বাবা এবং একটি চশমা
(উৎসর্গ: আমার পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় এবং অসাধারণনারী মা-কে)
বিশাল সাইজের চশমাটা পরে আছে মা।
মা'কে উদ্ভট, হাস্যকর দেখাচ্ছে। চশমাটার বামপাশের কাঁচটাতে বেশ ক'টা ফাটল
ধরেছে। চশমাটা পরার পর মা বাচ্চা খুকির মতো হয়ে পড়ে; বেশ ক'বার
ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছি।
"মা, তুমি ভাঙা চশমাটা আবার পরেছ?"
"আ..আসলে চোখে দেখছিলাম নারে
ভালোমত।" মা'র সুন্দর, ফর্সা মুখটি লজ্জায় লালচে রঙ ধারণ করল।
"হ্যারে সিহাব, ঝর্ণা
তোকে কল দিয়েছিল?"
"না মা।"
বুঝলাম প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য আপার কথা নিয়ে
এলো মা।
মা যে চশমাটা পরেছে তা আমার মরহুম বাবার। বাবা
আচমকাই আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছিল। অবশ্যি এটাও ঠিক, বাবার
বয়েসের কোঠা ষাটের ঘরে পা রেখেছিল। তাতে কিই-বা আসে যায়! কতো থুত্থড়ে বুড়োই তো
একটা পা কবরে দিয়ে দিব্যি হেসে-খেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে!! আমার বাবার কেনই বা ষাটের
ঘরটাই হয়ে পড়ল 'কূপা'-তে পরিপূর্ণ?!
বাবা বিওএস* নামক এক প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরি
করত। বাবার এই ব্যাংক থেকে অবসর গ্রহণের ঠিক আগের পোস্ট ছিল সিনিয়র ভাইস
প্রেসিডেন্ট। এই ব্যাংকের সুপ্রতিষ্ঠার পেছনে তাঁর অবদান ছিল অনস্বীকার্য। সবে যখন
এই ব্যাংক গঠিত হচ্ছিলো এটির অফিসিয়ালরা বাবার অন্য ব্যাংকে পারফরম্যান্স দেখে
তাদের ব্যাংকে যোগদান করার অফার দেন। বাবা যোগদান করে এবং মাঠ পর্যায়ে কোম্পানির
জন্য দৌঁড়-ঝাপসহ আনুষঙ্গিক সব কাজ করে এটির সাফল্যের নিয়ামক হিসেবে ২৪টি বছর
অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছে নিজেকে। অথচ, শেষ দিকে কি এক ছোট ভুলে তাঁর দুই
কি তিনটি প্রমোশন থেমে গিয়েছিল। পৃথিবীটা এমনই। ঐ যে গুরুজনেরা বলে না, 'এ
দুনিয়ায় বালা মাইনসের ভাত নাই রে!'
আমিও কিছু পাইনি বাবার প্রতিষ্ঠান থেকে তাঁর
মৃত্যুর পর। তবু আফসোস করি না- কর্পোরেট মানুষগুলো 'কর্পোরেট' জীবন-যাপন
করুক না। আমি তো সাদাসিধে,
প্রিয় মা-বোনের শতমূল্য উচ্ছ্বল হাসি দেখার জন্য খুব বেশি
কর্পোরেট হওয়ার প্রয়োজন পড়ে নাতো আমার!!
বাবা কোনো এক অলুক্ষণে রাতে আচমকা
হার্ট-অ্যাটাকে মারা গিয়েছিল। এর আগে বাবার ছোট-খাটো দু'টো
অ্যাটাক হয়েছিল কেবল। যমদূত কী কারণে বাবার জান কবজের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে
প্রেরিত হয়েছিলেন তা কেবল খোদ মহান তিনিই জানতেন! ভালো মানুষদের কি সৃষ্টিকর্তা
এভাবেই চটজলদি নিয়ে যান?!
মনে পড়ে বাবার একটি কথা যা আজও আমার কাছে অমীয়
বাণীর মতো,
"শোন সিহাব, তোকে এ জীবনে অনেকেই কষ্ট দিবে। কিন্তু তুই কখনও কারো মনে
কষ্ট দিবি না।"
অদ্ভূত হলেও সত্যি, তাঁর এ
অমীয় বাণী শোনানোর সময়টা এখনও জ্বলজ্বল হয়ে রয়েছে স্মৃতির মণিকোঠায়। তা ছিল ২০০৩; ইন্টার
সম্পন্ন করার ঠিক পরের বছর ছিল ওটি।
বারোটা বছর ধরে তাঁর এই অমীয় বাণী আমার
অবচেতনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এতোটাই জায়গা দখল করে বসেছে আমি প্রতিনিয়তই চেষ্টা করি
কোনো মানুষকে এতটুকু দুখ না দিতে। মাঝে মাঝে হয়তোবা দেয়া হয়ে যায়। মানুষ আমি, ফেরেশতা
তো নই!
মা ছাড়া আমাদের সাথে বাবা'র একটা
দূরত্বের দেয়াল তিলে তিলে কবে সৃষ্টি হয়েছিলো বুঝতে পারিনি। এর প্রধান কারণ হয়তোবা
তাঁর অতিরিক্ত খোদা-ভক্তিতে পেয়ে বসা। ছোটবেলায় যে বাবাকে দেখতাম আমাদের সাথে বসে
টিভি দেখছে, তা যেন সুদূরে হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি হয়ে ছিল! যে বছর না ফেরার দেশে পাড়ি দিল
বাবা সে বছরের দু'টো ঘটনা এখনও স্মৃতির মণিকোঠায় জাজ্বল্যমান। অনার্সে অধ্যয়নকালীন মাসিক বেতন
নিতে গিয়েছিলাম বাবার কাছে। বাবা গোঁ ধরে বসল, সেও যাবে আমার সাথে। অথচ আমার
একদম ইচ্ছে করছিল না বাবাকে সঙ্গে নিতে। বাবা বোঝাল সে আমার ভার্সিটি যাবে না, এমনিই
তাঁর বাইরে যেতে খুব ইচ্ছে হচ্ছিল। বাবার সাথে এক রিক্সায় ঘুরে বেড়ানো সেটিই ছিল
আমার শেষ স্মৃতি!
পরের যে স্মৃতি সেটি বাবার মৃত্যুর সেই
রাতেরই। বাবা প্রায়ই মুঠোফোনে খোঁজ নিত, সে রাতেও বাবা কল দিল আমায় কোথায়
আছি জানার জন্য। অথচ,
আমি এলাকায়ই ছিলাম। ব্যাটমিন্টনের মৌসুম চলছিল, কোর্টে
খেলছিলাম। সেই রাতেই তিনটের দিকে বাবা শেষ নি:শ্বাস ছেড়েছিলো!
বাবা মারা যাওয়ার পর মা অপ্রকৃতিস্থের মতো হয়ে
পড়ল। তাঁর নিউরোনের স্মৃতি থেকে মাঝে মাঝেই আমাদের দু'ভাই-বোনের
নামগুলো আবছা বা মুছে যাচ্ছিল। মা'র পাগলামিটা চূড়ান্ত রূপ নিত যখন
ভাঙ্গা চশমাটা হাতে পেত। তাঁর পাশে অদৃশ্য কাউকে ভেবে নিত সে, ভাঙ্গা
চশমাটি অদৃশ্য তাকে পরানোর ভঙ্গি করে নিজেই পরে নিত এবং পাশের জনের (!) সাথে
দিব্যি শুরু করে দিত কথোপকথন!
আট মাসের সাইকিয়াট্রিস্ট ট্রিটমেন্টের পর মা
প্রকৃতিস্থ হলো। সাইকিয়াট্রিস্ট ট্রিটমেন্টের মজার একটা দিক হলো, রোগি যত
বেশি ঘুমের রাজ্যে বিচরণ করবে ততটাই তার সুস্থতার পথে এগিয়ে যাওয়ার পথ সুগম হবে।
সেই পুরনো সুস্থ, প্রকৃতিস্থ
মা'কে পাওয়ার পর আমরা দু'ভাই-বোন স্বস্তির নি:শ্বাস ছাড়লাম। মা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে পড়লেও ভাঙ্গা চশমার
মায়া ছাড়তে পারল না।
"সিহাব, তোর বাবার চশমাটা কই রে?"
"ম...মা, ও-ওটা হারিয়ে গেছে।" মা'কে
মিথ্যে বলতে রীতিমতো গলদঘর্ম হতে হলো!
"মিথ্যে বলবি না আমায়! চশমাটা দে আমাকে।
আমি ঠিক হয়ে গেছি;
আমার কিছু হবে না আর!" রাগে, উত্তেজনায়
মা'র ফর্সা মুখটি লালচে রঙ ধারণ করেছিল।
আলমিরার তালাবদ্ধ দেরাজ থেকে শেষমেশ ভাঙ্গা
চশমাটা বের করে মা'কে দিতেই হলো।
সেই থেকে মা'র যখনই মনটা ভীষণ খারাপ হয় বাবার
চশমাটা চোখে লাগায়। ভোজবাজির ন্যায় মা'র রূপান্তর ঘটে ছোট্ট খুকিতে!!
(বিওএস-ব্যাংক অভ স্যোশাল। এই নামের কোনো
ব্যাংক আদৌ নেই। সবই লেখকের উর্বর মস্তিষ্কের অর্বাচীন কল্পনা! কেউ যদি এতে
যোগসূত্র খুঁজতে চান লেখক দায়ী নয়!)
No comments:
Post a Comment