকে”।
এসবের
মাঝে রুপ-কথা যেন আর রুপ-কথা আঁকে। উক্ত কবিতাটিতে সত্যিই পল্লীবাংলার বর্ষাকালের
সময়চিত্র ওঠে এসেছে। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জসীমউদ্দীন এর পরবর্তী সময়ের কবিরা অর্থাৎ তিরিশ প্রজন্মের কবিরাও
বর্ষা নিয়ে কবিতা লিখেছেন। তাদের মধ্যে কবি জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাধ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু
এদের কবিতায় বর্ষার কথা ওঠে এসছে। প্রকৃতির যে কতো রূপ আর ঐশ্বর্য ছড়িয়ে রয়েছে তার
কোন হিসেব নেই। রূপসী বাংলার কবি খ্যাত কবি জীবনানন্দ দাশ প্রকৃতির সেই রূপের ভেতর
দিয়েই তাঁর কবিতায় বিভিন্ন ঋতুর চরিত্র অংকন করেছেন। তবে তাঁর কবিতায় ঋতুর
বৈশিষ্ট্যগুলো সরাসরি আসেনি এসেছে চিত্রকল্পের সঙ্গে বিমিশ্র হয়ে খ- খ- ভাবে যেনো
আকশে ভাসমান ছিন্ন মেঘের পালের মতো হঠাৎ কোন কবিতার পঙতিতে এসে হাজির হয়েছে। তেমনিভাবে বর্ষা নিয়েও তিনি কবিতা
লিখেছেন। তাঁর লেখা একটি বর্ষার কবিতার অংশ বিশেষ তুলে ধরা হলো-
“বাংলার শ্রাবণের বিস্মিত আকাশ/
চেয়ে রবে;
ভিজে পেঁচা শান্ত স্নিগ্ধ চোখ মেলে কদমের বনে/ শোনাবে
লক্ষীর গল্প-ভাসানের গান নদী শোনাবে নির্জনে”।
বাংলার
ঋতু পর্যায়ে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত কাব্যজগতের অন্যতম অংশীদার সন্দেহ নেই। ষড়ঋতুর
বিচিত্র বিকাশকে তিনি রুপ দিয়েছেন গতানুগতিক কোন ঋতু-বন্দনার ধারায় নয়, দিয়েছেন নিজস্ব শিল্পকৌশল আর দার্শনিক ভাবনার মধ্যে দিয়ে
এবং জীবনের কোন বিরুদ্ধ অনুষঙ্গের মুখোমুখির কারণে তিনি ব্যবহার করেছেন
ঋতু-বৈচিত্রতাকে। বর্ষা নিয়েও তার কবিতা রয়েছে। বর্ষা নিয়ে তার কবিতার মধ্যে
উল্লেখযোগ্য হলো- ‘বর্ষার দিনে’ এবং ‘শ্রাবণবন্যা’ কবিতা দুটি। ‘শ্রাবণবন্যা’ কবিতাটির কয়েকটি
লাইন কবির শিল্পশৈলীর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা যেতে পারে-
“সংকীর্ণ দিগন্তচক্র, অবলুপ্ত নিকট গগনে/ পরিব্যাপ্ত পাংশুল সমতা;/ অবিশ্রান্ত অবিরল বক্র ধারা ঝরিছে সঘনে;/ হাঁকে বজ্র বিস্মৃত মমতা;/ প্লাবিত পথের পাশে আনত বঙ্কিম তরুবীথি/ শিহরিছে প্রমত্ত ঝঞ্চায়;/কাল আজি সংজ্ঞাহারা; নিমজ্জিত প্রহরের বৃতি;/ ভেদ নাই ঊষায়
সন্ধ্যায়। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সমসাময়িক আরেক কবি অমিয় চক্রবর্তী তিনিও বর্ষার
বৃষ্টি বিধৌত প্রকৃতির তরঙ্গ-হিল্লোলিত স্বভাবের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বর্ষা নিয়ে
কবিতা লিখেছেন। বর্ষা নিয়ে অমিয় চক্রবর্তীর একটি কবিতা- অন্ধকার মধ্যদিনে বৃষ্টি
ঝরে মনের মাটিতে।/ ধানের খেতের কাঁচা মাটি, গ্রামের বুকের কাঁচা বাটে,/ বৃষ্টি ঝরে
মধ্যদিনে অবিরল বর্ষাধারাজলে।/ যাই ভিজে ঘাসে ঘাসে বাগানের নিবিড় পল্লবে/ স্তম্ভিত
দীঘির জলে, স্তরে স্তরে,আকাশে মাটিতে।/ অন্ধকার বর্ষাদিনে ঝরে জলের নির্ঝরে”।
অমিয়
চক্রবর্তীর কবিতাটিতে বর্ষাদিনে বৃষ্টির যে মিষ্টিমধুর সৌন্দর্য তা উপমায়িত হয়ে
ওঠে এসেছে কবিতাটির বর্ণনার মধ্যে দিয়ে তা অনুভব করা যায়। ত্রিরিশের আধুনিক কবিদের
মধ্যে আধুনিক শিল্পভাবনার অন্যতম বিশিষ্ট কবি বুদ্ধদেব বসু। ষড়ঋতু নিয়ে বুদ্ধদেব
বসু ব্যাপক কবিতা লিখেছেন। এর মধ্যে বর্ষা নিয়েও তিনি প্রচুর কবিতা লিখেছেন। বর্ষা
নিয়ে তিনি বাংলাদেশ এবং কোলকাতার বর্ষার রূপবৈচিত্রতার নির্মম বাস্তবতা নিয়ে
বর্ষাকালীন অবস্থার চিত্রপট তুলে ধরেছেন তার কবিতায়। এছাড়াও তিনি বর্ষায় একটানা যে
বৃষ্টিপাত হয় মর্তভূমে যখন ধূসরতা নামে, ভিজে হাওয়ার ঠান্ড পরিবেশ তৈরী হয় এবং ব্যাঙের যে অবিরাম ডাক শুরু হয় সেই ডাক
ব্যতিক্রমী ধারায় বর্ষার চরিত্রের মধ্যে দিয়ে বুদ্ধদেব বসু চমৎকার ভাবে তার কবিতায় তুলে
ধরেছেন। এমনই একটি কবিতার কিছু অংশ বিশেষ তুলে ধরা হলো-
“বর্ষায় ব্যাঙের ফুর্তি। বৃষ্টি
শেষ,
আকাশ নির্বাক;/ উচ্চকিত ঐক্যতানে শোনা গেলো ব্যাঙেদের ডাক।/ একটি অক্লান্ত সুর; নিগুঢ় মন্ত্রের শেষ শ্লোক-/ নি:সঙ্গ ব্যাঙের কণ্ঠে উৎসারিত- ক্রোক, ক্রোক, ক্রোক”।
পরবর্তীতে
বিভিন্ন দশকের বিভিন্ন কবিগণ বর্ষা নিয়ে অজস্র কবিতা লিখেছেন।
তারই ধারাবাহিকতায় বেশ কয়েকজন কবির কবিতায় বর্ষা নিয়ে কবিতার সন্ধান মেলে। এদের
মধ্যে কবি রফিক আজাদ তার বর্ষা নিয়ে কবিতা ‘ময়ূর আনন্দে মাতো’ কবিতাটিতে
বর্ষার আহব্বান করেছেন। যেখানে দেখা যায় মানুষের মেধায় মননে প্রকৃতির ন্যায় বর্ষার
রূপ পূণ্যতা দিতে বর্ষার অপার যে আনন্দ সেই আনন্দের দিকে দৃষ্টিপাত করেছেন। তাছাড়া
প্রতিটি ঋতুই মাঙ্গলিক বা কল্যাণময়। বর্ষাকালের বৃষ্টির কল্যাণে ভূমি ঊর্বর হয়ে
ওঠে। কৃষি ভুমি ঊর্বর হয়ে ওঠার ফলে ফসলাদী ভালো হয় যার কারণেই আমাদের মতো কৃষি
নির্ভর দেশের বর্ষাকে কল্যাণময় হিসেবে দেখেছেন কবি রফিক আজাদ। নিচে তার উক্ত
কবিতাটির কয়েকটি লাইন উল্লেখ্য করা হলো-
“বর্ষায় বর্ষণ চাই
মননে-মেধায়/শস্যের প্রান্তরে আর প্রতি ঘরে ঘরে, জীবনে-জীবন চাই যুগলে-যুগলে/ বর্ষার ধারাপাত অপার বর্ষণে এই মাঙ্গলিক
ময়ূর-আনন্দে/ মাতো কৃষিসভ্যতার সকল সন্তান”।
এছাড়াও
কবি রফিক আজাদ তার ‘সোনার নূপুর
বেজে যায়’
কবিতাটিতে বর্ষার বর্ণনা করেছেন। কবি নির্মলেন্দু গুণ।
তিনিও ‘বর্ষার সঙ্গে আমার সম্পর্ক’ কবিতার মধ্যে দিয়ে বর্ষার সাথে তার এক মধুর সম্পর্কের বয়ান উল্লেখ করেছেন যা
অভিনব। বর্ষাকে সে ঋতুদের মধ্যে বর্ষারাণী বলে আখ্যায়িত করেছেন। বর্ষাকে সে জীবনের
নতুন যৌবন আর প্রকৃতির ভিতর দিয়ে তেমনি ভাবে সে বর্ষাকে সে তার জীবনের যৌবনসঙ্গী
হিসেবে দেখার প্রয়াস ঘটিয়েছেন। তাই তিনি অনায়াসে উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন-
“ভাগ্য ভালো, মনুষ্য-বিবাহপ্রথা বর্ষা জানে না।/ সে ভালোবাসে উন্মুক্ত
বিহার,
গগনে গরজে, তবে সিঁধুরে
মেঘের প্রতি তার টান আছে, তাই/ আমি তাকে
পরিয়েছি বজ্রচেরা মেঘের সিঁধুর”।
নির্মলেন্দু
গুণের এই লাইনগুলোর মধ্যে থেকেই বোঝা যায় বর্ষার সাথে তার ভাবের জায়গাটি কতো
উচ্চতর ও মধুর। কবি মহাদেব সাহা তিনিও বর্ষা নিয়ে বেশকয়েকটি কবিতা লিখেছেন। তার
কাছে তো বর্ষা হচ্ছে জীবনের প্রথম আনন্দ। তিনি বর্ষাকে তার জন্মঋতু হিসেবে কবিতায়
আখ্যায়িত করেছেন। তাই তিনি বর্ষাকে কিভাবে জীবনে উপলদ্ধি করেছেন সেটিও তিনি তার
বর্ষা নিয়ে লেখা ‘বর্ষা’ কবিতাটিতে তুলে ধরেছেন-
“বর্ষা হচ্ছে জীবনের প্রথম আনন্দ, আজো আমি/ বর্ষায় উন্মাদ/ আজো আমি বর্ষামত্ত ঘোরলাগা পল্লীর
বালক/ বর্ষায় আবার আমি ফিরে পাই ত্বক ও জিহ্বার স্বাদ”।
কবি
মহাদেব সাহার বর্ষা নিয়ে কয়েকটি কবিতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বৃষ্টির দিনে, আমার জন্মঋতু, এই যে বর্ষার নদী ইত্যাদি। এভাবেই পূর্ববর্তী কবিদের ধারাবাহিকতায় এখনো চলছে
বর্ষার বিভিন্ন অনুসঙ্গ নিয়ে কবিদের কবিতা লেখা। এখনো প্রতি বর্ষাঋতু এলেই বিভিন্ন
ছোট কাগজ বা দৈনিক পত্রিকার সাময়িকীগুলোতে বর্ষা নিয়ে আয়োজন করা হয় বর্ষা নিয়ে
কবিদের কবিতার প্রকাশ। এভাবেই হয়তো যুগে যুগে প্রকৃতির এই ঋতুরাণী-বর্ষাকে নিয়ে কবিদের
ভাবের সীমা অসীম হয়ে ওঠবে। কবিতার রাজ্যে বর্ষার কবিতাও তার সৌন্দর্যে ফুটে ওঠবে।
প্রকৃতির মতো করে বর্ষাও বারে বারে নতুন যৌবন পাবে কবিদের হাত ধরে কবিতার এই
নান্দনিক সৌন্দর্যে এই হোক বর্ষাঋতুর প্রতি মনোমুগ্ধকর প্রত্যাশা।
No comments:
Post a Comment