পেছন ফিরে তাকানোর ইচ্ছে
সে একটা দিন গেছে বটে। আরে হ্যাঁ, বিয়ের পরের বেশ কিছু বছরের কথা বলছি। নববিবাহিত স্ত্রীকে যেন চোখে হারাতাম। এতে লজ্জা পাবার কী আছে শুনি? প্রত্যেক বিবাহিত পুরুষের ক্ষেত্রেই এমনটা
দেখা যায়। সেই দশা কারও থাকে বছর দুয়েক তো কারো থাকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। আমার বেলায়
অবশ্য বছর তিনেকের মধ্যেই কেটে গেল সেই দশা। স্ত্রীর কাছে ততদিনে আমি হয়ে যে গেছি পর। আপন হয়েছে সদ্যজাত
পুত্রটি। অগত্যা অফিস-কাছারি নিয়ে মেতে থাকতে হলো প্রেমে মাখামাখি হয়ে থাকার কথা ভুলে। তবুও প্রথমদিকে দিনে বার দশেক স্ত্রীর নাম ধরে
আদর করে হাঁকডাক দিতাম। স্ত্রীও আদুরে গলায় মুখ ঝামটা দিতেন। সেটাও যে ভালবাসা প্রকাশের নামান্তর মাত্র তা বুঝতে অসুবিধা
হতো না। বেশ উপভোগ করতাম।
এরপর
কন্যাসন্তানটি এলো স্ত্রীর কোল আলো করে। পুত্রটি ততদিনে বছর পাঁচেক কাটিয়ে ফেলেছে এই সুন্দর ভূবনে। কন্যাসন্তানটি আসার পর পুত্র সন্তানটি কিছুটা
হলেও পর হয়ে গেল তার মায়ের কাছে। আর আমি হয়ে গেলাম একেবারে দূরের মানুষ। যেন ভিনগ্রহ থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছি এই সংসারে! স্ত্রীকে আদর
করে হাঁকডাক করাটাও অনেকটা কমে এসেছে। তেমন সুযোগ পাই দিনে
মাত্র বার পাঁচেকের মতো। সকালের চা-টা পাবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকে প্রথম আদুরে ডাকটা বেরিয়ে আসে মুখ থেকে। পরের ডাকটা
অফিসে যাবার সময়। পরেরটা অফিস থেকে ফিরে এসে। তারপর কিছু একটা বস্তু খুঁজে না পেয়ে। এবং শেষেরটা
ঘুমিয়ে পড়ার আগে।
এভাবেই
বেশ কেটে যাচ্ছিলো দিনগুলো। পুত্র যেবার মাধ্যমিক দিলো সেবার থেকে স্ত্রীকে আদর করে
ডাকার বহরটা আরও খানিকটা খাটো হয়ে গেল। দিনে মাত্র দু-বার। প্রথমবার অফিসে যাবার সময় এবং দ্বিতীয়বার অফিস থেকে ফিরে
আসার পর। মাঝখানে ডাকার মতো সুযোগ বা পরিস্থিতি কোনোটাই যে ছিলো না। স্ত্রী দিনরাত
ব্যস্ত থাকেন নিজের কাজে। ছেলেমেয়েদুটির দিকেই সবসময় নজর। আমার দিকে তাকানোর ফুরসৎ কোথায়? সকালের চা-টা বিছানার পাশের ছোট্ট টেবিলটার ওপর ঠক্ করে নামিয়ে রেখে জলদগম্ভীর গলায় ‘উঠে পড়ো, অফিসের দেরী হয়ে যাবে’ কিম্বা ‘বাজারে যেতে হবে’ ইত্যাদি বলেই চলে যান নিজের কাজে। তাঁকে আদর করে ডাকার সুযোগ আর পাই না।
পুত্রটি
দু’বছর হলো ইঞ্জিনিয়ার হয়ে
ঢুকেছে একটি বহুজাতিক সংস্থায়। কন্যাটিও অনেকগুলো বছর কাটিয়ে দিয়েছে এই পৃথিবীতে। গ্রাজুয়েট হয়ে
লেখাপড়ায় ইতি টেনেছে। স্ত্রীর চাপে পড়ে সুপাত্র দেখে চারহাত এক করে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বসতে না
বসতেই আবার স্ত্রীর চাপে পড়ে গেলাম। এবার পুত্রের বিবাহ দিয়ে ঘরে লক্ষ্মী নিয়ে আসার চাপ। অগত্যা কোমড়
বেঁধে নেমে পড়তে হলো সুপাত্রীর সন্ধানে। মাস তিনেকের মধ্যে পেয়েও গেলাম একটি সর্বসুলক্ষণা পাত্রী। পাজী দেখে
দিনক্ষণ স্থির করে দিলাম চারহাত এক করে। আত্মীয়স্বজনে পরিপূর্ণ হয়ে থেকে কেটে গেল ক’টি দিন।
আজ
রাত্রে পুত্র তার নববিবাহত স্ত্রীকে আদুরে গলায় ডেকে নিয়ে ঘরের দোর দিলো। কন্যাও তার স্বামীকে বগলদাবা করে ঘরে সেঁধিয়ে গেল। সেসব দেখেই বুকের ভেতর সুপ্ত থাকা সেই পুরনো দিনগুলো নড়েচড়ে বসলো। অনেক অনেক বছর
পর আজ আবার বিবাহিত জীবনের সেই প্রথম দিনগুলোর মতো করে আদুরে গলায় স্ত্রীকে ডাকলাম। আজ অবশ্য গলা
ছেড়ে নয় বেশ চাপা গলাতেই ডাকলাম তাঁকে। স্ত্রী সুখের পান চিবোতে চিবোতে এসে দাঁড়ালেন সামনে। আজ কিন্তু মুখ ঝামটা
দিলেন না আগের মত করে। শুধু নির্লিপ্ত গলায় বললেন, বলো।
-
একবার কাছে এসো তো?
-
কেন?
-
আজ খুব প্রেম করতে ইচ্ছে করছে গো।
-
ওমা গো মা, আজ আবার
বুড়োর হলো কি? কোন খেল দেখাতে চাইছো তুমি?
-
খেল দেখাবো কেন? এক-আধ দিন কি ইচ্ছে করে না পেছন ফিরে তাকাতে?
বিষের ছোবল
রমাপদ দোকান বন্ধ করে দুপুরের স্নান
খাওয়া সারতে এলো। ঘরে ঢুকে শ্যালক বিশুকে শুয়ে
থাকতে দেখে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলো, বিশু খেয়েছে তো? নাকি
খাওয়া দাওয়া না করেই ঘুমিয়ে পড়েছে?
স্ত্রী দুলালী ব্যাজার মুখে জবাব দিলো, এই তো খেয়ে উঠলো। কেন?
রমাপদ কথা না বাড়িয়ে স্নান করতে চলে গেল মাথায় তেল মাখতে মাখতে। দোকানে আজ বিক্রীবাট্টা বেশ ভালো হয়েছে বলে মনটা ফুরফুরে
হয়ে আছে। সেই ফুরফুরে মেজাজেই স্নান সেরে এসে খেতে বসলো। সবে একগ্রাস ডালভাত মুখে তুলতে যাবে দুলালী ঝপ্ করে বলে বসলো, বেচারা বিশুটাকে আজকাল বেজায় অপমান সইতে
যে হচ্ছে তা কখনো খেয়াল করেছো?
হাতে ধরে
থাকা ভাতের গ্রাসটা আর রমাপদর মুখ পর্যন্ত পৌঁছুলো না। সে
খাওয়া থামিয়ে অবাক গলায় শুধোলো, কে ওকে অপমান করলো শুনি? কার এতো সাহস যে আমার
শ্যালককে অপমান করে?
দুলালী জবাব না
দিয়ে চুপ করে থাকলো। চুপ করে থাকবে না? যেমনটা চাইছিলো ঘটনাটা সেদিকেই যে এগোচ্ছে। তাই রমাপদর ভেতর সদ্য মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা রাগটাকে আরও উঁচু পরদায় নিয়ে যাবার ইচ্ছেতেই মুখ টিপে
থাকলো।
জবাব না পেয়ে রমাপদর মাথার
ভেতরটায় আগুন জ্বলে উঠলো দাউদাউ করে। ভাতের থালাটা একপাশে ঠেলে সরিয়ে এখে গলা সপ্তমে চড়িয়ে দিলো, কি হলো? বিশুকে কে অপমান করেছে
বললে না তো?
দুলালী তার রাগের আগুনে আরও খানিকটা ইন্ধন জোগাতে চেয়ে বাঁকা কথায় জবাব দিলো, সেসব জেনে কি করবে শুনি? তোমার তেমন মুরোদ আছে নাকি যে অপমানের বদলা নেবে? বরং খেয়ে
দেয়ে বিশ্রাম করো গিয়ে। বিকেলে আবার দোকান খুলে বসতে যে হবে তোমাকে।
রমাপর ভাত খাওয়া মাথায় উঠেছে। যতক্ষণ না জানতে না পারছে বিশুকে অপমন করেছে কে ততক্ষণ এতটুকুও শান্তি যে পাচ্ছে না। তার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে যেতেই
গলা আরও চড়িয়ে
দিলো, অত ধানাইপানাই না করে আসল ঘটনাটা
খুলে বলবে কি?
দুলালী যখন
বুঝলো স্বামীর রাগ গিয়ে
ঠেকেছে চরম সীমানায় তখন ঠান্ডা গলায় জবাব দিলো, আবার কে? তোমার
মা। তিনিই দিনরাত বিশুকে অপমান করে চলেছেন। আর আজ তো মাত্রা ছাড়িয়ে
গেছেন। বিশুর দোষ বলতে তোমার
সেই দলিলটায় একটা টিপছাপ দিতে অনুরোধ
করেছিলো। জবাবে তিনি বিশুকে একপ্রকার গলা ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিয়েছেন। এতটা অপমান কি সহ্য করা যায় কখনো? বেচারা
বিশু লজ্জা ঘেন্নায় সারাটা সকাল গুম মেরে পড়ে ছিলো ঘরের এক কোণে। আজই চলে যেতে
চেয়েছিলো বাড়িতে। অনেক বলে কয়ে তাকে ঠাণ্ডা করে তবেই দুপুরের স্নান খাওয়া করাতে
পেরেছি।
মা অপমান করেছেন শুনেই রমাপদ ঝপ্ করে দমে গেল। তাই কথা না বাড়িয়ে একগ্রাস ভাত মুখ
তুলতে যেতেই দুলালী নিজের
বুকের মধ্যে জমিয়ে রাখা সমস্ত বিষ জিভের গোড়ায় টেনে নামালো, কি হলো? মায়ের নাম শুনেই সব বীরত্ব উধাও যে হয়ে গেল? অত লম্ফজম্ফ বৃথা যে গেল! ছি-ছি-ছি, এমন বীরপপুরুষের সাথে ঘর করছি! এই লজ্জা ঢাকতে হলে তোমার যে আত্মহত্যা করা উচিৎ।
দুলালীর এই
কথাতেই রমাপদর মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো দ্বিগুণ বেগে। এমন জ্বলন্ত দৃষ্টিতে দুলালীর দিকে তাকালো যে দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুনি ঝলসে দেবে চোখের আগুনে। সেভাবে
তাকিয়ে থেকেই রাগে গরগর করে
উঠলো, আমাকে নিয়ে অত ভাবতে হবে না
তোমাকে।
দুলালী আর একটা কথাও বললো না। বেশ বুঝতে পারছে যতটুকু আগুন ধরাতে চেয়েছিলো তারচেয়ে শতগুন বেশী আগুন ধরিয়ে দিতে পেরেছে স্বামীর মাথায়।
এটাও জানে যে, এই আগুনেই রমাপদ নিজে
জ্বলেপুড়ে খাঁক হয়ে যাবার আগে শাশুড়িকেও জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেবে।
দুলালী জায়গায় বসে মুখ টিপে
হাসতে হাসতেই দেখলো রমাপদ নামমাত্র কিছু মুখে দিয়েই সোজা হাঁটা দিলো মায়ের ঘরের
দিকে।
No comments:
Post a Comment