কাচের প্লেটের
টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে পাশের বাসা থেকে। প্রতিদিন দেয়াল ঘড়িতে রাত বারোটা বাজলেই টুংটাং
শুরু হয়। রাতের খাবার খাওয়ার এটাই সঠিক সময় কিনা-তা বুঝে উঠতে পারে না বাদল। তিন বছর
ধরে পাঁচ তলার ফ্ল্যাটের দ্বিতীয় তলার পূর্ব পাশের রুমটি ভাড়া নিয়ে থাকছে সে। ইচ্ছে
করেই বাড়তি একজন রুমমেট নেয়নি। অবিশ্যি শুরুর দুই মাস একজন রুমমেট ছিল নোয়াখালীর। রুমমেটের
নাম তার মনে নেই। রাতের অবসরে রুমমেটের নাম মনে করার চেষ্টা করে,
কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ে না। একটা মানুষের নাম মনে করতে না পারায়
বেশ হতাশ হয়ে পড়ে সে। এদিকে পাশের বাসায় কাচের প্লেটের টুংটাং শব্দও তাকে বেশ অস্থির
করে তুলছে। শুধু কি টুংটাং-ওই বাসার অল্প বয়সী কাজের মেয়ের ঢং করে কথা বলা-‘জ্বী আম্মা, একটু অপেক্ষা করুন, পিলিজ। ওদের পিচ্চি ছেলেটার চিৎকার চেঁচামেচি, তার উপর হাই ভলিউমে টেলিভিশনে জীবন মানে জি বাংলার গুণগান প্রচার। হাঁট বাজারের
সাথে তুলনা চলে বাসাটির। একটা কথা বাদল কিছুতেই ভেবে পায় না-মাঝ রাতে ঘুম বাদ দিয়ে
খাওয়ার কি দরকার? এতক্ষণে ঘুমের প্রথম
পর্ব শেষ হয়ে দ্বিতীয় পর্ব শুরু হওয়ার কথা, নাকি আমার মতো ওদেরও ঘুমের সমস্যা।
বাদলদের দুই
রুমে দশটার মধ্যে রাতের খাওয়ার পর্ব সেরে ফেলে। পাশের রুমমেটরা রাতের খাবার খাওয়ার
পর নিয়ম করে তাসের আসরে বসে। সাথে চলে বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকানো। তাসের
অভ্যাস বাদলের নেই, তবে বিড়ির নেশা ছিল
ভয়ংকর রকমের। ভয়ংকর নেশাটাকে কোনো রকম কসরত ছাড়াই কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। এই ক্ষেত্রে
বীর আলেকজেন্ডার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। সে নিজেও এমনটি ভাবে-‘আমার মতো কেউ সিগারেট ছাড়–ক দেখি!’ তার রুমমেটরা তাসের
আসরে বসার জন্য তাকে ডাকত, কিন্তু বাদলের সাড়া না পেয়ে রণে ভঙ্গ দিয়েছে। তাসের আসরে যোগ না দেওয়ায় বাঁকা কথা
শোনাতে ছাড়েনি রুমমেটরা-‘বাদল ভাই কি বাসর রাইতে ভাবির মাথায় হাত দিয়া কিরা কসম খাইছেননি?’
রুমমেটদের কথায় তাজ্জব বনে গিয়ে মিনমিন করে উঠে-‘কী যে বলেন না! খুব বুঝি বাংলা সিনেমা দেখেন!’
কোনো পক্ষই কথার সঠিক জবাব না পেয়ে হাসির ভেলায় ভেসে যায়।
পাশের রুমে
রাত দশটার পরে যখন শাদা আলো জ্বেলে টেক্কার চাল চলে, তখন বাদলের রুমে একটা জিরো পাওয়ারের ভায়োল্টে বাল্ব জ্বলে উঠে।
টান টান হয়ে মাথার বালিশে নিজেকে সঁপে দেয়। তারপর এক দৃষ্টিতে জিরো বাল্বটির দিকে তাকিয়ে
থাকে। চোখের পলক পড়ে সময় নিয়ে। আবারো চোখের পলক না ফেলে বেগুণী আলোর দিকে তাকিয়ে থাকা।
একবার নয়, দুইবার নয়,
একটানা রাত বারোটা অবধি এই অদ্ভুত খেলা খেলে চলে সে। এসময় বাদলের
মনে পড়ে বিহারী মেয়ে কেয়ার কথা। কেয়ার গাল দুটো বেশ পাকাপোক্ত দেখতে,
মানে ফোলা ফোলা ছিল। দুষ্টুমির ছলে একবার বাদল কেয়াকে বলেছিল-‘এই কেয়া, তোর গাল দুটো এমন ফুলেছে কি করে রে?
সত্যি করে বলতো- তোর গাল কে টিপে দিয়েছে?’
বাদলের কথা শুনে কেয়া বেশ ক্ষেপে যায়। তারপর বাসায় গিয়ে মাকে
বলে দেয়ার হুমকি। আতঙ্কে কয়েকটা দিন কেটেছে। কিন্তু পরে এই নিয়ে আর কিছু হয়নি।
ক্লাসের ফাঁকে
কেয়া আর বাদল চোখের খেলাটি খেলত। চোখের পলক না ফেলে দু’জনের চোখের দিকে কে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে। প্রতিবারই বাদল
কেয়ার পলক না ফেলা চোখের কাছে হেরে যেত। কেয়াকে হারানোর নেশায় নয়,
বরং কেয়ার গভীর চোখে চোখ রাখতে পারার লোভেই বাদল কেয়াকে বলত-‘দেখিস এবার তোর আগে পলক পড়বে। চোখের দিকে তাকিয়ে থাকার নেশায় সে
বয়সে কিভাবে পড়েছিল, আজও তা বাদল বুঝে
উঠতে পারেনি। এখন বেগুনি আলো দেয়া জিরো বাল্বটিকে হারানোর নেশা চেপে বসেছে। মনে মনে
হিসাব রাখতে ভুলে যায়-চোখের পলক না ফেলা খেলার। ঠিক এই সময় বাদল আর বেগুনি আলোর জিরো
বাল্বটির মাঝে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে আর্বিভাব হয় একটি আধ লেজওয়ালা টিকটিকির।
টিকটিকির
আগমনে বাদলের খেলায় বিরতি পরে। বিরতি ঠিক নয়, বলা চলে নতুন করে শুরু হয় বাদল আর টিকটিকির মধ্যকার আলাপ-পরিচয়।
বেগুণী আলোর বাতিটিকে ছেড়ে টিকটিকির পানে মনোযোগ দেয় সে। পূর্ণ আগ্রহের দৃষ্টি নিয়ে
টিকটিকির পানে তাকিয়ে থাকার খেলায় মেতে ওঠে।
দেয়াল ঘড়ির
অববয় চোখের তারায় দেখা গেলেও ঘণ্টার কাটাটি এখন ঠিক কোথায় অবস্থান করছে বুঝে উঠতে পারে
না। বালিশের তল থেকে পুরনো সস্তা হাত ফোনটি বের করে। মোবাইলের বাটনে চাপ দেয়,
কিন্তু আলো জ্বলে না। ভুলে যায়-রাত দশটা বাজলেই মোবাইলের সুইচ
অফ করে রাখে সে। বাধ্য হয়ে মোবাইলের সুইচ অন করে। টেক্সট টোন বেজে উঠল,
নিশ্চয় মোবাইল কোম্পানীর নতুন কোনো অফার। রাত এক’টা পেরিয়েছে অনেক আগে। পাশের বাসার টুংটাং শব্দ মিলিয়েছে,
জানালার আলো মুছে গিয়ে অন্ধকার স্থায়ী হয়েছে। পরিবারটিও ঘুমের
দেশের বাসিন্দা হয়েছে, শুধু বাদল জেগে আছে,
জেগে আছে ঘুণপোকা।
বাদল ছোটবেলা
থেকেই টিকটিকি ভয় পায়। ছবি দেখলেও গায়ের ভেতর কেমন সুড়সুড় করে ওঠে। পেট গুলিয়ে উঠা
একটা ভাব গলার কাছে চলে আসে। অথচ আজ টিকটিকি দেখে বাদলের ভেতর পূর্বের ভাবান্তর হলো
না। টিকটিকির ওপর থেকে একবারের জন্যও চোখ ফেরাচ্ছে না সে। টিকটিকির চলাফেরার দিকে লক্ষ্য
রাখছে, যেন কেউ তাকে এই
কাজে নিয়োগ দিয়েছে। ফাঁকি দেয়া চলবে না, শেষে না জবাব দিহি করতে হয়। হঠাৎ করে বাদল তার শরীরের উপরের অংশ বিছানা থেকে তুলে আবার নামিয়ে
ফেলল, কি কারণে বুঝা গেল
না। আবারো স্থির হয়ে পড়ে রইল বিছানায়, কিন্তু দৃষ্টি তার টিকটিকির দিকে। ঠিক তখনই ন্যানো সাইজের একটি রাত পোকার আগমন
লাইটের পাশে। টিকটিকির অর্ধেক লেজটিতে সাপের দুলুনি শুরু হলো। রাতের খাবার মুখের সামনে
এসে পড়লে কে না খুশি হয়? গুটি পায়ে একবার সামনে গেল অর্ধ লেজের অধিকারী। এবার ক্ষুদ্র পোকাটির কাছাকাছি
চলে গেল। নিবিড় পর্যবেক্ষণ, উপযুক্ত শিকার কি না তাই হয়তো ভাবছে। আবার একটু পেছনে সরে এলো টিকটিকিটি। এদিকে
বেশ অধৈর্য হয়ে পড়ছে বাদল। মনে মনে গালি দিচ্ছে-‘টিকটিকির বাচ্চার মতিগতি তো বুঝতে পারছি না,
কি করতে চাইছে। খাবি তো খা, অতো নাটক করছিস কেন?’ বাদলের গালি শুনে, না হয় বাদলকে খুশি করতে, ঠিক সেসময়ই খপ্ করে পোকাটিকে মুখে পুড়ে নিল। একবার মাথা তুলে ঢোক গিলল টিকটিকিটি।
তারপর কিছু সময় স্থির হয়ে রইল। বাদলের মনে হচ্ছে, টিকটিকি তার দিকে ক্ষিপ্ত ষাঁড়ের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। চোখের
ভাষায় বলছে, ‘কী হে রাতের বন্ধু,
এবার খুশি তো?’ বাদলের মুখে স্মিত হাসি ফুটে উঠল।
মিনিট দুই
পরে হেলেদুলে আরেকটি টিকটিকির আগমন রাতের নিশ্চুপ দেয়ালে। বাদল আবারো দেয়ালের বুকে
দৃষ্টি ফেরাল। অদ্ভুত এক রাত পার করছে বাদল। গতকালের চেয়ে আজকের রাতটা তার কাছে বেশ
আনন্দদায়ক বলে মনে হচ্ছে। গতকাল তার সঙ্গী ছিল বেগুনী আলোর বাতিটি। আজ সঙ্গীর সংখ্যা
বেড়েছে। বেগুনী আলোর বাতি, একটি রাত পোকা, একটি অর্ধেক লেজবিশিষ্ট
টিকটিকি ও তার প্রেমিকা। এদের নিয়ে বাদল বেশ মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছে আজকের রাতটা।
লেজ না-হারানো
টিকটিকিটি ঘুরে অর্ধেক লেজওয়ালার দিকে ফিরল। মুখোমুখি ওরা দু’জন। দু’জনের নিঃশ্বাসের
শব্দ শুনতে পাচ্ছে। দুজনকে একসাথে আগে কখনো দেখেনি বাদল। নাকি ওরা পূর্ব পরিচিত,
ঠিক বুঝে উঠতে পারে না সে।
ঠিক এই মুহূর্তে
বাদল যে দৃশ্যটি দেখছে, ইতিপূর্বে যা দেখেনি। সেকারণে ভেতরে ভেতরে আগ্রহী হয়ে উঠল। বিছানা থেকে উঠে সোজা
হয়ে হাঁটু গেড়ে দেয়ালের পাশে চলে এলো। ঘাড় বাঁকিয়ে তাকিয়ে রইল টিকটিকি যুগলের দিকে।
বাদল এবার নিশ্চিত হয়েছে, ওরা যুগলই হবে। যুগলের মেলামেশা দেখে বাদলের মনে আরেকটি প্রশ্ন জাগে,
রাতই কি মিলনের উপযুক্ত সময়? প্রশ্নটি মনের ভেতর আসতেই বাদল রাতের নিস্তবদ্ধতা ভেঙ্গে মুখ
ফুটে বলে ফেলে, ‘ধ্যাত!’
জীবনে প্রথমবারের
মতো বাদলের মনে হলো, দেয়ালে থাকা ওই অর্ধেক
লেজ হারানো টিকটিকির কাছেও সে কতো অসহায়! টিকটিকিটির যে বিশেষ ক্ষমতাটি আছে,
মানুষ হয়েও সে ক্ষমতাটি তার নেই।
No comments:
Post a Comment