ফুলচিঠি
একখানিপথ এসে পড়ে আছে পায়ের কাছে। পথের নাম নীলতোয়া
হাওয়া। হাওয়ার শরীরে ধূলিগন্ধ ইতিহাস। আমাদের ইতিহাস ঢাকা পড়ে আছে। পুরনো চাদর
ভাঁজ করা আছে। কার্পেটের নকশায় পতঙ্গ বিলাস। আমার চুলে নিমিঝিমি কাশ। কাশবনে
শাদাপথের গল্প। এইপথ এসে অন্ধ হয়েছে ধ্যানে। আমাদের হাত ধরে সে ঝড়ের হবে। আমরা
আমাদের খোঁজে মুগ্ধ আর অধীর। আমরা আমাদের খোঁজে ভেঙে যাবো সকল ভিড়। এইভাবে
অনেকদিন লিখেটিকে শেষ করি অ্যামিবার কাল। যা হলো—বোতল আর তৃষ্ণা অসুখ।
যা হলো—দুধ আর শাদা টলোমলো স্তূপ। উপত্যকার ফাঁদে ডুবে
গেলো ঘ্রাণের বিবর। দুহাতে চোখ নিয়ে দৃশ্য খুঁড়ে যাই, দৃশ্য
খুঁড়ে যাই। খাদের একটু পরেই নীল প্রতীক্ষা দোলে আনত অভিমানে। ফেনায়িত শামুকের গতি
হয়েছে বাচাল। শামুক, কাছিম আর কেঁচোর মিছিল আছে, অ্যামিবার একটু কাছে। তার পাশে শুয়ে আছে অজানিত গহ্বর। গহ্বরে কেউ আছে।
ভাবছো, উড়ে যাচ্ছি! কাকের শাদা পালকে জেগে আছে আমাদের
অভিলাষ। তুমি থার্মোমিটারের ভিতর পারদের বন্দীত্ব দেখে ভেবো না তাকে ছোঁয়া যায়।
অচেনা উত্থানে ভেসে গেছে নির্জলা আধার। আর তুমি দীর্ঘশ্বাসে দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছো
আমার চোখের বিবর। বিবরে কেউ নেই, কেউ নেই—আছে শুধু নিঃশ্বাস—বিবরে একা আছে তোমাদের
বসবাস। নিজেকে একটা শাদাকাক ভেবে আমি মনে মনে সুর করে বলি, কাকপাখি সুন্দর, কাকপাখি সুন্দর। মাঘরাতে জাগে
ফুল, লিখে চিঠি বাতাসের। কাকপাখি ওড়ে এসে নেমে পড়ে
এলোচুলে। কাকপাখি সুন্দর, বাতাসের উত্তর। ফুলচিঠি ফুল
হাতে প্রিসলিন উড়ে যায়, কাকপাখি তাহাদের বাসনায় ডুবে যায়।
তাকে বলি আমি চুপিচাপ, ছায়া ছায়া থাকো ঘুমের
পাশে। ফুল ফুরিয়ে যাক জলে হাওয়ার কাঁপনে। রাত আরো নামুক পায়ের পাতায়। কিছুই জানি
না আমি, তবে বুঝতে পারি। হয়তো রক্তের ভিতর টের পাই। যেমন
তুমি গাছ, অরণ্য, নদী, নারী, ফুল, পাখি,
মাছির পেখম, মাছের চোখ আর চলন, হরিণের ছুটেচলা, জিরাফের গ্রীবা, নিজের চোখ, ওষ্ঠাধর, স্তন,
হাসি ও আনন্দ, রক্তের ভিতরকার যন্ত্রণা,
রাত্রি, প্রজাপতি, ঝিঁঝি, জুনিপোকা, গান
আর বর্ষণ ভালোবাসো। আর এইসব আমিও ভালোবাসি। তোমার সুন্দর চোখে যাকিছু দেখে তুমি
মুগ্ধ হও, চঞ্চল হও, ভালোবেসে
ফেলো, আমিও তেমন। কেননা আমার চোখও তোমার মতোই সুন্দর।
তোমার চোখেরই যমজ সহোদর। বিস্তারিত গতকাল নামিয়েছে শরীরে যা আছে সুন্দর ও
আপ্তসত্য। ক্ষয়ের পাশে আঁতিপাতি খুঁজে ফিরি পূর্বাপর সকরুণ।
বেগুনি সুতোতে জোনাক গেঁথেছে এই জন্মান্ধ
চোখ—ঘর,
উঠান আর পাহাড়ের ওপার জেগেই থাকে, নির্ঘুম
নির্ঘুম। ভাঁটফুল ক্ষেত উলম্ব দিগন্তচুর হয়েছে লাল অসুখ। একটি গাছের ডালে বসে একটি
শাদা কাক। কাক কেমন করে শাদা হয়? কলসিতে ছয়মাস রেখে দাও
শাদা হবে কাক। শূন্যতার ওষ্ঠাধরে আচঞ্চু চুম্বনে সে বাজাবে রাতে দীর্ঘরাতের শাঁখ,
শাঁখের করাত। দীর্ঘশ্বাসের পাশে আমি চুপিচাপ বসে থাকি চিরদিন।
ইদানীং বাতাসও আসে সিজোফ্রেনিয়াক সিটিজেন। তার পাশে শুয়ে থাকি আমি দৃশ্যখোদক।
দৃশ্য খুঁড়তে খুঁড়তে নীরবতা নামে ধানক্ষেতে, জাগে গূঢ়
নক্ষত্রের দাগ। পতঙ্গ কারো বুকের ভিতর সুমসাম উড়ে। ওখানে দুলছে আলোর নিষাদ। আলোর গন্ধে
আর খড়ের আগাছায় ছেয়ে আছে তোমাদের মাঠ। শুক্লচোখে দেখি চাঁদ পুড়ে ছাই। এই চাঁদ
রূপজীবার ত্বকে পুড়ে গেছে; এই চাঁদ ভিক্ষার নেশায় পথ হনন
করে। আমরা ফিরে যাই গোরের নদীস্বর। তার মানে ধানক্ষেতে তার গূঢ় সর্বনাম, স্ট্রবেরির গোপন রুমাল। রুমালের ভাঁজে লুকোয় বাতাস। আমি সবকিছু কেচে
দিয়ে বাতাস ছিঁড়ে ফেলি। পাশাপাশি ক্যানভাস সাজানো, ছড়ানো
রং আর ব্রাশ। রং চিনি একা পূর্ণিমার পরে। যে গেছে—সে
স্তনহীনপুষ্পের চির দুর্গন্ধ পাতালে—সুন্দর সবকিছু আছে,
পাশে ও প্রবাসে। প্রবাস পাহাড়ের ওপারে। আমি পাহাড়ে থাকি, আমরা থাকি। আমাদের দেহে রোদ শুকিয়ে যায়। ইদানীং সবকিছু কেচে দিয়ে
বাতাসে শুয়ে থাকি। সে আর সে আসে। তারা ধ্বংস হলে খুঁজি বাতাসের ছাই। তারা কখনো
থাকে না আর। থাকে বইয়ের ভিতর মৃদু পোকাস্বর, কিছুটা
টারমাইটে, কিছুটা অক্ষরের দেহে। ত্রিমাত্রিক স্বরবর্ণ
জেগে ওঠে, জেগে উঠে প্রবীণ জনপদ আর নদ। নদের কঙ্কালে
মাটি। সে আর সে আসে, এইভাবে আসে বাতাসের ছাইয়ে। তারপর
একটি বেদানাগাছের ডালে বসে থাকে একটি শাদা কাক। আচঞ্চু সে কাকে করে চুম্বন,
বাজায় রাতে দীর্ঘরাতের শাঁখ, শাঁখের
করাত?
No comments:
Post a Comment